স্কুলে আর পড়াতে পারবেন কি না জানা নেই। শিক্ষক দিবসে ছাত্রছাত্রীদের দেখতে ইচ্ছে করছে বাতিল হওয়া প্যানেলের যোগ্য শিক্ষকদের।
পশ্চিমবঙ্গের চাকরিহারা শিক্ষকছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে চাকরি পেয়েছিলেন শিক্ষকরা। তার নয় বছর বাদে ফের পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে তাদের। নবম–দশম ও একাদশ–দ্বাদশে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা সাত ও ১৪ সেপ্টেম্বর। ঠিক তার আগেই, শুক্রবার শিক্ষক দিবস উদযাপন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের স্মরণে এই দিনটি পালন করা হয় দেশজুড়ে। প্রতি বছর শিক্ষক দিবস পালিত হয় হইহই করে, এবার যেন সেই আবেগে ভাটা পড়েছে।
চাকরি বাতিলের পরে
২০১৬ সালের এসএসসির নিয়োগ প্যানেল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সেই মামলা হাইকোর্ট থেকে পৌঁছে যায় সুপ্রিম কোর্টে। চলতি বছরের তিন এপ্রিল শীর্ষ আদালতের রায় বাতিল হয়ে যায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের চাকরি। যোগ্য শিক্ষকরা ডিসেম্বর অবধি পড়ানোর সুযোগ পাবেন। জানুয়ারিতে তাদের স্কুলে ফিরতে হলে আর একবার পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।
ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দাগি শিক্ষকদের নামের তালিকা কমিশন প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় যারা নেই, তাদেরও বসতে হবে পরীক্ষায়। যদি এই পরীক্ষায় সফলভাবে পাশ করতে না পারেন, তাহলে শিক্ষকতার চাকরি খোয়াতে হবে। শিক্ষকদের কাছে এবারের পাঁচ সেপ্টেম্বর একেবারেই নিরানন্দের।
শিক্ষক দিবসে তাই হতাশার কথা শোনালেন নদিয়ার রানাঘাটের হাজরাপুর হাইস্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক দেবাশিস অধিকারী। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রতি বছরের শিক্ষক দিবসের তুলনায় এবারের দিনটা আমাদের কাছে অন্ধকার। ডিসেম্বর অবধি আছি, তারপরে পরীক্ষায় পাশ করতে পারব কিনা জানি না। ১০ বছর পরে নতুন প্রজন্মের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে পরীক্ষায় বসাটাই তো অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক আমাদের কাছে।"
ব্যাপক ধরপাকড়, চাকরিহারাদের মিছিল হতে দেয়নি পুলিশ
চাকরিহারা শিক্ষকরা কলকাতায় অর্ধনগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছিলেন। নবান্ন পর্যন্ত মিছিল হওয়ার কথা। ব্যাপক ধরপাকড় চালিয়ে পুলিশ তা হতে দিলো না।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শিয়ালদহ স্টেশনে
চাকরিহারা শিক্ষকরা বলেছিলেন, শুক্রবার বেলা এগারোটা থেকে তারা শিয়ালদহ সাউথ স্টেশনের সামনে সমবেত হবেন। তারপর শুরু হবে প্রতিবাদ মিছিল। অর্ধনগ্ন হয়ে। তারা মিছিল করে রাজ্যের সচিবালয় নবান্নে যাবেন বলে জানিয়েছিলেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শুরু হলো ধরপাকড়
সাড়ে দশটা থেকে শুরু হলো পুলিশের ধরপাকড়। শিয়ালদহ নর্থ ও সাউথ স্টেশনে যাকেই সন্দেহ হয়েছে, পুলিশ তাদের আটক করেছে। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজারে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
প্রচুর পুলিশ মোতায়েন
সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরেই মোতায়েন করা হয়েছিল মোট ৮৪০ কনস্টেবল, ২৫টি র্য়াফ বাহিনী। তাদের সঙ্গে ছিলেন পাঁচজন এসিপি, ১২জন ইন্সপেক্টর, ৬০ জন এসআই। জলকামান ছিল। কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিল। ১৫০ জন নারী পুলিশও ছিলেন। পুলিশ কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। শিক্ষক মনে হলেই আটক করেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেন এই প্রতিবাদ?
চাকরিহারা শিক্ষকদের নেতা চিন্ময় মণ্ডল ডিডাব্লিউকে ফোনে জানান, সরকার তো তাদের মর্যাদাহানি করে রাস্তায় নামিয়ে এনেছে। তাদের নগ্ন করে দিয়েছে। তাই তারা অর্ধনগ্ন হয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। কীভাবে এই প্রতিবাদের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেসব তিনি বলেননি। তিনি বলেছিলেন, প্রতিবাদ হলেই আপনারা দেখতে পাবেন। কিন্তু পুলিশ তাদের কোনোরকম বিক্ষোভই দেখাতে দেয়নি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দাঁড়াতেই দেয়নি পুলিশ
শিযালদহে পুলিশ চাকরিহারাদের দাঁড়াতেই দেয়নি। সোজা তুলে নেওয়া হয়েছে পুলিশ ভ্যানে। কয়েকজন হলেই তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে লালবাজার বা থানায়। আটকদের সঙ্গে সংবাদমাধ্যম যাতে কথা বলতে না পারে, সেজন্যও সচেষ্ট ছিল পুলিশ। চাকরিহারা শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তারা পুলিশকে আগাম জানিয়ে মিছিল করতে চেয়েছিলেন। তাদের সেই সুযোগও দেয়নি পুলিশ। ভয়ংকর তৎপরতা দেখিয়ে তারা চাকরিহারা শিক্ষকদের আটক করে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ধর্মতলার ছবি
শিয়ালদহে এই পরিস্থিতির পর চাকরিহারারা ঠিক করেন, তারা ধর্মতলায় প্রতিবাদ জানাবেন। কিন্তু সেখানেও পুলিশ তাদের সমবেত হতে দেয়নি। শমিং মল, বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে যেখানেই তাদের সন্দেহ হয়েছে, সেখান থেকেই চাকরিহারাদের আটক করেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আন্দোলনকারী ও পুলিশের বক্তব্য
ধর্মতলায় ছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষিকা শুভ্রা ঘোষ। তিনি ফোনে ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, পুলিশের তাড়া খেয়ে যাওয়ার সময় তিনি রাস্তায় পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন। তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য চলে যান। শিয়ালদহ ও ধর্মতলায় পুলিশ কর্মীরা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার কারণে চাকরিহারাদের নবান্ন অভিযোন করতে দেওয়া হয়নি। তারা গোলমালের আশঙ্কা করেছিলেন। সেইমতো ব্যবস্থা নিয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পড়ুয়া যা বললেন
আকাশ গুপ্ত এখনো পড়াশুনা করছেন। তিনি ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, তার পাড়াতেও কয়েকজন শিক্ষকের চাকরি গেছে। এটা অ,ম্মানের। যাদের চাকরি গেলো, তারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা, তা কেউ জানতে পারলো না। এমনিতে তিনি মনে করেন, অর্ধনগ্ন হওয়া ঠিক নয়। কিন্তু এই অর্ধনগ্ন প্রতিবাদ নিয়ে তার কোনো মতামত নেই।
ছবি: Subrata Goswami/DW
8 ছবি1 | 8
প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকের জীবন অভূতপূর্ব সংকটের সামনে। দেবাশিস বলেন, "চাকরি পাওয়ার পরে ঋণের মাধ্যমেই আমরা যা কিছু করেছি। আমার অনেক ঋণ মেটানো বাকি আছে। জানি না ব্যাংক আমার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে। নাবালক ছেলে, বৃদ্ধ মা-বাবার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। এসএসসির চাকরি পরীক্ষা উচ্চবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা সাধারণত দেয় না। আমাদের মত নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরাই দেয়। আমাদের দোষ ছিল যে, আমরা ফর্ম ফিলআপের ২৪০ টাকা দিয়ে পরীক্ষায় বসেছি, এর বেশি সরকারকে দিতে পারিনি। আমরা সিস্টেমের কাছে হেরে গেলাম।"
নিজেকে হতভাগা শিক্ষক বলে পরিচয় দিলেন মালদা জেলার সালাইডাঙ্গা হাইস্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক পঙ্কজ রায়। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "অনশন করে, মিছিল করে সব আন্দোলনে অংশ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। আমি তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ। আমার বাবা গাড়িচালক। পরিবারের প্রথম প্রজন্ম হিসেবে আমি চাকরি পেয়েছিলাম। এখন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে পরিবার নিয়ে কোথায় দাঁড়াব জানি না। আগের কোনো পাঁচ সেপ্টেম্বর কল্পনা করিনি যে এমন একটা আশাহীন শিক্ষক দিবস দেখতে হতে পারে!"
আন্দোলনের দুই মুখ
বীরভূম নলহাটির মথুরা হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা সোমা দাস। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তিনি। ২০১৬ সালে মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও চাকরি হয়নি তার। আইনি লড়াইয়ের পরে আদালতের নির্দেশে সোমাকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় স্কুল সার্ভিস কমিশন। এরই মধ্যে ২০১৯ সালে সোমার ক্যান্সার ধরা পড়ে। নলহাটির আশ্রমপাড়ার বাসিন্দা সোমা লড়াই থেকে পিছু হটেননি। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের প্যানেল বাতিল করে দিলেও একমাত্র সোমার চাকরি থেকে গিয়েছে মানবিক কারণে।
তাকে আর পরীক্ষায় বসতে হবে না। তার চাকরির মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয়। তবু প্যানেলভুক্ত যোগ্য শিক্ষকদের জন্য সমব্যথী সোমা। পাঁচ সেপ্টেম্বর ছুটি বলে বৃহস্পতিবার তার স্কুলে শিক্ষক দিবস পালিত হয়েছে। তিনি বলেন, "কোনও রকমে স্কুলে দিনটি পালন করা হয়েছে। কারো মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। থাকার কথাও নয়। বিশেষ করে আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। আমি চাইনি আমার চাকরি এইভাবে থেকে যাক। অনেক যোগ্য শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে।"
২০১৬ সালের প্যানেলে দাগি শিক্ষকরা অনেক যোগ্য চাকরিপ্রার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন। মেধা তালিকায় থাকা প্রার্থীরা বাদ পড়ে গিয়েছেন। এই চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন, অবস্থান চলছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তাদের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন রাসমণি পাত্র।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি ও ২৬ হাজার চাকরি বাতিলের প্রতিক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৬ হাজার চাকরি বাতিল হওয়ার পর রাজ্য সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন চাকরিহারা শিক্ষক, রাজনীতির ময়দানের বিরোধী থেকে শুরু করে অনেকেই। দেখুন ছবিঘরে ....
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী বলেছে সুপ্রিম কোর্ট?
পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগ মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ভয়ংকর দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়েছে। জালিয়াতি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টায় পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া কলুষিত হয়েছে। বৃহত্তর পরিসরে দুর্নীতি হয়েছে। যোগ্য ও অযোগ্যদের আলাদা করা যাচ্ছে না। তাই পুরো প্যানেল বাতিল হবে। অযোগ্য বলে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিতদের বেতন ফেরত দিতে হবে। তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এই চাকরি নিয়ে
শিক্ষকদের এই চাকরি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। চাকরির পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া করেছে সরকারি সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশন বা এসএসসি। সরকারি স্কুলের জন্য এই নিয়োগ হয়। সেখানে দুর্নীতি হলে সেই দায় স্বভাবতই রাজ্য সরকারের উপরই এসে পড়ে বলে দাবি করছেন চাকরিহারা শিক্ষক থেকে বিরোধী সকলেই। বিরোধীরা দাবি তুলেছেন, এর দায় মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কান্নায় ভেঙে পড়লেন তারা
সুপ্রিম কোর্টের রায় আসার আগে শহিদ মিনারের পাশে জড়ো হন শিক্ষকরা। উদ্বিগ্ন শিক্ষকরা সুপ্রিম কোর্টের রায় জানার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের যাবতীয় ক্ষোভ গিয়ে পড়ে রাজ্য সরকারের উপর। তাদের প্রশ্ন, কিছু মানুষ দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছে বলে তাদের সকলের চাকরি গেল। এটা তারা মেনে নিতে পারছেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'দুর্নীতি না করে শাস্তি পেলাম'
শাহনি নাজনিন ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''কোনো অন্য়ায় না করে, দুর্নীতি না করে শাস্তি পেলাম। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। দোষ প্রমাণ করুক। মাথা পেতে নেবো। এ কেমন বিচার না অন্য কিছু জানি না। কী করবো জানি না। মনে হচ্ছে, শেষ হয়ে গেছি। মানতে পারছি না। ছোট থেকে সততার সঙ্গে বড় হয়েছি। তার এই পরিণাম। চাকরি অর্জন করেছি, কাউকে ঘুষ দিইনি। তারপর এরকম হলো?''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'চাকরির পরীক্ষা দুর্নীতিমুক্ত করার দায় কার?'
ডিডাব্লিউকে রজত হালদার বলেছেন, ''আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যোগ্যদের জন্য চরমতম বিপর্যয়। আগামীতে যারা মেধার জোরে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেবেন, তারা ভাবুন। পরীক্ষা পদ্ধতির গলদ থাকলে ছয় বছর পর চাকরি যাবে। প্রশ্ন হলো, পরীক্ষা পদ্ধতি দুর্নীতিমুক্ত করার দায়িত্ব কার, পরীক্ষার্থীদের, সরকারের নাকি বিচারব্যবস্থার?''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'নিয়োগকারী সংস্থার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল'
ডিডাব্লিউর কাছে রিজিয়া খাতুনের প্রতিক্রিয়া, ''আমি ভাবতে পারছি না, এরকম হওয়া সম্ভব! কী করে বিনা দোষে কেউ এরকম শাস্তি পেতে পারে। কী করবো, তা এখনই বলতে পারছি না। আমাদের আশা ছিল, আমাদের জয় হবে। কোনো দুর্নীতি হলে নিয়োগকারী সংস্থার শাস্তি হওয়া উচিত, আমাদের সেই শাস্তি পেতে হবে?''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
স্কুল ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে?
কোনো স্কুলে চারজন, কোনো স্কুলে আটজন, কোনো স্কুলে ছয়জন শিক্ষকের চাকরি গেলো। বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকারা জানিয়েছেন, তাদের স্কুল চালানো মুশকিল হবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশ্ন উঠছে, যোগ্য শিক্ষকরা যে অসম্ভব মানসিক চাপের মধ্যে পড়বেন, সকলে তাদের দিকে সন্দেহের চোখে দেখবেন, সেই ক্ষতি কে পূরণ করবে?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ''বিচারব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ সম্মান আছে। তা সত্ত্বেও রায় মানতে পারছি না। একজনের অপরাধে কতজনের শাস্তি হবে? স্কুল সার্ভিস কমিশন স্বশাসিত সংস্থা। আমরা কখনো হস্তক্ষেপ করি না। আর কতদিন বাংলাকে টার্গেট করবেন? কোর্টের রায় মেনে এসএসসি ততিন মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করবে। আরো এক লাখ শিক্ষকের নিয়োগ দেবো। এটা বিজেপি, সিপিএম করিয়েছে।''
ছবি: Prabhakar Tewari/DW
মমতার প্রস্তাব
মমতা বন্দ্যোাপাধ্যায় বলেছেন, ''যারা চাকরি হারিয়েছেন, তারা একটা সংগঠন তৈরি করেছেন। তারা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম বুক করেছেন। আমরা সাত তারিখ তাদের সম্মেলনে সেখানে যাবো। মুখ্যসচিব ও অন্য জ্ঞানী-গুণীরা যাবেন। আপনারা সকলে আবেদন করুন। আমরা চেষ্টা করবো। ধৈর্য ধরুন। এবার গরম বেশি বলে ৩০ এপ্রিল থেকে স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে যাবে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি কংগ্রেসের
প্রদেশ কংগ্রেস প্রধান শুভঙ্কর সরকার দাবি করেছেন, এই দুর্নীতির দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হবে। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেছেন, শিক্ষায় দুর্নীতি হয়েছে তাই নয়, সেটা ধামাচাপা দিতে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে জনগণের টাকা করচ করা হয়েছে। কেন এইভাবে জনগণের টাকা নয়ছয় করবে সরকার?
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
বিজেপি বলছে, তৃণমূল দায়ী
রাজ্য বিজেপি সবাপতি সুকান্ত মজদুমদার বলেছেন, ''মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্কুল সার্ভিস কমিশন, রাজ্য সরকার কেন যোগ্য ও অযোগ্যদের পৃথকীকরণ করে দিল না? রাজ্য সরকার পৃথকীকরণ করে দিলে এতজনের চাকরি চলে যেত না। শুধুমাত্র অযোগ্যদের চাকরি চলে যেত।”
বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ''এই ঘটনার জন্য দায়ী তৃণমূল। যোগ্যরা এদের পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য চাকরি হারালো। গোটা স্কুল শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়লো।''
ছবি: Srijit Roy
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী যা বললেন
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ''সরকার এতদিন পরেও বলতে পারলো না, কতজন অযোগ্য। সরকার দাঁড়ালো অযোগ্যদের পাশে। সরকারের অপদার্থতার জন্য এটা হয়েছে। সরকার অযোগ্যদের বাদ দিলো না বলে, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের মুখ পুড়লো।'' সিপিএম নেতা ও আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ''দুর্নীতি করেছে সরকার। তাদের এই দায় নিতে হবে।'' মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, মামলা করার আগে ভাবলেন না, কে যোগ্য কে অযোগ্য।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শুক্রবার আবার শুনানি হতে পারে
শুক্রবার নিয়োগ দুর্নীাতি নিয়ে আবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানি আছে। রাজ্য সরকার বাড়তি পদ তৈরি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্ট তা নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় এর উপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। সেই বিষয়ে শুক্রবার শুনানি হতে পারে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Qadri
13 ছবি1 | 13
এক সন্তানের মা রাসমণি প্রতিবাদে নিজের চুল কেটে ফেলেছিলেন প্রকাশ্য রাজপথে। তার শিক্ষক হয়ে ওঠার স্বপ্ন এখন ঘোর অন্ধকারে ঢাকা। রাসমণি ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা শিক্ষকদের দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। কিন্তু আমরা কাদের পথ দেখাব। পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় জায়গা করে নেওয়ার পরেও আমরা সুবিচার পেলাম না। দুর্নীতি প্রমাণিত হল, কিন্তু তার জন্য আমাদের যে ক্ষতি হল, সেটার মূল্য কেউ দিল না। আমাদের বয়স বাড়ানো হল না, কোনো সুবিধাও দেওয়া হল না। বিচার ব্যবস্থার প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। তবুও আশা ছাড়িনি। শিক্ষকতা হচ্ছে মানুষ তৈরির পেশা, সমাজ গড়ার পেশা। যারা শিক্ষক হতে পারেন, তারাই রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন।"
বিজ্ঞাপন
প্রাথমিকের জন্য দুর্ভাবনা
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের মতো প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও মামলা চলছে। বছর দুয়েক আগে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ বাতিল করে দেয় ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া। এর ফলে ৩২ হাজার শিক্ষকের নিয়োগে প্রশ্নচিহ্ন পড়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রেও কি চাল ও কাঁকর আলাদা করা যাবে না, দুর্নীতির দায়ে যোগ্যদেরও চাকরি চলে যাবে? এ নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন শিক্ষকরা।
‘ ১০ বছর পরে নতুন প্রজন্মের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে পরীক্ষায় বসাটাই তো অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক আমাদের কাছে’ দেবাশিষ অধিকারী’
This browser does not support the audio element.
কৌশিক সাঁতরা হাওড়ার বাগনান দক্ষিণ চক্রের রবিভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমি যদি যোগ্য না হতাম তাহলে এতগুলো পরীক্ষায় পাশ করতাম কী করে? টেট তো একমাত্র পরীক্ষা নয়, এর আগে অনেক পরীক্ষা দিয়েছি। বেশ কিছুতে কোয়ালিফাই করেছি, কিন্তু অন্য কারণে চাকরি হয়নি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বলছে, বিচার যদি সত্যিকারের হত, তাহলে দোষীরা শাস্তি পেত!"
তার প্রশ্ন, "যাদের দাগি বলা হচ্ছে, তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না কেন? আমাদের ডাকা হয়নি কেন? আমি তো উত্তর দিতে পারতাম, আমার কাছে তথ্য মজুত রয়েছে। শিক্ষক দিবসে অন্তত এটুকু বুঝতে পারছি যে, পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী প্রজন্ম আর শিক্ষক হতে চাইবে না। যাদের আর্থিক অবস্থা ভাল, তারাই এই পেশায় আগামী দিনে আসবে। যোগ্যতার বিনিময়ে নয়, টাকা দিয়ে।"
এই পরিস্থিতি ব্যথিত, বিচলিত করছে শিক্ষাবিদ থেকে বিশিষ্টজনদের। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে বিগত কয়েক বছর ধরেই শিক্ষক দিবস এরকম অন্ধকারে আচ্ছন্ন। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, কলেজ সব মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাটা এমন বিপর্যস্ত যে শিক্ষক দিবস মানেই একটা অভিশপ্ত দিন।"
সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর কাছে এবারের পাঁচ সেপ্টেম্বর কালা দিবস। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "বহু যুগ ধরে শিক্ষকদের পেশা ছিল সম্মানের। কিন্তু এখন জনমানসে সেই সম্মান ধুলোয় মিশে গিয়েছে। এর জন্য শিক্ষকরা দায়ী নন, দায়ী দুর্নীতি। আমার খুব খারাপ লাগছে। এই দিনটা কালা দিবস হয়ে থাকবে।"