1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এক কেজি চা ৫০০ টাকা, শ্রমিক পায় ছয় টাকা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২১ আগস্ট ২০২২

১৪৫ টাকা দৈনিক মজুরি মেনে না নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা৷ তারা দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার দাবিতে অনড় রয়েছেন৷ বিশ্লেষকরা বলছেন রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে নয়, আইনের মাধ্যমে চা শ্রমিকদের দাবি পূরণ করা দরকার৷

দেশের ১৬৮টি চা বাগানে দেড় লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন
দেশের ১৬৮টি চা বাগানে দেড় লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেনছবি: DW/M. Mamun

গত ৯ আগস্ট থেকে চাশ্রমিকরা তাদের ধর্মঘট শুরু করেন৷ স্থানীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের উপস্থিতিতে বুধবার রাতে শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিকদের জন্য ১৪৫ টাকা মজুরি ঘোষণা করা হয়৷ সেখানে চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল তা মেনে নিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও শ্রমিকরা তা মেনে নেননি৷ তারা ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন৷ রবিবার তারা বাগান থেকে বেরিয়ে সিলেটের তিন জায়গায় মহাসড়ক অবরোধ করেন৷ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাখন লাল কর্মকার বলেন, ‘‘ শ্রমিকরা ধর্মঘট চালিয়ে যাবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত৷'' তবে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে ফোনে পাওয়া যায়নি৷

‘সোনা ফলাই, কিন্তু তার ফল আমরা পাই না'
মৌলভীবাজারের বরমচাল চা বাগানের শ্রমিক এবং পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আগনু দাস বলেন, ‘‘আমরা না খেয়ে ১৪ দিন ধরে আন্দোলন করছি ৩০০ টাকা মজুরির জন্য ৷ ১২০ টাকা থেকে মাত্র ২৫ টাকা বাড়িয়ে তা ১৪৫ টাকা করেছে৷ এটা আমরা মানি না৷আমাদের ৩০০ টাকাই দিতে হবে৷ নেতারা কী বলেছেন জানি না৷ আমরা শ্রমিকরা আন্দোলনে আছি৷'' তিনি বলেন,  ‘‘১৪৫ টাকায় সংসার চলবে না৷ আমার চার সদস্যের পরিবার৷ এক কেজি চালের দাম ৬০ টাকা৷ এক কেজি আলু ৩০ টাকা৷ এরপর লবণসহ অন্যান্য জিনিস আমি কীভাবে কিনব৷''

তার কথায়, ‘‘এক কেজি পাইকারি পাতি মালিক পক্ষ বিক্রি করে ৩০০ টাকা৷ আমাদের দেয় ছয় টাকা৷ আমরা সোনা ফলাই, কিন্তু তার ফল আমরা পাই না৷আমাদের ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করতে পারে না৷আমাদের চিকিৎসা হয় না৷আমাদের ঘরে টিন দেয়া হয় না৷এগুলো সব তাদের দেয়ার কথা৷''

চা বাগানগুলোকে এ , বি এবং সি এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়৷ এ শ্রেণির চাবাগানে দিনে সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা৷ প্রতি দুই বছর পর পর তাদের মজুরি বাড়ানোর কথা থাকলেও ২০১৯ সালের পর আর মজুরি বাড়ানো হয়নি৷ মজুরির বাইরে শ্রমিকরা সপ্তাহে তিন কেজি আটা পান দুই টাকা কেজি দরে৷ এছাড়া তাদের চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা দেয়ার কথা৷ একই সঙ্গে সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা থাকার কথা৷ আগনু দাস জানান, ‘‘কাজ না করলে মজুরি ও রেশন কোনেটাই দেয়া হয় না৷আমাদের আবাসন বলতে বস্তি৷''

১৪৫ টাকা দিয়ে কীভাবে সংসার চলবে: চা শ্রমিক

This browser does not support the audio element.

মৌলভীবাজার বরমচাল চা বাগানের শ্রমিক চন্দন কুর্মী জানান, শ্রমিকদের ১২০ টাকা মজুরির মধ্যেও ফাঁক আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘কমপক্ষে ২০ কেজি চা পাতা তুলতে পারলে ১২০ টাকা মজুরি দেয়া হয়৷ এর কম হলে প্রতি কেজিতে ছয় টাকা করে কেটে নেয়া হয়৷ কিন্তু যদি ২০ কেজির বেশি হয় তাহলে প্রতি কেজিতে মাত্র দুই টাকা বেশি দেয়া হয়৷''

দেশের ১৬৮টি চা বাগানে দেড় লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন৷ তাদের মধ্যে অস্থায়ী ৫০ হাজার৷ শ্রমিকরা বাগানেই থাকেন৷ তাদের অন্য কোনো জায়গায় বাড়ি বা জমি নেই৷ 

‘দাসত্বের জীবনে বাধ্য করা হচ্ছে'
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, ‘‘মাত্র ২৫ টাকা মজুরি বাড়িয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে৷ তারা যে ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করেছেন তাও বর্তমানের বাজারদরের তুলনায় অনেক কম৷ তাদের দাসত্বের জীবনে বাধ্য করা হচ্ছে৷ এক কেজি চালের দামই তো ৭০ টাকা৷ তাহলে তারা বাঁচবে কীভাবে৷ যে আটা দেয়া হয় রেশনে, তাও সামান্য৷এক কেজি চায়ের দাম বাজারে ৫০০ টাকা৷ তারা দিনে তোলে কমপক্ষে ২০ কেজি চা পাতা৷ তাদের তো এক কেজি চায়ের দাম দেয়া হয়না৷ আমরা চাই তারা যে ৩০০ টাকা দাবি করেছে সেটাই দেয়া হোক৷''

বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের মজুরি ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় না বলে জানান শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম৷ তার দাবি, মালিক-শ্রমিক মিলে মজুরি নির্ধারণ করা হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘এবারো মালিক শ্রমিক মিলে করেছে৷ মালিকরা ১৪০ টাকা দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতি আন্তরিক হয়ে ১৪৫ টাকা দিতে বলেছেন৷তাই করা হয়েছে৷''

তার দাবি, ‘‘বহিরাগতরা শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছে৷ সাধারণ সম্পাদক মেনে নিলেও তাকে অপমান করা হয়৷ তারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি৷''

১৪৫ টাকা কোন বিচেনায় নির্ধারণ করা হয়েছে, বাজার মূল্য দেখা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘‘ সেটা তো আমরা বলতে পারব না৷ এটা মালিক শ্রমিকদের বিষয়৷''

‘‘৩০০ টাকার দাবিটাও কম দাবি’’

This browser does not support the audio element.

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর মনে করেন, ‘‘শ্রম আইন মেনে মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে এই খাতে মজুরি নির্ধারণ করলে এই সমস্যা হতো না৷এখানে ইচ্ছামাফিক মজুরি নির্ধারণ করা হচ্ছে৷ এটা গ্রহণযোগ্য নয়৷''
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজ এর সহাকারী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিনও মনে করেন, বাজার দর এবং তাদের প্রকৃতই আর কী কী সুবিধা দেয়া হয় তা বিবেচনায় নিয়ে মজুরি নির্ধারণ করা দরকার৷ রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে নয়৷


গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘‘ চা বাগানের মালিকরা রেশনসহ আরো যে সব সুবিধার কথা বলছেন বাস্তবে সেগুলো নেই৷ একজন শ্রমিককে সপ্তাহে তিন কেজি আট দেয়া হয় দুই টাকা দরে৷ তবে এটা সবার জন্য নয়৷ যাদের রেশন কার্ড আছে তারা পায়৷ কিন্তু কাজে না গেলে, অসুস্থ হলে তাদের এটা দেয়া হয় না৷আগে তো চা বাগানে স্কুল নিষিদ্ধ ছিলো৷ তাদের সন্তানরা শ্রমিকই হয়৷ এখন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এনজিওর কিছু স্কুল আছে৷ আর চিকিৎসা বলতে বাস্তবে কিছু নেই৷ তাদের চাষের জমি দেয়ার কথা থাকলেও এখন দেয়া হয় না৷ তার কথায়, ‘‘এখনো চা বাগনে ব্রিটিশ আমলের দাস প্রথা চালু আছে বলেই মনে হয়৷''

তবে মালিকরা দাবি করছেন,  মজুরির বাইরে তাদের দৈনিক যে সুবিধা দেয়া হয় তার মূল্য ১৭৫ টাকা৷তারা ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করলেও ৪০০ টাকার সমপরিমাণ সুবিধা পেয়ে থাকেন৷চা সংসদ দাবি করেছে, ২০১২ সাল থেকে ১০ বছরে চায়ের নিলাম মূল্যের প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর শূন্য দশমিক এক ছয় শতাংশ হারে বাড়লেও চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে মোট ৯৪.২০ শতাংশ৷চা শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকারও বেশি দামের চা-পাতা নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি বাগান মালিকদের৷

বাংলাদেশ বিশ্বের তিন শতাংশ চা উৎপাদন করে৷২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশি চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা৷ জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ৷

চা-কাহিনিঃ ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই

07:50

This browser does not support the video element.

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ