একশ স্থানে পিনহোল ক্যামেরা বসিয়ে ১০০ বছর ধরে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের ‘একটি ছবি’ তোলার ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছেন এক অ্যামেরিকান শিল্পী৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা জোনাথন কিটস নিজের পরিচয় দেন একজন ‘কনসেপচুয়াল আর্টিস্ট' হিসাবে৷ তাঁর ভাষায়, একটি মাত্র ফ্রেমে তিনি ১০০ বছরের একটি চলচ্চিত্র ধারণ করতে চলেছেন৷
এই প্রকল্প এগিয়ে নিতে স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতা নিচ্ছেন কিটস৷ ১০ ইউরো জামানত রেখে প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবীকে তিনি দিচ্ছেন একটি করে পিনহোল ক্যামেরা৷
প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবী বার্লিনের আলাদা আলাদা এলাকা বাছাই করবেন এবং তারপর একটি গোপন স্থান খুঁজে বের করে ক্যামেরা বসিয়ে দেবেন৷ তবে এক্ষেত্রে এমন একটি স্থান তাঁকে নির্বাচন করতে হবে, যা অন্তত ১০০ বছর টিকে থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়, যেমন এটি হতে পারে কোনো একটি মনুমেন্ট৷
একজন স্বেচ্ছাসেবী যতদিন না বুড়ো বা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, ততদিন তিনি ক্যামেরার অবস্থান গোপন রাখবেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের একজন নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধির কাছে ক্যামেরার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন৷
১০০ বছর পর উত্তরাধিকারীরা ক্যামেরা নিয়ে ফিরে এলে জামানত হিসাবে দেয়া টাকা তাঁদের ফেরত দেয়া হবে৷ আর সেই সব ক্যামেরায় পাওয়া ছবি নিয়ে আয়োজন করা হবে প্রদর্শনীর৷
এ প্রকল্পের সহ উদ্যোক্তা গ্যালারি ‘টিম টাইটানিক'-এর এলিসা ব্রিংকমানসহ প্রায় ৫০ জন এরই মধ্যে জামানত দিয়ে একটি করে ক্যামেরা সংগ্রহ করেছেন৷ তবে ক্যামেরা বসানোর স্থানটি এখনো চূড়ান্ত করেননি এলিসা৷
তিনি বলেন, ‘‘১০০ বছর পর বার্লিন দেখতে কেমন হবে তা কল্পনা করে নিয়ে আমাকে এখন ক্যামেরাটা লুকিয়ে ফেলতে হবে৷ আমি এমন একটা জায়গা খুঁজছি, যেখান থেকে বার্লিনের দিগন্ত দেখা যায়৷''
গ্রীষ্মের একদিন বার্লিনে
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে গ্রীষ্মকালে উপভোগ করার মতো অনেক জায়গা রয়েছে৷ অ্যামেরিকার সানফ্রানসিসকো থেকে একটি পরিবার বার্লিনে বেড়াতে এসেছে৷ চলুন তাঁদের সাথেই বার্লিনের কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা যাক৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
খোলা আকাশের নীচে
বার্লিনের সুন্দর জায়গাগুলো দর্শনার্থীদের খুব আকৃষ্ট করে, বিশেষকরে খোলা জায়গাগুলো৷ আর আবহাওয়া সুন্দর হলে তো কথাই নেই৷ সানফ্রান্সিসকোতে বসবাসকারী আট বছর বয়সি এটহান লিউ, ওর বাবা চু আর মা আইভিকে নিয়ে বার্লিনের সৌন্দর্য উপভোগ করছে৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
সবুজ দ্বীপ
বার্লিনের জীব-জন্তুর এই পার্কটি শহরের অন্যান্য সব পার্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্ক৷ ২১০ হেক্টর আয়তনের এই পার্কটি তৈরি করা হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পার্কটির অনেকটাই ক্ষতি হয়৷ তবে ১৯৪৯ সালে আবারো নতুন করে সাজানো হয় পার্কটিকে৷ এবং সাজানোর ক্ষেত্রে জার্মানির অন্য শহরগুলো বিভিন্ন গাছ দিয়ে সাহায্য করে৷ বার্লিনবাসীদের জন্য সত্যিকার অর্থেই জীব-জন্তুর এই পার্কটি একটি বিনোদন কেন্দ্র৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
নতুন লেক
এই লেকের তীরে তৈরি বিয়ার গার্ডেনটি লেকের বিশেষ আকর্ষণ, বিশেষ করে গ্রীষ্মের সময় যখন প্রচুর মানুষের ভিড় হয়৷ যে কেউ চাইলে নৌকা ভাড়া করে তা নতুন এই লেকের বুকে চালাতে পারে শুনে লিউ পরিবারের সবাই খুবই আগ্রহী নৌকা চালাতে৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
নৌকা চালিয়ে বিনোদন
নৌকা চালাতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও পরে তা কাটিয়ে ওঠেন চু আর আইভি৷ ছোট ছোট দ্বীপ আর পানিতে হাঁসের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে লেকের শেষ সীমানায় পৌঁছে যান তাঁরা৷ ‘‘লেকে বেড়ানোর সময় সব কিছু ভুলে গিয়েছিলাম, খুবই উপভোগ করেছি, মনেই হয়নি যে আমরা বার্লিন শহরের ভেতর আছি’’, বলেন চু৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
‘ভিক্টরি কলাম’
একপাশে স্প্রে নদী আর অপর দিকে শত বছরের ঐতিহ্য বহনকারী ‘ভিক্টরি কলাম’ বা বিজয় স্তম্ভ– বার্লিনের এ এক মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য৷ এছাড়া, একবিংশ শতাব্দীর স্থাপত্ত্বশৈলীর এক উজ্জ্বল উদাহরণ ‘ভিক্টরি কলাম’-এর ওপরের সোনালি এই মূর্তিটি, যাকে বার্লিনবাসীরা আদর করে ডাকে ‘গোল্ডএলজে’ নামে৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
শহরের পাদদেশে
‘ভিক্টরি কলাম’ বা বিজয় স্তম্ভটি যে শুধু নীচ থেকে দেখতেই সুন্দর, তা নয়৷ এর ভেতরে ২৮৫টিরও বেশি ঘোরানো সিড়ি রয়েছে৷ সেখান থেকে গোলাকারভাবে বার্লিনের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
মনোরম দৃশ্য
‘ভিক্টরি কলাম’ থেকে ‘ফ্যান মাইল’ ধরে সোজা গেলেই দেখা পাওয়া যায় ‘রাইশটাগ’ বা সংসদ ভবন এবং ঐতিহ্যবাহী ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের৷ এই রাস্তাটার নাম ১৭ই জুন৷ কারণ ১৯৫৩ সালের ঐ দিনটিতে তৎকালীন পূর্ব জার্মানি প্রত্যক্ষ করেছিল একটি গণ-জাগরণ৷ এরপর ১৯৮৯ সালে, দুই জার্মানির মাঝে দেয়ালটি ভেঙে ফেলার পর, বার্লিনের এই ব্রান্ডেনবুর্গ ফটকটিই পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের পুনঃএকত্রীকরণের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
প্রাসাদ বেলেভ্যু
‘ভিক্টরি কলাম’ থেকে মাত্র কয়েকশো মিটার দূরে অবস্থিত বেলেভ্যু প্রাসাদ৷ এটা জার্মান প্রেসিডেন্টের ভবন৷ আইভি খুবই অবাক যে, কোনোরকম নিরাপত্তা কর্মীর প্রহরা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ভবনের এত কাছে যাওয়া যায়৷ আইভি বলেন, ‘‘এ দেশে যে রাজনীতি কতটা স্বচ্ছ, সেটাই এটা থেকেই বোঝা গেলো’’৷
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
‘পাবলিক’ পরিবহনে একদিন
আইভি বলেন, সাধারণ পরিবহন বা গণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, যেমন ট্রামে, বাসে করে ঘোরার সময় লক্ষ্য করেছি, ‘‘এ দেশে সময়জ্ঞান সম্পর্কে মানুষ কতটা সচেতন এবং সবই কতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন৷ সেভাবে টিকেটও চেক করার প্রয়োজন হচ্ছে না এখানে৷ সত্যি খুব সুন্দর সিস্টেম৷ আর তাই বোধহয় সকলে এই সিস্টেমকে বিশ্বাস করে, মেনে চলে৷’’
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
খানিকটা বিশ্রাম
এতক্ষণ বার্লিন ঘুরে দেখার পর সানফ্রান্সিসকো থেকে আসা তিনজনই বুঝলেন যে, একটু বিশ্রাম দরকার৷ তাই মিউজিয়াম দ্বীপের ঠিক পানির কাছে এসেই বসে পড়লেন তিনজন, বিশ্রাম নিতে৷
ছবি: Elisabeth Jahn
রিফ্রেশ উপসংহার
আট বছর বয়সি এটহান বললো, বার্লিন খুবই সুন্দর, আর ওর বাবা, মা মাথা নেড়ে ওর সাথে একমত প্রকাশ করলেন৷ শেষে আইভি জানালেন, ‘‘আমরা আজকের দিনটির অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরবো৷’’
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
বিদায় বার্লিন
মিউজিয়ামের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় গাওয়া এক শিল্পীর গাওয়া গান শুনছিলেন আর অবাক হচ্ছিলেন লিউ পরিবার৷ একদিনে তাঁরা অনেক কিছু দেখেছেন তা ঠিক, তারপরও আরো অনেক সুন্দর জায়াগা দেখা বাকি থেকে গেছে৷ তাছাড়া একদিনে এর চেয়ে বেশি দেখা যে সম্ভবও নয়৷ কে জানে, হয়ত আবারো আসবেন তাঁরা জার্মানিতে৷ হয়ত একবারেই একটা বন্ধুত্বের সূচনা হয়ে গেল!
ছবি: DW/Elisabeth Jahn
12 ছবি1 | 12
কিটস জানান, সাধারণ ফিল্ম ব্যবহার না করে এই পিনহোল ক্যামেরায় ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ব্ল্যাক পেপার'৷ আলোর উজ্জ্বলতার ওপর ভিত্তি করে এটি বিবর্ণ হতে থাকবে৷ এখনকার যে ভবনটি ১০০ বছর টিকে যাবে, ছবিতে ফুটে উঠবে তার স্পষ্ট আকৃতি৷ আর ১০০ বছরের মধ্যে ভবনটি ভেঙে ফেলা হবে ছবিতে থাকবে কেবল ভবনটির ভুতুরে ছায়া৷
এর আগে টানা ২৪ ঘণ্টা এক গ্যালারির একটি চেয়ারে বসে থাকার ছবি ধারণ করেছিলেন কিটস৷ বার্লিনের মতো কায়রো, মেক্সিকো সিটি, ফিনিক্স এবং অ্যারিজোনা শহরেও তিনি শত বছরের ক্যামেরা প্রকল্প চালু করতে চান৷
সব ঠিক থাকলে স্বেচ্ছাসেবীদের ক্যামেরায় পাওয়া আলোকচিত্র নিয়ে ২১১৪ সালের ১৬ই মে প্রদর্শনীর আয়োজন করবে বার্লিনের টিম টাইটানিক গ্যালারি কর্তৃপক্ষ৷ অবশ্য সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কোনো পরিকল্পনা জোনাথস কিটসের নেই৷