এবারের বিজয় দিবস বাঙালির কাছে নতুন রূপে ধরা দিয়েছে৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির ৩দিন পর এই বিজয় দিবস জাতিকে ভিন্ন মাত্রায় উজ্জীবিত করেছে৷ দিয়েছে নতুন সাহস৷
বিজ্ঞাপন
৪২ বছর ধরে জাতি যা চেয়েছে, তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে৷
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বাঙালি নিধন শুরু করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী৷ কিন্তু তার জবাব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আর মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে৷ ৯ মাসে চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ৷ ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য৷ কিন্তু এই স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামসসহ স্বাধীনতা বিরোধীরা ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে৷ হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের মত মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে৷ আর তাদের বিচারের আওতায় আনতে কয়েক দশক সময় লেগেছে৷ এর মধ্যে তারা রাজনৈতিকভাকেও প্রভাবশালী হয়েছে৷
কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে রেহাই পাওয়া যায়না৷ তাই ৪২ বছর অপেক্ষা করতে হলেও অন্তত একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে৷ ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারাগারে আছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা৷ তাই এবারের বিজয় দিবস নতুন আরেক বিজয় নিয়ে এসেছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানালেন বীরাঙ্গনা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী৷ তিনি বলেন, এখন থেকে আরেক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল৷ আর তা হল যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ৷ সব যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ থামবেনা৷ আর এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণ প্রজন্ম৷
কাদের মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা কাদের মোল্লাকে ইসলামপন্থিরা বলছেন ‘শহিদ৷’ এই শহিদের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলায় চলছে সহিংসতা৷ মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা নিয়ে আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
ইসলামপন্থিদের কাছে ‘শহিদ’
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা কাদের মোল্লাকে মনে করছেন একজন ‘শহিদ৷’ যিনি ‘‘ইসলামি আন্দোলন করার কারণে’’ ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন৷ এই ‘শহিদের’ মৃত্যুতে তাই শুক্রবার বিভিন্ন জেলায় গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে জামায়াত-শিবির৷ মোল্লার জন্য পাকিস্তানেও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ছবিটি সেখানকার৷
ছবি: Rizwan Tabassum/AFP/Getty Images
অনেকের কাছে ‘মিরপুরের কসাই’
তবে বাংলাদেশে অনেকেই কাদের মোল্লাকে মনে করেন ‘মিরপুরের কসাই,’ যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে৷ ফলে তাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দশটা এক মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মোল্লার পরিবার আক্রান্ত
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ঢাকার মগবাজারে তার পরিবারের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে৷ কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বাংলাদেশের একাধিক সংবাদপত্রের কাছে দাবি করেন, ‘‘কিছু ছাত্রলীগের নেতা পরিবারের সদস্যদের উপর হামলা চালায়৷’’ এসময় মোল্লা পরিবারের কয়েক সদস্যকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir Uz Zaman
ফরিদপুরে শেষ ঠিকানা
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
ফাঁসির রায় উদযাপন
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার শাহবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ৷ তাদের আন্দোলনের ফলে পরবর্তীতে আইন সংশোধন করে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়৷ সেই আপিলে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হয় মোল্লার৷ রায় কার্যকরের পর স্বাভাবিকভাবেই তাই শাহবাগে আনন্দ মিছিল দেখা গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্যাপক সহিংসতা
এদিকে, শুক্রবার বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ ব্যক্তি৷ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ করে, সেতু ভেঙে, গাড়ি পুড়িয়ে চালানো হচ্ছে নাশকতা৷ এমতাবস্থায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷
ছবি: DW/M. Mamun
তবে সাঈদীর মতো নয়
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শাহেদুল আনাম খান এবং শরীফ এ কাফি অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামায়াত তার সহিংস তত্পরতা নিয়ে কতদূর এগোতে পারবে তাও দেখার বিষয় আছে৷ কারণ সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর তারা যে মাত্রায় সহিংসতা চালাতে সক্ষম হয়েছিল এবার এখন পর্যন্ত তারা সেই মাত্রায় যেতে পারেনি৷ এর কারণ আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়েছে৷’’ তবে এই প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: DW/M. Mamun
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন৷ তবে মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷
ছবি: Reuters
মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না জার্মানি
বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷’’ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তরুণ সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্না বলেন, ‘‘সব যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত জাতি কলঙ্ক মুক্ত হবেনা৷ জানি তারা এখন রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী৷ তাদের পৃষ্ঠপোষকদের শক্তি আরো বেশি৷ তবুও ভয় পেলে চলবেনা৷ ভয়কে জয় করেই এগিয়ে যেতে হবে৷ কারণ যতদিন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি থাকবে, ততদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবেনা৷'' তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে যারাই সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি করবে, শেষ বিচারে তাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির পর জামায়াত আবার একাত্তরের ভূমিকায় নেমেছে৷ তারা মানুষ হত্যা করছে৷ করছে সন্ত্রাস৷ তাই তাদের দমনে শুধু সরকার নয়, সামাজিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে৷ গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ৷ একাত্তরে তারা পরাজিত হয়েছে৷ এবার তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে৷
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ৪২ বছর ধরে দেশের মানুষ একটি যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বিজয় দিবসের অপেক্ষা করেছে৷ সেই আশা কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে৷ তিনি আশা করেন, এর পরের বিজয় দিবসে সবার না হলেও প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি কার্যকর হবে৷ তিনি বলেন, জামায়াত যে একাত্তর সালের অবস্থান থেকে একটুও সরেনি, তার প্রমাণ তাদের এখনকার নির্মম সহিংসতা৷ তারা দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে৷ তাই তাদের দমন করতে হবে কঠোর ভাবে৷ তাদের দমনে সামরিক বাহিনী নামাতে হবে৷ তিনি অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান৷
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের কোনো ভাবেই এই বাংলায় ঠাঁই হবেনা৷ তারা ভেবেছিলেন ভয় দেখিয়ে বিচার বন্ধ করে দেবেন৷ কিন্তু ভয়কে জয় করে অন্তত একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বাংলাদেশে৷ বাকিরাও রেহাই পাবেনা৷ তিনি বলেন এই যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় কাজ করছে একটি বড় রাজনৈতিক দল৷ তারা এ নিয়ে কুট রাজনীতি করছে৷ কিন্তু সেই রাজনীতি শেষ পর্যন্ত সফল হবেনা বলে মনে করেন মুনতাসির মামুন৷ এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কোনো শক্তি টিকতে পারবেনা৷ ভোটের রাজনীতির সঙ্গে জামায়াতকে রক্ষার অপকৌশল সফল হবেনা৷