যুদ্ধ, নির্যাতন আর সংঘাতের কারণে ২০১৮ সালে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন দুই কোটি মানুষ৷ বিশ্বে বাড়িছাড়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত কোটির বেশি,অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা৷
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসকে সামনে রেখে জাতিসংঘে শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে আসে এমন তথ্য৷ বাড়িছাড়া মানুষের হিসাবে শরণার্থী, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী এবং দেশের অভ্যন্তের বাস্তুচ্যুতদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে৷
বুধবার জেনেভায় এক অনুষ্ঠানে ‘বৈশ্বিক প্রবণতা' শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়৷ অনুষ্ঠানে সংস্থার প্রধান ফিলিপো গ্র্যান্ডি বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৈশ্বিক প্রবণতা ভুল দিকেই যাচ্ছে৷ নতুন করে যুদ্ধ আর সংঘাত বাড়ছে এবং তৈরি করছে নতুন নতুন শরণার্থী৷ যারা আগের শরণার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, অথচ পূর্ববর্তীদের সমস্যার কোনো কিনারা হয়নি৷''
ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ২০১৮ সাল নাগাদ ৭ কোটি ৮ লাখ মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন৷ আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৮৫ লাখ৷ এক দশকে বাস্তুচ্যুত মানুষ বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৫ শতাংশ৷ ২০০৯ সালে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৩৩ লাখ৷
নিজের দেশেই পলাতক ইয়েমেনিরা
ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরুর আগে অল্পসংখ্যক মানুষ দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে পেরেছে৷ তবে বেশিরভাগই দেশের ভেতরেই লুকিয়ে আছেন৷ কিন্তু যারা শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে যেতে পেরেছে তারাও যে আশঙ্কামুক্ত বা নিরাপদে আছে, তা কিন্তু নয়৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
কোনো কিছুই যথেষ্ট নয়
ইয়েমেনে যুদ্ধ চলছে গত চার বছর ধরে৷ কবে এ যুদ্ধ শেষ হবে, তা কেউ জানেনা৷ ইতিমধ্যে প্রায় তিন লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে৷ কিন্তু দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশই নিজের দেশেই বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে আছে৷ হাজ্জাহ রাজ্যের আবস শহরে নির্মিত অস্থায়ী শিবিরের মতো কেন্দ্রগুলোতে ২০১৫ সাল থেকে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে৷এসব কেন্দ্রে পানি, খাবার, ওষুধপত্র কোনো কিছুই বাসিন্দার সংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট নয়৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট
২৪ মিলিয়ন অর্থাৎ সেদেশের জনসংখ্যার ৮০ ভাগ মানুষেরই জরুরিভাবে সাহায্যের প্রয়োজন৷ বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা৷ ইউনিসেফের মতে, ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে প্রতি দশ মিনিটে অন্তত একজন শিশু মারা যায়৷ সম্প্রতি জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত দাতাদের এক সম্মেলনে চলতি বছর ইয়েমেনের জন্য ২.৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তার অঙ্গীকার পাওয়া গেছে৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
আগে থেকেই সংকট ছিল
২০১৫ সালের অনেক আগে থেকেই ইয়েমেনে রাজনৈতিক সংকট চলছিল৷ সরকার, বিদ্রোহী ও জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার নানারকম দ্বন্দ্বের কারণে বহু মানুষকে পালিয়ে যেতে হয়৷ সে সময় শতকরা ৫০ ভাগ মানুষই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করতো৷ শতকরা ৭০ ভাগ মানুষেরই বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসা সেবার সুযোগ ছিলো না৷ তাছাড়া যুদ্ধের শুরুতেই সাংঘাতিকভাবে শরণার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
যেসব শিশুর ভবিষ্যত নেই
সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে অনেক পরিবার হাজ্জাহ প্রদেশে আসে, যেখানে মোট শরণার্থীদের এক-পঞ্চমাংশের বসবাস৷ তবে এই জায়গাটিও কিন্তু তাদের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয়, বিশেষ করে, ছোট মেয়েদের জন্য তো নয়ই৷ সাহায্য সংস্থা অক্সফাম-এর মতে, অনেক মা-বাবা বাধ্য হচ্ছে তাদের শিশু কন্যাদের বিয়ে দিতে, যাতে যৌতুকের টাকা দিয়ে তারা খাবার কিনতে পারেন৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
কলেরা সংক্রমণ
সংকট ব্যাপকতর হওয়ার আগে দেশটি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ খাবার আমদানি করতো৷ বর্তমানে বিমানবন্দরগুলোতে সংঘাত চলায় রাজধানী সানার বিমানবন্দর বন্ধ৷ ফলে দেশটিতে গুরুত্বপূর্ণ ত্রাণ সামগ্রী আসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ ১৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় নানা রোগ ছড়াচ্ছে৷ আর ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
অস্থায়ী বাড়িঘর
দেশের ভেতরে পালিয়ে থাকা শরণার্থীরা আবস শিবিরে অস্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করেছে৷ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর গত বছর শরণার্থীদের সাথে মিলিতভাবে ৪,৭০০টি পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরি করে৷ ঘর তৈরির প্রধান উপকরণগুলোর মধ্যে ছিলো মাটি, ঘাস এবং গরুর গোবর৷ বাড়িগুলো যাতে মানুষকে বৃষ্টি এবং গরম থেকে রক্ষা করতে পারে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে৷ এই অসহায় মানুষগুলো কি আবার কখনো নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরতে পারবে?
ছবি: Reuters/K. Abdullah
যুদ্ধ শুরুর জন্য তো শিশুরা দায়ী নয়
‘শিশুরা তো যুদ্ধ শুরু করেনি, কিন্তু তাদেরই দিতে হচ্ছে সর্বোচ্চ মূল্য’ - একথা বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস৷ সেভ দ্য চিলড্রেনের এক হিসেব বলছে, ২০১৫ সাল থেকে পাঁচ বছরের কমবয়সি ৮০,০০০ শিশু অনাহারে ছিলো৷ তাছাড়া এক লক্ষ বিশ হাজারেরও বেশি শিশু বর্তমানে ক্ষুধা হুমকির মুখে রয়েছে৷ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, খুবই অল্পসংখ্যক শিশুই ফুটবল খেলার সুযোগ পেয়ে থাকে৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
7 ছবি1 | 7
প্রতিবেদনের বলা হয়, মানুষের বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা ও সময় দুটোই বাড়ছে৷ প্রতি পাঁচজনে চারজনের বাড়িছাড়া থাকার সময় দাঁড়িয়েছে পাঁচ বছরের বেশি৷
ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদনে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশসহ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের প্রশংসা করা হয়৷ ‘‘উন্নয়নশীল অঞ্চল তুলনামূলকভাবে বেশি শরণার্থীর ভার বহন করছে৷ বাংলাদেশ, চাড, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, সাউথ সুদান, সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা ও ইয়েমেনের মতো কম উন্নত দেশ মোট ৬০ লাখ ৭০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে৷ যা মোট সংখ্যার শতকরা ৩৩ ভাগ,'' বলা হয় ওই প্রতিবেদনে৷
ম্যার্কেলের প্রশংসা
শরণার্থীদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেওয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জার্মান সরকারের প্রশংসা করেন ইউএনএইচসিআর প্রধান গ্র্যান্ডি৷
‘‘আমি সাধারণত প্রশংসা ও সমালোচনাকে খুব বেশি পছন্দ করি না৷ তবে শরণার্থীদের ক্ষেত্রে জার্মানি যা করেছে, সেটার জন্য প্রশংসা করছি,'' বলেন তিনি৷
গ্র্যান্ডি বলেন, মাইগ্রেশন পলিসির জন্য রাজনৈতিকভাবে ‘কঠিন মূল্য' দিয়েছেন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ তবে, এই ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ তাঁর কর্মকাণ্ডকে ‘আরো সাহসী' করে তুলেছে৷