এক উপাচার্য, ৪৬ অভিযোগ
৫ মার্চ ২০২১তিনি নিজেই নকশা পরিবর্তন করে নির্মাণব্যয় ১৩০ ভাগ বাড়িয়েছেন বলেও অভিযোগ৷
এখন শুরু হচ্ছে তদন্ত৷ আরো ৪৫টি অভিযোগেরও তদন্ত হবে ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে৷
এই পরিস্থিতিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে৷ তবে তিনি পদে আছেন এখনো৷ সংবাদ সম্মেলন করে তিনি দাবি করেছেন, তিনি দিনে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ২২ ঘন্টা কাজ করেন৷ তিনি দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে একটি চক্র কাজ করছে৷
শুক্রবার তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী এসবের পিছনে আছেন৷ তিনি একটি মহলকে নাচাচ্ছেন৷’’
অন্যদিকে ইউজিসির তদন্ত কমিটির সদস্য ফেরদৌস জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তার বিরুদ্ধে আমরা ফৌজদারী মামলারও সুপারিশ করেছি৷ তিনি একটি প্রকল্পের মোট তিনটি স্থাপনার নকশা নিজের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করে খরচ ১৩০ ভাগ বাড়িয়েছেন৷ আগের পরামর্শক বাদ দিয়ে নিজের ভাগ্নেকে প্রকল্পের পরামর্শক বানিয়েছেন৷ হেন কোনো নয়-ছয় নেই যা তিনি এই প্রকল্প নিয়ে করেননি৷ এখন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷’’
এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় চার বছর আগে ৷ তার মধ্যে আছে ১০ তলা শেখ হাসিনা ছাত্রী হল, ড. ওয়াজেদ মিয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ১০ তলা ভবন, ‘স্বাধীনতা স্মারক’ নামে একটি শহীদ মিনার ও দুইটি ল্যাব৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের কাজ উদ্বোধন করেছিলেন৷ ২০১৮ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু তারপর উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ একনেকের কোনো অনুমোদন ছাড়াই নকশা পরিবর্তন ও পরামর্শক বাদ দিয়ে তার ভগ্নেকে পরামর্শক নিয়োগ করে কাজ চালান৷ ফেরদৌস জামান জানান, ‘‘মূল প্রকল্প ছিল ৯৭ কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকার৷ তিনি এটার ব্যয় বাড়িয়ে করেছেন ২১৩ কোটি টাকা৷’’
তবে প্রধান পরিবর্তন হলো টয়লেটের সংখ্যা বাড়িয়ে দুই গুণ করা৷ ফলে যা হয়েছে তাতে নির্মানের পর ভবন ধসে পড়তে পারতো বলে তদন্ত কমিটি মনে করে৷
তদন্ত কমিটি সরেজমিন গিয়ে কাজের অবস্থা দেখে এই প্রতিবেদন দিয়েছে৷ তবে উপাচার্য অন্তত দুইবার তদন্ত কমিটির তদন্ত বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ আছে৷
এদিকে নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে আরো ৪৫ অভিযোগের তদন্ত করতে ইউজিসির একটি তদন্ত দল আগামী ১৪ মার্চ বেরোবিতে যাচ্ছে৷ জানা গেছে, এই অভিযোগগুলো প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতির৷
তার মধ্যে রয়েছে নিয়োগ, আপ্যায়ন ভাতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে ঢাকায় থেকে সৈয়দপুর হয়ে রংপুর বিমানে আসা-যাওয়া করে ক্লাস নেয়া, বিপুল খরচে ঢাকায় সিন্ডিকেট বৈঠক করা, ঢাকায় লিয়াঁজো অফিস করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় নিজের জন্য চাল-ডাল কেনা, নতুন শিক্ষকদের নির্ধারিত ড্রেস তার দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করা, কর্মচারি ও শিক্ষকদের নামে গাড়ির বিল তোলা, নিজের মা-সহ নিজের পছন্দমতো লোকজনকে নিয়োগ কমিটিতে রাখা, পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দেয়া, নিয়ম ভেঙে পছন্দের শিক্ষকদের বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান করা, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানিয়ে টাকা আত্মসাৎ, রংপুরে না থেকেও উপস্থিত দেখানো, ঢাকায় বসে অনলাইনে নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া, তার পক্ষে কাজ করার জন্য অনৈতিক সুবিধা দিয়ে একটি গ্রুপ গঠন প্রভৃতি৷
অভিযোগ উঠেছে, উপাচার্য চার বছরে ১৪৬০ দিনের মধ্যে রংপুরে উপস্থিত থেকে অফিস করেছেন মাত্র ১১৮ দিন৷ গত বছরে অফিস করেছেন মাত্র এক দিন৷ ঢাকায় অবস্থান করে তিনি তিন বছরে নানা ধরনের বিল নিয়েছেন ৪৫ লাখ টাকার৷ তিনি উপাচার্য ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯টি দায়িত্বে ছিলেন৷ এসব দায়িত্বের বিপরীতে আবার আলাদা আলাদা ভাতা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে৷ এছাড়া অপ্যায়ন ভাতার নামে প্রচুর অর্থ তুলেছেন৷
বেরোবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সহকারি অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, ‘‘২০১৯ সাল থেকে আমরা এইসব অভিযোগ দিয়ে আসছি৷ আমাদের কাছে সব তথ্য-প্রমাণ আছে৷ আমাদের দেয়া ৪৫টি অভিযোগের তদন্ত করতে ১৪ মার্চ ইউজিসির একটি টিম আসবে বলে আমাদের চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে৷’’
বেরোবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷ তিনি দাবি করেন, আগের ভবনের আগের নকশা ছিল ত্রুটিপূর্ণ, তাই তিনি ঠিক করেছেন৷ সেখানে তিনি কোনো অনিয়ম করেননি বলেও দাবি তার৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে না থেকে বিল ভাতা ও নানা অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘যে ৪৫ টি অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে তা আমার বিরুদ্ধে এক গ্রুপ শিক্ষকের কাজ৷ এর কোনো ভিত্তি নেই৷’’
তার কথা, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী উপচার্যদের বরারবই উপেক্ষা করেন৷ তিনি আস্কারা দিয়েই এসব কাজ করাচ্ছেন৷’’
সেক্ষেত্রে মানহানির মামলা করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমিও সরকারের ভিসি, তিনিও সরকারের শিক্ষামন্ত্রী৷ তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করলে ভালো দেখাবে না৷ আমি আমার ডিগনিটি রক্ষা করে সংবাদ সম্মেলন করে দেশের মানুষকে সবকিছু জানিয়েছি৷ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাহস করে সংবাদ সম্মেলন করার নজির হাতিহাসে আছে? আমি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছি৷’’
তবে ফেরদৌস জামান বলেন, ‘‘আমরা স্বাধীনভাবে তদন্ত করেছি৷ কেউ আমাদের প্রভাবিত করেনি৷’’