এক ব্যক্তির ‘ভুলে’ ভ্যাকসিন নিয়ে আরো সংকটে বাংলাদেশ
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৪ জুন ২০২১
বাংলাদেশে ভ্যাকসিন সংকট কাটানোর নানা উদ্যোগের মধ্যেই এবার চীনের ভ্যাকসিন নিয়ে জটিলতার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ চীনা ভ্যাকসিনের দাম গোপন রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় এই জটিলতা বলে জানা গেছে৷
বাংলাদেশকেও শেষ পর্যন্ত ১৫ ডলারেই চীনা টিকা কিনতে হতে পারে৷ছবি: Chaiwat Subprasom/SOPA Images /ZumaWire/dpa/picture alliance
বিজ্ঞাপন
গত ২৭ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আতিরিক্ত সচিব শাহিদা আক্তার সংবাদ সম্মেলনে সিনোফার্মের টিকার প্রতি ডোজ ১০ ডলার দামে কেনার চুক্তির কথা জানান৷ তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনবে৷ মোট দাম পড়বে ১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মূদ্রায় এক হাজার ২৬৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা৷
কিন্তু চীনের সাথে ভ্যাকসিন চুক্তির শর্ত ছিল দাম প্রকাশ করা যাবে না৷ তাই অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আক্তার দাম প্রকাশ করে দেয়ায় বিপাকে পড়েছে চীন৷ বাংলাদেশের জন্য ধার্য করা দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা৷ কারণ, তারা চীনের কাছ থেকে টিকা পাচ্ছে ১৫ ডলারে৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীন এরই মধ্যে তাদের অস্বস্তির কথা জানিয়েছে৷ ফলে বাংলাদেশকেও শেষ পর্যন্ত ১৫ ডলারেই চীনা টিকা কিনতে হতে পারে৷
এই ঘটনায় এরই মধ্যে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আক্তারকে ওএসডি করা হয়েছে৷ চুক্তির সাথে জড়িত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "আমরা এমনকি মন্ত্রীকেও চুক্তির শর্ত মেনে দাম জানাইনি৷ এই কর্মকর্তা কেন জানালেন সেটা নিয়ে ভাবার বিষয় আছে৷”
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
This browser does not support the audio element.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, "সারা বিশ্বে ভ্যাকসিন নিয়ে নানা ধরনের তৎপরতা আছে৷ কেউ ভ্যাকসিন মজুত করছে, বিক্রি করছে না৷ কারুর ভ্যাকসিনের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও অন্য দেশকে দিচ্ছে না৷ আমাদের ভ্যাকাসিন কূটনীতি বুঝতে হবে৷ যেখানে দাম গোপন করার চুক্তি আছে, সেখানে সেই দাম একজন কর্মকর্তা কীভাবে প্রকাশ করলেন৷ তাকে কি আগে ব্রিফ করা হয়নি! তিনি কি চুক্তির শর্ত জানেন না? হয়তো না জেনে করতে পারেন৷ আবার উদ্দেশ্যমূলভাবেও করতে পারেন৷ আমি জানি না৷ কিন্তু আমাদের ক্ষতি হয়ে গেল৷”
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, " ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের কাজ যে অপরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে তার একটা বড় প্রমাণ এটা৷”
বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ আনুষ্ঠানিকভবে কথা বলতে রাজি হননি৷ তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন," দাম প্রকাশ করায় চীন এখন বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে পড়েছে৷ আমরা চীনকে বলেছি, এরকম আর হবে না৷”
বাংলাদেশ এখনো রাশিয়ার সঙ্গে ভাকসিনের চুক্তি করেনি৷ আলাপ-আলোচনা চলছে৷ সেখান থেকেও এক কোটি ভ্যাকসিন আনার পরিকল্পনা আছে সরকারের৷
বাংলাদেশে এখন অক্সফোর্ডের টিকা দেয়া বন্ধ আছে৷ টিকা আছে মাত্র দুই লাখ ছয় হাজার ৫৫ ডোজ৷ সবাইকে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়াও বাকি আছে৷
করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অক্সফোর্ডের টিকা দেয়া হয়েছে মোট ৯৯ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪৫ ডোজ৷ এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন, আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩০ জন৷ প্রথম ডোজ অক্সফোর্ডের টিকা নেয়া সবাইকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাচেছ না৷ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটও চুক্তি অনুযায়ী এখন টিকা দিতে পারছে না৷ অন্য কোনো দেশ থেকেও এই টিকা সংগ্রহের কোনো অগ্রগতির খবর নেই৷
ফাইজারের এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা ঢাকায় এসেছে চার দিন আগে৷ এক সপ্তাহের মধ্যে এই টিকা দেয়া শুরু হবে৷ যারা আগে নিবন্ধন করেছেন, তারাই এই টিকা পাবেন৷ দুই ডোজ করে ৫০ লাখ মানুষকে এই টিকা দেয়া যাবে৷ এই টিকা দিয়েছে কোভ্যাক্স৷ তাদের কাছ থেকে এক কোটি ডোজ টিকা কম দামে পাওয়ার কথা আছে৷
ডা. লেনিন চৌধুরী
This browser does not support the audio element.
চীন থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া পাঁচ লাখ টিকার ট্রায়াল শুরু হয়েছে৷ তবে এই টিকার অগ্রাধিকার আছে৷ বাংলাদেশে চীনা নাগরিক, চীনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্র, যারা এখন দেশে আছেন, তারা আগে পাচ্ছেন৷ এই টিকা গত ২৪ ঘন্টায় দেয়া হয়েছে ২০ জনকে৷ আর ২৫ মে থেকে এ পর্যন্ত দেয়া হয়েছে দুই হাজার ১৬২ জনকে৷ চীনের আরো ৯ লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয়ার কথা আছে৷
বৃহস্পতিবার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেয়া হবে৷ আর প্রতিমাসে ২৫ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার পরিকল্পনা আছে৷ লেনিন চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন, " যদি প্রতিমাসে ২৫ লাখ ডোজ দেয়া হয় তাহলে ১৪-১৫ কোটি মানুষকে টিকা দিতে কত দিন লাগবে?”
আর অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, চীন প্রতিদিন তার দেশের ১৯ মিলিয়ন মানুষকে টিকা দিচ্ছে৷ আমরা কত জনকে দিতে পারছি? এখন তো বলতে গেলে কাউকে টিকা দেয়াই হচেছ না৷ আমাদের আরো দক্ষতা দেখাতে হবে৷ ভ্যাকসিন কূটনীতি আরো জোরদার করতে হবে৷ সবাই নিজের জন্য করছে৷ সেটা মাথায় রাখতে হবে৷ আমাদের সতর্ক এবং দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করতে হবে৷ দায়িত্বহীন হলে যা অর্জন তা-ও আবার ফসকে যাবে৷ মনে রাখতে হবে, টিকা আমাদের পেতেই হবে৷”
চীনের সিনোফার্মের টিকাদান কার্যক্রম শুরু
দেশে করোনা সংক্রমণ রোধে চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদান শুরু হয়েছে। এ পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাবেন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, মেডিকেল টেকনোলজি কলেজের শিক্ষার্থী এবং চীনের নাগরিকরা।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
প্রাথমিকভাবে চারটি মেডিকেলে টিকাদান
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভির টিকাদান কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এবং মুগদা মেডিকেল কলেজে চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য মেডিকেল কলেজে এই কার্যক্রম শুরু হবে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদান
দেশে স্বাস্থ্যসেবায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য টিকা দেয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্টদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে উপহারের মোট পাঁচ লাখ ডোজের মধ্যে দুই লাখের মতো ডোজ দেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের। বাকি টিকা চীনের অনুরোধের ভিত্তিতে পাবেন চীনা নাগরিকেরা।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন
মঙ্গলবার সকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেকের উপস্থিতিতে ৩ জন শিক্ষার্থীকে টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের ২৫৭ জন শিক্ষার্থীসহ মোট এক হাজার জনকে প্রথম দিনে টিকা দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
‘টিকা নিয়ে শুরুতে যে ভয়টা ছিল, সেটি কেটে গেছে‘
প্রথম স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে টিকা নেওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেলের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী অনন্যা সালাম সমতা জানান, “আমরা অনেকদিন যাবত ক্লাস, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছি না। তাছাড়া ফেব্রুয়ারিতে টিকাদানের শুরুতে যে ভয়টা ছিল, এখন সেটা আর নেই। আমি মনে করি, করোনা প্রতিরোধে টিকার কোনো বিকল্প নেই৷”
ছবি: Rashed Mortuza/DW
নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য মেডিকেলে টিকাদান কার্যক্রমের প্রথমদিনে জরুরি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টিকাদান বুথের পাশাপাশি টিকা পরবর্তী পর্যবেক্ষণ কক্ষ এবং টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে যেন সঙ্গে সঙ্গে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সবখানেই।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
চলছে অক্সফোর্ডের টিকাদান কার্যক্রমও
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভির টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধনের পাশাপাশি পৃথক টিকাবুথে দেখা গেল ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্তব্যরত একজন নার্স বলেন, ‘‘যতদিন আমাদের এ টিকার মজুত আছে, ততদিন এ কার্যক্রম চলবে।’’
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকাটি প্রায় ৮০% কার্যকর
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ভিত্তিতে চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকার অনুমোদন দেওয়ার পর পাকিস্তান, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এ টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ টিকার কার্যকারিতা ৮৬ শতাংশের মতো পাওয়া গেছে। তবে গবেষণা বলছে, স্বাভাবিকভাবে এ টিকা গড়ে ৮০ ভাগ কার্যকর।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
‘আমাদের এ সুযোগ লুফে নেওয়া উচিত’
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদানের প্রথমদিনে টিকা নিতে আসা ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী নিয়ামুল হক বলেন, “সরকার আমাদের জন্য বিনামূল্যে এ টিকার ব্যবস্থা করেছেন, আমার মনে হয় এ সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই আমাদের তা লুফে নেওয়া উচিত। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটির অনুমোদন দিয়েছে, এর পরে এ টিকা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না।”
ছবি: Rashed Mortuza/DW
এক সপ্তাহের বিরতি
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদান কার্যক্রম চালুর প্রথমদিনে হাজার শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে ১ সপ্তাহ বিরতি দেওয়া হবে। টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না দিলে পরবর্তীতে বাকিদেরও এই টিকাদানে অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকা আনার সর্বোচ্চ চেষ্টার দাবি
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন, “ভারত তিন কোটি টিকার ডোজ দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের নিজেদের দেশের সংকটের কারণে আমরা মাত্র এক কোটি ডোজ টিকা পেয়েছি। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় চীন এবং রাশিয়া থেকে টিকা আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। খুব শীঘ্রই আমরা কাঙ্খিত ফল পাবো বলে আশা করছি।“
ছবি: Rashed Mortuza/DW
চীনের টিকা সর্বসাধারণের জন্য নয়
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকার উপহারের যে পাঁচ লাখ ডোজের চালান চীন সরকার বাংলাদেশকে দিয়েছে, আপাতত সাধারণ মানুষ এ টিকাদান কার্যক্রমের বাইরে থাকবেন বলে জানানো হয়েছে। চীনের সাথে চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর যখন নিয়মিতভাবে টিকার চালান আসবে, তখন সর্বসাধারণকে এই টিকা প্রয়োগের আওতায় আনা হবে বলে জানান দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা।