ভোটার প্রতি দু-দুটো ভোট! এমন ‘আজব' ব্যবস্থা থাকলেও জার্মানিতে ভোটগ্রহণ সাধারণত শান্তিপূর্ণ হয়৷ ফলাফল নিয়েও তেমন উত্তেজনা দেখা যায় না৷ কারচুপির সুযোগ নেই বললেই চলে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে নির্বাচনের দিনে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের আশেপাশে বিভিন্ন দলের পতাকা, দলীয় কর্মীদের জটলা, শক্তি প্রদর্শন, ভোটারদের উপর প্রচ্ছন্ন চাপের কোনো চিহ্ন নেই৷ ঠিক কোথায় যে ভোট হচ্ছে, চট করে সেটাও চোখে পড়বে না৷ কয়েক সপ্তাহ আগেই প্রত্যেক তালিকাভুক্ত ভোটার লেটারবক্সে কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়ে যান৷ সেটি সঙ্গে নিয়ে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছতে হয়৷ সঙ্গে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা চাই৷ সেই দুটি যাচাই করার পর হাতে ব্যালট পেপার আসে৷ ঘেরাটোপের মধ্যে বসে পছন্দের প্রার্থী ও দলের নামের পাশে কলম দিয়ে ক্রস চিহ্ন দিয়ে সেটি নির্ধারিত বাক্সে ঢুকিয়ে দিলেই হলো৷
ভোটের দিন কোনো কারণে ব্যস্ত থাকলে আগেভাগেই ব্যালট সংগ্রহ করে খামে করে ভোট দেবার সুযোগও রয়েছে৷ বিদেশে বসবাসরত জার্মান নাগরিকরাও ভোটার তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্গত করার আবেদন করে এভাবে ভোট দিতে পারেন৷
জার্মানির নির্বাচন ও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশ-ভারতের তুলনায় অনেকটাই আলাদা৷ ইউরোপের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভোটারদের সংখ্যা ছয় কোটি ১০ লাখের মতো৷ প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার কারণে এবং তাদের বাসস্থানের পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের নাম-ঠিকানা নথিভুক্ত করা আবশ্যিক হওয়ায় নির্বাচন কর্তৃপক্ষের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়৷ জার্মানিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার নেই৷ ভোটগ্রহণের শেষে হাতে করে কাগজের ব্যালট গোনা হয়৷ তাই ফলাফল সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাষ পেতে একটু সময় লেগে যায়৷
ফেডারেল কাঠামোর কারণে জার্মানির সঙ্গে ভারতের কিছু তুলনা করা যেতে পারে৷ দুই দেশেই জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়৷ তবে জার্মান নাগরিকরা সেইসঙ্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনেও জনপ্রতিনিধি বেছে নেন৷ বাংলাদেশ বা ভারতের মতো জার্মানিতেও পৌর স্তরে নির্বাচন হয়৷ তবে জার্মানির জাতীয় নির্বাচনের একটি বৈশিষ্ট্য সত্যি অভিনব৷ একটি নয়, ভোটারদের দু-দুটি করে ভোট দিতে হয়৷ একটি ভোট পছন্দের প্রার্থীর জন্য, অন্যটি পছন্দের দলের জন্য৷ সংসদের আসনগুলিও সেভাবে বিভক্ত৷ যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনি সরাসরি সংসদে নির্বাচিত হন৷ দ্বিতীয় ভোটের শক্তির ভিত্তিতে দলগুলি নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন পায় এবং পছন্দমতো প্রার্থীদের সংসদে পাঠাতে পারে৷ তবে কমপক্ষে ৫ শতাংশ ভোট না পেলে কোনো দলই সংসদে স্থান পায় না৷ ফলে সংসদসহ নির্বাচিত ব্যক্তিদের অন্যান্য মঞ্চে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা সীমিত থাকে৷ জার্মানির ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের প্রেক্ষাপটে সংসদে অসংখ্য দলের উপস্থিতি এড়াতে এমন নিয়ম চালু করা হয়েছিল৷
ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষা
আগামী এক ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন৷ সংসদ নির্বাচন ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কে এটিকে নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন অনেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
তারিখ নিয়ে নাটক
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের জন্য ২২ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন৷ নির্বাচনের তারিখ ছিল ৩০ জানুয়ারি৷ কিন্তু সেদিন সরস্বতী পূজা থাকায় আপত্তি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে৷ শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও৷ প্রথমে অনড় থাকলেও শেষ পর্যন্ত গত ২১ জানুয়ারি নতুন তারিখ ঘোষণা করে কমিশন৷ পরিবর্তীত তারিখ অনুযায়ী নির্বাচন হবে এক ফেব্রুয়ারি৷
ছবি: DW/A. Mahmud Ove
উত্তরে ভোট
উত্তরে সাধারণ ওয়ার্ড সংখ্যা মোট ৫৪টি৷ সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৮টি৷ মোট ভোটকেন্দ্র রয়েছে এক হাজার ৩১৮টি, যাতে রয়েছে সাত হাজার ৮৪৬ টি কক্ষ৷ মোট ভোটার রয়েছেন ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন৷ এর মধ্যে ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৭ জন পুরুষ আর ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৭০৬ জন নারী৷
ছবি: bdnews24.com
দক্ষিণে ভোট
দক্ষিণে মোট সাধারণ ওয়ার্ড রয়েছে ৭৫টি৷ আছে ২৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড৷ এক হাজার ১৫০ টি ভোটকেন্দ্রে মোট কক্ষ ছয় হাজার ৫৮৮টি৷ পুরুষ ভোটার রয়েছেন ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪১ জন আর নারী ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৩ জন৷ মোট ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন৷
ছবি: bdnews24.com
আচরণবিধি
মনোনয়নপত্র জমার দিন থেকে প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে৷ রিটার্নিং কর্মকর্তারা কড়াকড়ির কথা বললও অনেকটা ‘নির্বিকার’ ছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
ইভিএম বিতর্ক
প্রধান নির্বাচন কমিশন শুরুতে বলেছিলেন, যদি সব দল না চায় তাহলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে না৷ তবে পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয়, সব কেন্দ্রেই ভোট হবে ইভিএমে৷ যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন প্রার্থী আপত্তি জানিয়ে আসছে৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
সিইসির আশ্বাস
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘‘নির্বাচনের কালচারটা অনেকদিন ধরেই এরকম নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল৷ নির্বাচনের কালচার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি৷ ইভিএম যদি দাঁড় করাতে পারি, তাহলে কারো ভোট কেউ দিতে পারবে না৷’’
ছবি: DW/M. M. Rahman
পোস্টার
নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকাকে এখন পোস্টারের নগরী বলা যায়৷ কিন্তু এসব পোস্টারের অধিকাংশই মোড়ানো ক্ষতিকর পলিথিনে৷ যা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট৷ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় হাই কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বুধবার ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় লেমিনেটেড পোস্টার ছাপা ও প্রদর্শন বন্ধের এ নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করে৷
ছবি: Imago/MD Mehedi Hasan
প্রচারে হামলা
বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথের প্রচারে হামলার ঘটনা ঘটে৷ গাবতলীর পর্বতার কলাবাজার এলাকায় মঙ্গলবার জনসংযোগে নামলে তিনি ও তার কর্মীরা হামলার শিকার হন৷ তাবিথ অভিযোগ করেছেন প্রতিপক্ষ আতিকুলের লোকজনই হামলায় জড়িত৷ জবাবে আতিকুল তার এই মন্তব্যকে ছেলেখেলা হিসেবে অভিহিত করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
তথ্য গোপনের অভিযোগ
উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের বিরুদ্ধে হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ ওঠে৷ সুইডেনভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল নেত্র নিউজের এক প্রতিবেদনে তাবিথ সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি এনএফএম এনার্জি (সিঙ্গাপুর) পিটিই লিমিটেডের মালিকানায় রয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে৷ হলফনামায় ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার দেখালেও এই প্রতিষ্ঠানের নাম তিনি উল্লেখ করেননি৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
নৌকা এগিয়ে চলবে: আতিক
ঢাকা উত্তরে আতিকুল ইসলাম মেয়র প্রার্থী হিসেবে বলেন, ‘‘আমরা আশা করছি, এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে৷ … নৌকার কোনো ব্যাক গিয়ার নাই৷ নৌকা এগিয়ে চলবে৷’’
ছবি: Sazzad Hossain
ঢাকাবাসীর জন্য নবসূচনা: তাপস
আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘‘আমি আশা করি, ঢাকাবাসীর জন্য একটি নবসূচনা করতে পারব৷ … আমরা সব সময় চেষ্টা করব নির্বাচন যেন সুষ্ঠু এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়৷ ঢাকাবাসী যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই নির্বাচনে ভোট দেয়৷’’
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকব: তাবিথ
উত্তরে বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘‘একটা বিতর্কিত নির্বাচন অতীতে হয়েছে৷ আর বিতর্ক না বাড়িয়ে ইভিএমে নির্বাচন করা যাবে না৷ … আমরা অত্যন্ত সিরিয়াস৷ নির্বাচনে যত সমস্যাই আসুক, আমরা সবগুলোকে অতিক্রম করে চেষ্টা করব, এগিয়ে যেতে৷ শেষ পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকব৷’’
ছবি: bdnews24.com
নির্বাচন কমিশনের দ্বিতীয় সুযোগ: ইশরাক
দক্ষিণের বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন বলেন, ‘‘এই নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকাবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছে৷ ক্রান্তিকাল চলছে, কোনো গণতন্ত্র নেই, ভোটের অধিকার নেই৷ সবাইকে নিয়ে আমরা এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করব৷ …আস্থা অর্জনে নির্বাচন কমিশনের কাছে এটি দ্বিতীয় সুযোগ৷’’
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
13 ছবি1 | 13
এমন ‘যান্ত্রিকতা-সর্বস্ব' ব্যবস্থা সত্ত্বেও জার্মানির নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনার অভাব নেই৷ তবে পথেঘাটে অরাজকতা সৃষ্টি করে বা জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করে সেই উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না৷ সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশন, জনসভায় সেই সব বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা চলে৷ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও দলীয় রাজনীতির মঞ্চ হয়ে উঠেছে৷ এক ইউটিউব তারকা সরাসরি চ্যান্সেলরের সাক্ষাৎকার নিয়ে তরুণ প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি তুলে ধরেছিলেন৷
সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের অনেক প্রান্তের মতো জার্মানিতেও মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলি কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে৷ চরম দক্ষিণপন্থি এএফডি দল সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ ফলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক চলছে৷ অনেকে বলছেন, ‘নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ' হিসেবে উদারপন্থি মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ না করলে এমন সংকীর্ণ ভাবধারার দলগুলির শক্তিবৃদ্ধি হয়৷ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে ঘরে বসে না থেকে ভোট দেবার আবেদন বাড়ছে৷