ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, তবুও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছেন আলেক্সেই নাভালনি৷ রাশিয়ার এই অজ্ঞাত ব্লগার ক্রেমলিনের বৃহত্তম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চলেছেন৷ এবার তিনি মস্কোর মেয়র হতে চান৷
বিজ্ঞাপন
একটি লাল স্টিমরোলার মস্কোর টেলিভিশন টাওয়ারটাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে৷ আলেক্সেই নাভালনির ওয়েবসাইট ‘‘দোব্রাইয়া মাশিনা প্রাভদি'' (‘ভালো সত্যের মেশিন') খুললে প্রথম ছবিটাই হলো ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সত্যের জয়ের এই প্রতীকী ছবি৷ এই ওয়েবসাইট এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য ওয়েবসাইটে নাভালনি রাশিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির সমালোচনা করে থাকেন৷
রুশ ‘‘লাইভজার্নাল''-এ তাঁর ব্লগ পড়েন লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ সরকারি খরচে দামি-দামি গাড়ি আনান যে সব স্থানীয় নেতা, তাদের থেকে শুরু করে খনিজ তেল অথবা গ্যাসের কোম্পানিগুলির ফন্দিফিকির অবধি – সব কেলেঙ্কারিই ফাঁস করেন নাভালনি – এবং বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে করে আসছেন৷ সেটা আবার এমন একটি দেশে, যে দেশের নাগরিকরা দুর্নীতিকে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে করে৷
নাভালনি তাদের কেলেঙ্কারি ফাঁস করার পর ক্রেমলিনের নিজস্ব দল ‘‘ঐক্যবদ্ধ রাশিয়া''-র একাধিক সাংসদকে তাদের আসন ছাড়তে হয়েছে৷ তাঁর ‘‘দুর্নীতি বিরোধী ফাউন্ডেশন'' প্রতিষ্ঠা করে নাভালনি যে সব ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের চক্ষুশূল হয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনও আছেন৷ জার্মানির ‘‘দি সাইট'' সাপ্তাহিক নাভলনিকে ‘‘পুটিনের বৃহত্তম প্রতিদ্বন্দ্বী'' বলে অভিহিত করেছে৷
ব্লগার থেকে রাজনীতিক
আগামী ৮ সেপ্টেম্বর মস্কোয় মধ্যকালীন মেয়র নির্বাচন৷ নাভালনি সেই নির্বাচনে প্রার্থী৷ এটাই হবে রাজনীতিক হিসেবে তাঁর প্রথম পরীক্ষা – যদিও তাঁর অংশগ্রহণ এ যাবৎ নিশ্চিত নয়৷ গত জুলাই মাসে একটি বিতর্কিত মামলায় তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়: কিরোভ শহরের একটি কাঠগুদামের উপদেষ্টা থাকাকালীন নাভালনি নাকি জুয়াচুরি করেছেন বলে অভিযোগ৷ কিন্তু পরদিনই রায় কার্যকর না হওয়া অবধি তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়, আদালতের আদেশে৷
স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্টের নির্দেশে নাকি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, বলে সে সময় নাভালনি একটি বেতার সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন৷ ২০১১ সাল থেকেই পুটিন বিরোধী হিসেবে নাভালনির নাম ছড়াতে থাকে, কেননা তিনিই প্রথম শাসকদল ‘‘ঐক্যবদ্ধ রাশিয়া''-কে ‘‘চোর-জোচ্চোরের দল'' বলে অভিহিত করেন৷ নাভালনির দেওয়া নামটা আজ পর্যন্ত খুবই জনপ্রিয়৷ সর্বাধুনিক সংসদীয় এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটে কারচুপির খবরাখবর দেওয়ার যে আহ্বান জানানো হয়, তার পিছনেও ছিলেন নাভালনি৷ হাজার হাজর মানুষ সেই ডাকে সাড়া দেন৷
তথ্যকল্যাণী, শিক্ষক ডটকমসহ বিজয়ী যারা
ডয়চে ভেলের সেরা অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড দ্য বব্স-এর ২০১৩ সালের বিজয়ীদের নিয়ে বিশেষ ছবিঘর এটি৷ এই আসরে বাংলাদেশের তথ্যকল্যাণী প্রকল্প জিতেছে ‘জুরি অ্যাওয়ার্ড’, শিক্ষক ডট কম পেয়েছে ‘ইউজার প্রাইজ’৷
ছবি: D.net/Amirul Rajiv
সেরা ব্লগ: লি চেনপেং
চীনা লেখক ও সাংবাদিক লি চেনপেং সেরা ব্লগ পুরস্কার জিতে নিলেন৷ ‘গোটা বিশ্ব জানে’ নামের একটি বই লিখে চীনা কর্তৃপক্ষের রোষের মুখে পড়েছেন তিনি৷ বইয়ের প্রচারের সময় মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল তাঁকে৷ প্রতিবাদে তিনি নিজের লেখা থেকে অংশবিশেষ পাঠের সময়ে পরে নিলেন একটি অক্সিজেন মুখোশ৷ ‘নীরব পাঠ’-এর সেই অনুষ্ঠানে তাঁর পরনে ছিল একটি টি-শার্ট, যাতে লেখা ‘আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসি’৷
ছবি: Li Ruihe
সেরা উদ্ভাবন: ফ্রিওয়াইবো ডট কম
‘ফ্রিওয়াইবো ডট কম’ নামের মাইক্রোব্লগিং সাইট চীনের সরকারের সেন্সরশিপ প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা দিচ্ছে৷ এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে চীনের অন্যতম প্রধান সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ‘সিনাওইবো ডটকম’-এর সেন্সরমুক্ত সংস্করণে ঢুঁ মারা যায়৷ ফলে ব্যবহারকারীরা জানতে পারেন, কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিবেদন মুছে ফেলে৷
ছবি: freeweibo.com
সেরা উদ্ভাবন: শিক্ষক ডটকম
বাংলাভাষার পক্ষে শিক্ষক ডটকম এই বিভাগে ‘ইউজার প্রাইজ’ জয় করেছে৷ মূলত বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বাংলায় অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে শিক্ষক ডট কম৷ এই সাইটটি গড়ে তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ রাগিব হাসান৷ ডয়চে ভেলের প্রতিযোগিতা চলাকালে শিক্ষক ডটকমের পক্ষে ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশ৷
সেরা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম: ৪৭৫
মরক্কোর তরুণ প্রজন্মের এক উদ্যোগের নাম ‘৪৭৫’৷ মরক্কোর আইনের ৪৭৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনো ধর্ষক ধর্ষিতাকে বিয়ে করলেই শাস্তি এড়াতে পারে৷ এই ধারার কারণে ২০১২ সালে ১৬ বছরের কিশোরী আমিনা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল৷ সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ‘৪৭৫’ নামের একটি চলচ্চিত্র এবং ফেসবুক ও ফ্লিকার-এ সোশ্যাল মিডিয়া অভিযান৷
ছবি: Naji Tbel
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স: ফাবি কুয়াসি
প্রতি বছরের মতো এবারও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এমন এক প্রতিযোগীকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যিনি বা যাঁরা মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন৷ এ বছর সেই পুরস্কার পাচ্ছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ টোগো-র মানবাধিকার কর্মী ফাবি কুয়াসি৷ দেশের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় পুলিশ সাংবাদিকদের উপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছে, ফাবি সেই সব ঘটনা তুলে ধরছেন তাঁর ওয়েবসাইটে৷
ছবি: fabbikouassi.wordpress.com
গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম পুরস্কার: তথ্যকল্যাণী
২০১৩ সালে ডয়চে ভেলে আয়োজিত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের বিষয় হলো ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ’৷ বব্স প্রতিযোগিতায়ও বিষয়টিকে আলাদা বিভাগের মর্যাদা দিচ্ছে৷ বাংলাদেশের ‘তথ্যকল্যাণী’ প্রকল্প এবার এই বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে নিয়েছে৷ জুরিমণ্ডলীর কাছে এটা এমন এক ‘বৈপ্লবিক প্রকল্প যার মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাংলাদেশের অতি দরিদ্র মানুষের নাগালে চলে আসছে৷’
ছবি: D.net/Amirul Rajiv
সবচেয়ে সৃজনশীল ও মৌলিক উদ্যোগ: আমি ও আমার ছায়া
ইন্টারনেটে আমাদের গতিবিধির চিহ্ন কতটা থেকে যায়? এই প্রশ্ন নিয়েই কাজ করছে ‘মি অ্যান্ড মাই শ্যাডো’ বা ‘আমি ও আমার ছায়া’৷ ইন্টারনেটে কীভাবে নিরাপদে বিচরণ করা যায় ও তা করতে কী কী জানতে হয়, খেলাচ্ছলে ব্রাউজারের সেটিং বদলানোর মতো সেই সব পথ বাতলে দিচ্ছে এই ওয়েবসাইট৷ এই উদ্যোগের পিছনে রয়েছে ‘ট্যাকটিক্যাল টেকনোলজি কালেক্টিভ’ নামের এক আন্তর্জাতিক সংগঠন৷
ছবি: myshadow.org
সেরা বাংলা ব্লগ: শৈলী
সেরা বাংলা ব্লগ বিভাগে ইউজার প্রাইজ জয় করেছে শৈলী ব্লগ৷ এই জয়ের পর ডয়চে ভেলেকে জানানো প্রতিক্রিয়ায় শৈলী ব্লগের কর্ণধার রিপন কুমার দে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘এটা শুধু আমি না, সকল শৈলার এবং শৈলীর পাঠকদের জন্য খুব আনন্দের খবর৷ শৈলার এবং পাঠকদের ভালোবাসা ছাড়া এই স্বীকৃতি কোনোভাবেই আসত না৷ তাই তাদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা৷ সকলের ভালোবাসা নিয়ে শৈলী আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে এটাই আমার প্রত্যাশা৷’’
ছবি: http://shoily.com/
বাংলা সেরা অনুসরণযোগ্য: সাইফ সামির
‘বাংলা: সেরা অনুসরণযোগ্য’ বিভাগে বিজয়ী সাইফ সামির৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকার কর্তৃক লেখক-ব্লগার-সাংবাদিকদের ওপর যে দমন-নিপীড়ন চালানো হচ্ছে ডয়চে ভেলের মাধ্যমে আমি তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি৷ একজন লেখককে তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশের জন্য আটক করা হবে, রিমান্ডে নেয়া হবে – এটা কি ধরনের কথা?’’
ছবি: Twitter
9 ছবি1 | 9
‘রাশিয়ার একমাত্র সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনীতিক'
লম্বা, বিরাট, খোড়োচুল, চোখে পড়ার মতো চেহারা – এভাবেই মার্কিন সাংবাদিক জুলিয়া ইওফ নাভালনিকে বর্ণনা করেছেন৷ জুলিয়া মার্কিন মুলুকের ‘‘নিউ ইয়র্কার'' এবং ‘‘ফরেন পলিসি'' ম্যাগাজিন দু'টির জন্য মস্কো থেকে লেখেন৷ নাভালনির বিষয়েও তিনি অনেক লিখেছেন৷ জুলিয়া ডিডাব্লিউকে বলেন: ‘‘(নাভালনি) হলেন আজকের রাশিয়ার একমাত্র সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনীতিক৷'' নাভালনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে এসেছেন এবং তাদের দুঃখকষ্ট বুঝতে করতে পারেন৷
নাভালনি প্রথাগত অর্থে রাজনীতিক নন, তাঁর পিছনে কোনো দলও নেই৷ মস্কোয় আইন এবং শেয়ারবাজার নিয়ে পড়াশুনা করেছেন৷ পরে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন কাটিয়েছেন৷ ২০০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত নাভালনি রাশিয়ার উদারপন্থি ‘‘ইয়াবলোকো'' দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু কিছু বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়৷
কৌশল ও উচ্চাশা
সে আমলে নাভালনি নিজেকে বর্ণনা করেছিলেন একজন ‘‘যুক্তিসম্পন্ন জাতীয়তাবাদী'' হিসেবে৷ এমনকি তিনি তথাকথিত ‘‘রুশি রূপকথা''-তেও অংশগ্রহণ করেছিলেন: চরম দক্ষিণপন্থিরা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ার জন্য এই সব অনুষ্ঠানের আয়োজন করত৷ নাভালনি পরে এই সব মন্তব্য ও কার্যকলাপ বর্জন করেছেন, কিন্তু এ-ও যোগ করেছেন যে, রাশিয়ার মতো বহুজাতিক দেশে অভিবাসনের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় তিনি দোষের কিছু দেখেন না৷ দৃশ্যত রুশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশের মনোভাবও তাই, যে কারণে নাভালনি এই পন্থায় তাদের সমর্থন যোগাড় করার চেষ্টা করেছিলেন, বলে জুলিয়া ইওফে-এর ধারণা৷
ইন্টারনেটের বাইরে বিরোধী নেতা হিসেবে নাভালনির প্রথম আবির্ভাব ২০১২ সালের শীতে অধিকতর গণতন্ত্রের দাবিতে পথ-আন্দোলনে৷ নাভালনি বিক্ষোভের আয়োজন করেন এবং একাধিকবার গ্রেপ্তার হন৷ ২০১২ সালে বিরোধীপক্ষের সমন্বয় পরিষদের নির্বাচনে নাভালনি সর্বাধিক ভোট পান৷ তবে নাভালনির দৃষ্টি আরো দূরে এবং আরো উঁচুতে:
‘‘আমি প্রেসিডেন্ট হবো এবং দেশের জীবনধারা বদলে দেব,'' বলে নাভালনি ঘোষণা করেন এ বছরের বসন্তে৷ তবে তার আগে তাঁকে সরকারি কৌঁসুলির আনা নানা মামলার ধাক্কা সামলাতে হবে৷