গড়ে কেবল এক লাখ টাকা খরচ করলেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট মিলছে রোহিঙ্গাদের৷ তাদের সহায়তা করছে বাংলাদেশেরই দালাল চক্র৷ এখন সফটওয়্যারের সঙ্গে ইন্টারভিউ মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের সনাক্ত করার কাজ করছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর৷
বিজ্ঞাপন
গত সপ্তাহে টেকনাফের হ্নীলা জাদিমুরা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা নূর মোহাম্মদের বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র- এনআইডি ছিলো৷ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী তিন রোহিঙ্গা যুবক আটক হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার নানা কাহিনি ও কৌশলের কথা জানা যাচ্ছে৷
ওই তিন যুববেকর মধ্যে দু'জন হলেন মিয়ানমারে মংডু জেলার অংচি গ্রামের আলী আহমদের ছেলে মো. ইউসুফ ও মো. মুসা, আরেকজন মিয়ানমারের একই এলাকার মো. আজিজ৷ তারা গত ডিসেম্বর নোয়াখালীর সেনবাগের ঠিকানা ব্যবহার করে এনআইডি সংগ্রহ করেন, পরবর্তীতে নোয়াখালীর আঞ্চলিক পার্সপোর্ট অফিস থেকে সংগ্রহ করেন পাসপোর্ট৷
শুধু পাসপোর্ট নিয়ে বলে থাকেননি তারা৷ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিলেন, সেই পাসপোর্ট দিয়ে তুরস্কের ভিসার আবেদন করতে৷ চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ‘‘তাদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড এবং পাসপোর্ট দালালরা করে দিয়েছে৷ দালালরাই তাদের ওই কাজের সময় নোয়াখালী নিয়ে কয়েকদিন রেখেছিল৷ তিন জন দালালের নাম তারা জানিয়েছে৷ তারা ওই তিন দালালকে তিনটি পাসপোর্টের জন্য যথাক্রমে এক লাখ পাঁচ হাজার , ৯০ হাজার এবং ৬০ হাজার টাকা দিয়েছে৷ দুটি পাসপোর্ট করা হয় ডিসেম্বরে এবং একটি জানুয়ারি মাসে৷''
সারাদেশেই রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করে দেয়ার জন্য এইরকম আরো অনেক দালাল চক্র আছে বলেও জানান জানান মোস্তাফিজুর রহমান৷
ভাসান চর কি রোহিঙ্গাদের জন্য স্বর্গ?
প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি গড়ে তুলেছে বাংলাদেশ৷ তবে দ্বীপটি ঘূর্ণিঝড়প্রবণ হওয়ায় তা রোহিঙ্গাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: DW/A. Islam
মূল ভূখন্ড থেকে দূরে
বিশ বছরেরও কম সময় আগে ভাসান চর জেগে উঠেছিল৷ বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে এটি ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত৷ সেখানে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে যেতে চাইছে বাংলাদেশ৷
ছবি: DW/A. Islam
যাওয়া সহজ নয়
ভাসান চরে যেতে সাধারণ মানুষের উপযোগী কোনো বাহন নেই৷ ঐ দ্বীপের কয়েকজন দোকানি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বর্ষার সময় সাগর উত্তাল থাকায় সাধারণ মাছ ধরার নৌকায় করে ভাসান চরে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়৷
ছবি: DW/A. Islam
তিন মিটার উঁচু বাঁধ
উঁচু ঢেউ ও বন্যার হাত থেকে ভাসান চরকে বাঁচাতে সরকার ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও তিন মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ করেছে৷ এক দোকানি জানালেন, মাসে দু’বার বাঁধের বাইরের দিকে থাকা বাজার এক মিটার পর্যন্ত ডুবে যায়৷
ছবি: DW/A. Islam
একইরকম ভবন
রোহিঙ্গাদের জন্য ১,৪৪০টি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে৷ প্রতিটি ভবনে ১৬টি ঘর রয়েছে৷ ১২x১৪ ফুটের একেকটি ঘরে একটি পরিবারের অন্তত চার জন সদস্যকে থাকতে হবে৷ ঘূর্ণিঝড়ের সময় ব্যবহারের জন্য ১২০টি চারতলা আশ্রয়কেন্দ্রও নির্মাণ করা হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
সৌরশক্তি
ভবনগুলোর জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সেগুলোতে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে৷ এছাড়া প্রয়োজনের সময় ব্যবহারের জন্য দুটি ডিজেল জেনারেটর ও বিশাল এক মাঠে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে৷ খাবার পানির জন্য রয়েছে নলকূপ৷ আরও আছে বৃষ্টির পানি থেকে খাবার পানি পাওয়ার ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/A. Islam
ক্ষয় রোধের ব্যবস্থা
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবিতে ২০০২ সালে প্রথম এই দ্বীপের অস্তিত্বের কথা জানা যায়৷ এরপর কয়েকবার এটি স্থান পরিবর্তন করেছে৷ ভূমিক্ষয় ঠেকাতে সরকার চরটিতে তিন স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে৷
ছবি: DW/A. Islam
দ্বীপটি কি বাসযোগ্য?
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, দ্বীপটি এখনও বসবাসের উপযোগী নয়৷ তবে আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত মনে করছেন, বাঁধের উচ্চতা যদি সাড়ে ছয় থেকে সাত মিটার করা যায় তাহলে দ্বীপটি বসবাসযোগ্য হতে পারে৷ তবে ভাসান চরে ফসল ফলানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW/A. Islam
রোহিঙ্গাদের ভয়
কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গারা ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাঁদের ভাসান চরে নিয়ে যাওয়া হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাঁরা মারা যেতে পারেন৷ তবে প্রকল্পের প্রধান স্থপতি আহমেদ মুক্তা বলেন, ‘‘চরটি রোহিঙ্গাদের জন্য এক স্বর্গ৷’’
ছবি: DW/A. Islam
রোহিঙ্গারা কি ভাসান চরে যাবেন?
কয়েকটি সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে যে, নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে৷ তবে রোহিঙ্গারা সেখানে না গেলে গৃহহীন বাংলাদেশিদের ভবিষ্যতে সেখানে নিয়ে যাওয়া হতে পারে৷
ছবি: DW/A. Islam
9 ছবি1 | 9
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসেও গত এক মাসে আরো চারজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন৷ বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবু সাঈদ জানান, ‘‘আমরা মূলত ইন্টারভিউ করে ওই চারজনকে শনাক্ত করে পুলিশে দিয়েছি৷ কিছু কৌশগত প্রশ্ন করলেই তারা ধরা পড়ে যায়৷ আবার ভাষার কারণেও ধরা পড়ে৷ যেমন বাংলাদেশি নাগরিক হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সে বলতে পারবে৷ তবে দালালরা আমাদের কৌশল জেনে যায়৷ তাই আমাদেরও কৌশল পরিবর্তন করতে হয়৷ কিন্তু এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধনের কাগজ তারা কিভাবে জোগাড় করে এটাই প্রশ্ন৷''
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে কক্সবাজারের উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের ডয়চে ভেলেকে এই কৌশলের একটি ধারণা দিয়েছিলেন৷
মোস্তাফিজুর রহমান
‘‘ধরুন, ময়মনসিংহে এক নারীর নাম মরিয়ম৷ তিনি বাংলাদেশেরই নাগরিক৷ তাঁর ন্যাশনাল আইডি কার্ড জোগাড় করে নাম, ঠিকানা, পিতা বা স্বামীর নাম সবই ঠিক রাখা হয়৷ এই একটি ডকুমেন্ট ধরেই আরো প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট পাওয়া যায়৷ এরপর ওই নামেই আরেক রোহিঙ্গা নারীর জন্য পাসপোর্টের আবেদন করা হয়৷''
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সোহায়েল হোসেন খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরাই তো রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করছি৷ এ পর্যন্ত পাসপোর্টের আবেদন করতে আসা কয়েকশ' রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করে পুলিশে দিয়েছি৷ তবে তারা আবেদনের আগে এনআইডি, জন্ম নিবন্ধন কিভাবে পায় তা তো আমরা বলতে পারব না৷ তারাতো পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টও পায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা আমাদের সব পাসপোর্ট অফিসকে সতর্ক করেছি৷ এখন আমরা সফটওয়ার ব্যবহার করছি ভুয়া আবেদন ধরার জন্য৷ আর ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমেও শনাক্ত করছি৷ বিশেষ করে আমাদের কাছে দেয়া ফিঙ্গার প্রিন্ট, রোহিঙ্গাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং এনআইডির ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলিয়ে দেখছি৷''
মো. সোহায়েল হোসেন খান
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট আমরা এনআইডি প্রকল্পকে দিয়েছি৷ তারপরও তো রোহিঙ্গারা এনআইডি পাচ্ছে৷''
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের যে তালিকা, ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে, তার বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছেন৷
চট্টগ্রাম এলাকায় অন্তত ৭৩টি সন্দেহজনক এনআইডি দেখা গেছে সার্ভারে৷ এ নিয়ে ঢাকায় এই প্রকল্পের দায়িত্বশীল কাউকে কথা বলার জন্য পাওয়া যায়নি৷ তবে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনির হোসাইন খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা খতিয়ে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে ঢাকা থেকে৷ তার একজন সদস্য উপ সচিব খুরশিদ আলম এরই মধ্যে চট্টগ্রামে আছেন তদন্তের জন্য৷''
রোহিঙ্গারা কিভাবে এনআইডি পায় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এটা তদন্ত শেষে বলা যাবে৷''
গত বছরের এপ্রিলে তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে অবৈধ উপায়ে পাসপোর্ট সংগ্রহের অভিযোগে কমপক্ষে চারশ' রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ আটক হয়েছেন৷
কোন দেশে কত রোহিঙ্গা
১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মা রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে নিজভূমে অধিকার পাননি রোহিঙ্গা মুসলমানরা৷ সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ১৯৭০ থেকে দেশ ছাড়তে শুরু করেন তারা, এ পর্যন্ত ১৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Yasin
বাংলাদেশ
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন রোহিঙ্গারা; এই সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যে পৌঁছে যায় সাত লাখে৷ আর আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা৷
ছবি: Reuters
পাকিস্তান
দুই লাখের মত রোহিঙ্গা বর্তমানে পাকিস্তানে বসবাস করছেন৷ ১৯৪২ সালে বর্মায় সামরিক অভিযানের পর তারা পাকিস্তানে যেতে শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Yasin
থাইল্যান্ড
মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথ হিসেবে রোহিঙ্গারা থ্যাইল্যান্ডকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করত৷ এই দেশটিতে এখন এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Pruksarak
মালয়েশিয়া
ইউএনএইচসিআর এর হিসেব অনুযায়ী ৫৯ হাজার রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় রয়েছেন৷ দেশটি জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী না হওয়ার রোহিঙ্গাদের শরণার্থীদের স্বীকৃতি দেয়নি৷ এখন তারা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/C. Archambault
ভারত
মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে গিয়ে বসবাস করছে৷ সীমান্তপথে ভারতে অনুপ্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গ, জম্মু ও আসামে বসবাস করছেন তারা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Qadri
যুক্তরাষ্ট্র
এশিয়ার দেশগুলোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ হাজারের মত রোহিঙ্গা বসবাস করছে৷ মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার এই জনগোষ্ঠীকে ২০০২ সাল থেকে সেখানে থাকতে দেওয়া হচ্ছে, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিকাগোতে বসবাস করে৷
ছবি: DW/A. Islam
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় ১১ হাজার ৯৪১ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী রয়েছে৷ মালয়েশিয়ার মতো ইন্দোনেশিয়াও জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী না হওয়ায় তারা প্রথমে রোহিঙ্গাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়৷ পরে এদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
নেপাল
নেপালে এখন ২০০ জন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন৷ বাংলাদেশে ও ভারত হয়ে এরা নেপালে চলে যায়৷