বাংলাদেশে করোনার মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুতের হিড়িক পড়েছে৷ সেই সুযোগে ১০ হাজার টাকার সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ হাজার টাকায়৷ কিন্তু ঘরে সিলিন্ডার ব্যবহারে বিপদের শঙ্কাও আছে৷
বিজ্ঞাপন
কয়েকদিন আগে স্ত্রীর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে বিপদে পড়েন ঢাকার ফয়সাল আহমেদ৷ কারণ তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে চাননি তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালগুলোর অবস্থা খারাপ৷ সেখানে রোগী নিয়ে যেতে ভরসা পাইনি৷'' সংক্রমণের ভয়ে তাই বাসায় রেখেই স্ত্রীর চিকিৎসা করানো শ্রেয় মনে করেছেন তিনি৷ ‘‘কিন্তু সেখানেও অক্সিজেনের সংকট আছে৷ তাই ঘরেই সিলিন্ডার কিনে এনেছি,'' বলেন ফয়সাল৷
সিলিন্ডারের বাজারের বিষয়ে আগেই তার ধারণা ছিল৷ তারপরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে৷ অন্তত ১৬ জন বিক্রেতার কাছে ধরনাদিয়েছেন তিনি৷ শেষ পর্যন্ত ২৭ হাজার টাকা খরচ করেছেন, কিন্তু পছন্দের ব্র্যান্ডেরটি কিনতে পারেননি৷ ফয়সাল বলেন, ‘‘করোনা শুরুর সময় সবচেয়ে ভালো একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ছিলো ১০-১২ হাজার টাকা৷ আর রিফিল করতে লাগত তিনশ টাকা৷ কিন্তু এখন সেই সিলিন্ডারের দাম ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা৷ রিফিল এক থেকে তিন হাজার টাকা৷’’
আবু তাহের
একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাথে ট্রলি, ফ্লো মিটার, ক্যানোলা ও মাস্ক দেয়া হয়৷ সাধারণত বাড়িতে ব্যবহারের জন্য একটি সিলিন্ডারে এক হাজার ৪০০ লিটারের (১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার) অক্সিজেন থাকে৷ ব্যবহার করা যায় এক হাজার ২০০ মিনিট৷
আগে সিলিন্ডার ভাড়া পাওয়া গেলেও এখন আর তা পাওয়া যাচ্ছে না৷ তার উপর এক প্রতিষ্ঠান থেকে কিনলে আরেক প্রতিষ্ঠান ‘রিফিলও’ করতে চায় না৷ তার বদলে প্রতিটি সিলিন্ডার বিক্রি করে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকার ব্যবসায় বেশি মনোযোগ বিক্রেতাদের৷
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘লিনডে’ কোম্পানির উৎপাদিত সিলিন্ডারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি৷ এছাড়াও চীন ও তাইওয়ান থেকে আনা সিলিন্ডারও বিক্রি হয়৷ তেজগাঁও কলোনী বাজার এলাকার লিনডের পরিবেশক আবু তাহের৷ তিনি দাবি করেন, সরবরাহ না থাকায় কয়েকদিন ধরে কোম্পানিটির সিলিন্ডার দিতে পারছেন না৷ তবে তিনি ৩৫ হাজার টাকায় এক ধরনের ‘প্রাইভেট’ সিলিন্ডার বিক্রি করেন৷ আর দুই-একদিন পরে লিনডের সিলিন্ডার দিতে পারবেন, কিন্তু দাম পড়বে ৪৫ হাজার টাকা৷ দাম এত বেশি কেন? জানতে চাইলে বলেন, ‘‘এখন চাহিদা অনেক বেশি৷ আর সিলিন্ডারগুলো আমদানি করা হয়৷ চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করা যাচ্ছে না৷’’
ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার
পরিবেশকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন তারা যে সংখ্যক সিলিন্ডার পান তার চেয়ে চাহিদা চার-পাঁচ গুণ বেশি৷ প্রয়োজন না থাকলেও অনেকে আতঙ্কে ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত করছেন বলে জানান তারা৷ তাদের কেউ কেউ বিক্রির আগে তাই নিশ্চিত হতে চান গ্রাহকের আসলেই প্রয়োজন আছে কিনা৷ তেমনই একজন পরিবেশক শাকিল আহমেদ৷ তার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ইমারজেন্সি অক্সিজেন হোম সার্ভিস'৷ শাকিল বলেন, ‘‘প্রয়োজন না থাকার পরও অনেকেই সিলিন্ডার কিনে বাসায় রেখে দিচ্ছেন৷ তিন-চারটাও কিনে রাখছেন কেউ কেউ৷ তাই আমরা চেষ্টা করছি যাদের আসলেই প্রয়োজন তাদের কাছে বিক্রি করতে৷’’
অক্সিজেন সিলিন্ডার গ্রাহকের বাসায় গিয়ে সরবরাহ করেন অনেক বিক্রেতা৷ কিন্তু এভাবে ঘরে সিলিন্ডার ব্যবহারের ঝুঁকিও আছে৷ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সিলিন্ডারের ব্যবহার এমনকি মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার৷ তিনি বলেন, ‘‘এর ফলে যাদের প্রয়োজন নাই তারা বাসায় মজুত করছেন৷ যাদের প্রয়োজন তারা পাচ্ছেন না৷ আর রোগীর জন্য অক্সিজেন ব্যবহার কোনো যেকারো কাজ না৷ এর প্রবাহ নির্ধারণ করতে হয়৷ কমাতে হয়, বাড়াতে হয়৷ কতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন তা নির্ধারণ করতে হয়৷ এটা না করে রোগীকে অক্সিজেন দেয়া বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে৷ চোখ ও শ্বাসতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷’’
যেভাবে মানবদেহে আক্রমণ করে করোনা ভাইরাস
শুধু ফুসফুস নয় বরং করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মানুষের হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু, মস্তিষ্ক, কিডনি, ধমনি এবং ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ ঘটতে পারে মৃত্যু৷
ছবি: picture-alliance/dpa/imageBROKER
হৃৎপিণ্ড
বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে করোনা ভাইরাসের কারণে হৃৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ থাকা ব্যক্তিদের কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর হার অনেক বেশি৷ কিন্তু যাদের হৃদরোগ নেই তারাও আক্রান্তের পর হৃৎপিণ্ডের পেশির কোষ মারা যায়৷ তবে ভাইরাসের আক্রমণে কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাকি ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের তৈরি রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/imageBROKER
ফুসফুস
কোভিড-১৯ এ ফুসফুস সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ ফুসফুস জটিলতাতেই বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ যারা সুস্থ হয়ে উঠেন তাদের ফুসফুসও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ কারণ, সুস্থদের ফুসফুসে ঘোলাটে সাদা মেঘের মত বস্তু দেখতে পেয়েছেন চীনের গবেষকরা৷ যেটা ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Gollnow
শ্বাসকষ্ট
ফুসফুসের এই অবস্থা হলে রক্তে অক্সিজেন পৌঁছাতে বাধা পাবে৷ ফুসফুস আড়ষ্ট হয়ে পড়বে এবং শ্বাসপ্রশ্বাস ছোট ও দ্রুত গতির হবে৷ ফলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট এবং শুকনো কফ দেখা দেবে৷ ফুসফুসের কোষ একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা আর ঠিক হয় না৷
ছবি: Reuters/D. Siddiqui
স্নায়ুতন্ত্র
কোভিড-১৯ আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের স্বাদ এবং ঘ্রাণ শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে৷ সংক্রমণের একেবারে শুরুর দিকেই এ উপসর্গ দেখা দেয়৷ সাধারণ ফ্লুর ক্ষেত্রে যেটা রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে হয়৷ ঘ্রাণ শক্তি বা অলফ্যাক্টরি নার্ভ অনুনাসিক ঝিল্লি থেকে খুলির হাড়ের মাধ্যমে সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছায়৷
ছবি: Colourbox
ধমনি
জুরিখের একদল প্যাথলোজিস্ট করোনায় মারা যাওয়া কয়েকজনের ময়নাতদন্ত করে দেখেছেন কারো কারো রক্তনালি এবং লাসিকা গ্রন্থি ফুলে গিয়ে সেগুলোতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ যার ফলে হৃৎপিণ্ড, কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এক সঙ্গে বিকল হয়ে মানুষ মারা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Burgi
মস্তিষ্ক
মার্স এবং সার্স ভাইরাসের সময়ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা গেছে৷ নতুন করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও আক্রান্ত অনেকের খিচুনি এবং মৃগীরোগের চিকিৎসা দিতে হয়েছে৷ এ কারণেই হয়তো আক্রান্ত অনেকের মধ্যে কোনো পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়৷ তবে করোনা ভাইরাসের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ার বিষয়ে এখনো পরিষ্কার কিছু জানা যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Prefeitura Manaus/I. Anne
কিডনি
কোভিড-১৯ আক্রান্ত অনেকের শরীরে মারাত্মক নিউমোনিয়ার লক্ষণ থাকে এবং ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়৷ ফুসফুসে জমা তরল বের করতে ওই রোগীদের যে ওষুধ দেওয়া হয় তাতে তাদের পুরো শরীর থেকে তরল বের হয়ে যায়৷ ফলে কিডনিতে রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং কিডনি ঠিকমত কাজ করতে না পেরে অকেজো হয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
রক্তপিণ্ড
কোভিড-১৯ এ গুরুতর আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে অনেক সময় রক্ত জমাট বেধে রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায়৷ এটার কারণেও অনেক সময় কিডনিতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে এ অঙ্গটি অকেজো হয়ে পড়ে৷
করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষের ত্বকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ অনেক দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ত্বকে ক্ষত বা র্যাশ সৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে৷ রক্ত জমাট বাধার কারণে ত্বকের নিচে এ ধরনের র্যাশ দেখা যায়৷