1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কেন ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয় বাংলাদেশিরা?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৬ মে ২০১৯

ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় আবার আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম৷ অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নতির দিকে গেলেও কেন এখনো মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যেতে চায়? কেন তারা সব বিক্রি করে উন্নত জীবনের খোঁজে ছুটছেন?

দুর্ঘটনা থেকে উদ্ধার পাওয়াদের কয়েকজনছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Jelassi

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বৈরাগীর বাজার এলাকার ইলিয়াস আলীর পাঁচ ছেলের মধ্যে চতুর্থ খোকন আহমেদ৷ তাঁর বাড়িতে এখন শোকের মাতম৷ বৃহস্পতিবার ফোনে যখন তাঁর ভাই লিটনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনও তাঁর মায়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল৷ তাঁরা এখন নিশ্চিত যে, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা গেছেন খোকন৷ তাই লাশের খোঁজ জানতে চান৷ জানতে চান কোনো লাশ পাওয়া গেছে কিনা৷ শেষ পর্যন্ত যদি খোকনের লাশটি পাওয়া যায় সেই আশায় আছেন তাঁরা৷

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার টিউনিসিয়ার সাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় বাংলাদেশের ৩৯ জন নাগরিক এখনো নিখোঁজ আছেন৷ এক জনের লাশ পাওয়া গেছে৷ আর ১৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে৷ তাঁরা লিবিয়া থেকে দালালের মাধ্যমে ছোট নৌকায় করে ইটালির পথে রওয়ানা হয়েছিলেন৷

যাঁরা নিখোঁজ, তাঁদেরই একজন বিশ্বনাথের খোকন৷ তাঁর ভাই জহিরুল ইসলাম লিটন ডয়চে ভেলেকে জানান, তাঁদের প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম রফিকই তাঁর ভাইকে লিবিয়া হয়ে ইটালি যেতে উদ্বুদ্ধ করেন৷ রফিকের ছেলে সাদেক লিবিয়ায় থাকে৷ এর আগে সে আরো অনেক লোক নিয়েছে৷ বলেছে, লিবিয়ার সেনাবাহিনীর সাথে তার খাতির৷ যুদ্ধ জাহাজে করে লিবিয়া থেকে ইটালি পাঠানো হবে৷ আর এজন্য মোট আট লাখ টাকা দিয়েছেন তাঁরা৷ লিটন বলেন, ‘‘আমরা ৫ ভাই৷ বাবার একটি দোকান আছে৷ আমরা জানতাম সমস্যা হতে পারে৷ তারপরও রফিক এলাকার লোক হওয়ায় তাকে বিশ্বাস করি৷ আর আমরা ভাইরা সবাই বেকার৷ তাই  কিছু একটা হবে এই আশায় বাবা খোকনকে পাঠাতে রাজি হয়৷ সে ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্র ছিল৷ বাবা আমাদের দোকানটি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ওই আট লাখ টাকা জোগাড় করেছিলেন৷ এখন তো সব শেষ৷’’

বাবা দোকান বন্ধক রেখে আট লাখ টাকা জোগাড় করেছিলেন: লিটন

This browser does not support the audio element.

তিনি জানান, ‘‘পাসপোর্ট করার পর গত ডিসেম্বরে আমার ভাইকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় নেয়া হয়৷ সেখানে চার মাস আমার ভাইকে আরো অনেকের সাখে একটি কক্ষে আটক রাখা হয়৷ ঠিকমতো খাবারও দেয়া হয়নি৷ গত ৭ মে আমার ভাইয়ের সাথে আমার টেলিফোনে শেষ কথা হয়৷ তখন আমাদের জানায়, ইটালি পাঠানো হবে৷ তারপর আর তাঁর সাথে কথা হয়নি৷ পরে আমরা জানতে পারি, সে নৌকায় ইটালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হয়েছে৷ পুলিশ ও প্রশাসন থেকে আমাদের বাড়িতে এসে খবর জানিয়েছে৷ কিন্তু রফিকের ছেলেকে ফোন করলে সে আমাদের বলে, ‘তোমার ভাই ইটালি আছে৷’’ যাঁরা নিখোঁজ আাছেন, তাঁদের বড় একটি অংশ বৃহত্তর সিলেটের৷

ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলোর সংগঠন ফ্রন্টেক্স-এর হিসাব অনুযায়ী গত এক দশকে ইউরোপের দেশগুলো থেকে ৫২ হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন রুট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছে৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩২ হাজার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢোকার চেষ্টা করেছে৷ ব্র্যাকের অভিবাসন বিষয়ক কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সব এলাকার লোক নয়, বিশেষ করে শরিয়তপুর, মাদারীপুর, নোয়াখালী, সিলেট এই অঞ্চলগুলোর লোকজনই অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করে৷ ইটালিতে তাঁদের অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকেন৷ তাই তাঁরা মনে করেন, তাঁদের বোঝানো হয় কোনোভাবে একবার যেতে পারলেই আর কোনো সমস্যা নেই৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এটা শুরু হয় ২০১০ সালে, যখন লিবিয়ায় যুদ্ধাবস্থা ছিল৷ তখন সেখানে ৫০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে ৩৭ হাজার বাংলাদেশিকে দেশে নিয়ে আসা হয়৷ বাকি যাঁরা থাকেন, তাঁরা নানাভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যান৷ আর সিরিয়া যুদ্ধের সময় আরো অনেক দেশের লোক ইউরোপমুখী হয়৷

শরিয়তপুর, মাদারীপুর, নোয়াখালী, সিলেট অঞ্চলের লোকজন অবৈধপথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করে: শরিফুল হাসান

This browser does not support the audio element.

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের লোক হয়তো যেতে পারেন৷ কিন্তু বাংলাদেশের লোক কেন যাবে? এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো হচ্ছে৷ মাথাপিছু আয় বাড়ছে৷ তারপরও কেন যাচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাবে শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘এটা একটা মনস্তাত্বিক ব্যাপার৷ বাংলাদেশের মানুষ এখনো মনে করেন, যে কোনোভাবে যদি ইউরোপের কোনো দেশে চলে যাওয়া যায়, তাহলে তাঁর ভাগ্য বদলে যাবে৷ এক ইউরো আয় করলেই বাংলাদেশের ১০০ টাকার সমান৷ তাঁদের কাছে এই বার্তাটি নেই যে, ইউরোপের অবস্থা আগের মতো নেই৷ সেখানে অবৈধভাবে গিয়ে ধরা পড়লে ফেরত আসতে হবে৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আন-ডকুমেন্টেড বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাচ্ছে৷''

বাংলাদেশ থেকে এখন সরাসরি লিবিয়া যাওয়ার সুযোগ নেই৷ দালালরা এখান থেকে প্রথমে ইরান, দুবাই বা তুরস্ক যাচ্ছে৷ সেখান থেকে তারা লিবিয়া যাচ্ছে৷ আর লিবিয়া থেকে সমুদ্র পথে ইটালি বা ইউরোপের কোনো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ আর লিবিয়ায় একটি চক্র আছে, যার মাধ্যে বাংলাদেশিরাও আছে৷ তাদের আবার বাংলাদেশে এজেন্ট আছে৷ শরিফুল হাসানের মতে, ‘‘এখানে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায় আছে৷ চক্রটির যে অংশ বাংলাদেশে, তারা তো এখান থেকেই টাকা নিচ্ছে৷ মোবাইলে যোগাযোগ করছে৷ তারা এখান থেকে রুট ঠিক করছে, কিন্তু তারা ধরা পড়ছে না বা আইনের আওতায় আসছে না৷ মানবপাচার প্রতিরোধে কঠোর আইন হলেও আমরা তার প্রয়োগ দেখছি না৷’’

ইউএনএইচসিআর-এর হিসাব মতে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাঁরা ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে এখন শীর্ষ চারটি দেশের একটি বাংলাদেশ৷ টিউনিসিয়া,আলজেরিয়া ও ইরাকের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান৷ আর পুরো ইউরোপে নৌপথে অবৈধভাবে প্রবেশের শীর্ষে আছে বাংলাদোশিরা৷

ইউএনএইচসিআর-এর হিসেবে গত সাত বছরে সাগর পথে ইউরোপে যেতে গিয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ৬ হাজার ৯০৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন, নিখোঁজ হয়েছেন ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ৷

আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও সেভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছেনা: অধ্যাপক আবরার

This browser does not support the audio element.

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিচার্স ইউনিট (রামরু)-র অধ্যাপক সি আর আবরার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও সেভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না৷ ফলে বেকারত্ব তো আছেই৷ তাই কাজ না থাকলে তারা তো বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করবেই৷ আর একই সাথে নানা ধরনের প্রলোভন, আর নানা দুষ্টচক্র তো আছেই৷ তারা নিশ্চিত চাকরির প্রলোভন দিচ্ছে৷ কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে আমরা দেখছি না৷ সিগন্যাল তো আগেই ছিল৷ কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় বারবার দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘এখানে দু'টি চক্র কাজ করে৷ একটি গ্রুপ আছে, যারা মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয়৷ সেখানে যাঁরা কাজ করে, তাঁদের আরো উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে ইউরোপে পাঠানোর ফাঁদ পাতে৷ তারা ইটালি, স্পেনের কথা বলে৷ আরেকটি চক্র আছে, যারা বাংলাদেশে বসেই প্রলোভন দেখায়৷ যারা বাংলাদেশে বসে মানবপাচারের এই কাজ করে, তাদের তো আইনের আওতায় আনা যায়৷ কিন্তু তা তো হচ্ছে না৷ যাঁরা প্রতারণার শিকার হয়ে ফিরে আসেন, তাঁদেরকে কাজে লাগিয়ে এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়৷ এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে৷’’

তারা যে ৭-৮ লাখ টাকা খরচ করে যায় তা দিয়ে দেশেই ভালো আয়ের কাজ করা যায়: রওনক জাহান

This browser does not support the audio element.

বাংলাদেশে মানবপাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ আর সর্বনিম্ন ৫ বছরের কারাদণ্ড৷ কিন্তু এই আইনের কোনো প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না৷ কেউ সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন এমন কোনো নজিরও নেই৷

প্রবাসী কল্যাণ সচিব রওনক জাহান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই আইন প্রয়োগের বিষয়টি এককভাবে আমাদের হাতে নেই৷ যাঁরা বৈধভাবে বিদেশে কাজে যান, তাঁদের বিষয়টি আমাদের এখতিয়ার৷ তবে আমরা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একটি আন্তঃমন্ত্রনালয় বৈঠক করবো করনীয় ঠিক করতে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিরাপদ অভিবাসনের বিষয়ে আমাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচি আরো জোরদার করছি৷ জেলা থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত আমাদের এই কর্মসূচি বিস্তৃত করেছি৷ মানুষকে সচেতন করা না গেলে এই দুঃখজনক ঘটনা ঠেকানো যাবে না৷ তাঁরা যে ৭-৮ লাখ টাকা খরচ করে যায়, তা দিয়ে দেশেই ভালো আয়ের কাজ করা যায়৷’’ তিনি মনে করেন, ‘‘এতে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিও ক্ষূন্ন হচ্ছে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ