সোমবার এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলো পুরো বিশ্ব৷ জ্বালানি তেলের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঋণাত্মক হয়ে গেছে৷ অর্থাৎ, কেউ কিনলে তাকে উলটো পয়সা দেয়া হবে৷ কেন এমন হলো?
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বিজ্ঞাপন
এক কথায় বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, বিশ্ব এখন জ্বালানি তেলে ভাসছে৷ রাখার জায়গা নেই৷ তাই পয়সা দিয়ে হলেও নেবার লোক খুঁজছে মার্কিন কোম্পানিগুলো৷ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডাব্লিউটিআই) বা পাতলা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বেঞ্চমার্ক যাকে বলা হয়, তার দাম (মে মাসের জন্য) সোমবার সকালে ব্যারেলপ্রতি ১৫ ডলার থাকলেও, তা কমে -৪০ ডলার পর্যন্ত হয়ে যায়! এ অবস্থা দেখে মার্কিন তেলের দামের নিয়ন্ত্রক সংস্থা টেক্সাস রেলরোড কমিশনের মাথায় হাত! কমিশনার রায়ান সিটন তো বলেই বসেছেন, ‘‘এমনটাই তো হবার কথা ছিল৷’’ আসলে এমন অবস্থা যে তৈরি হবে তা আগেই ধারণা করা গিয়েছিল৷ সে প্রসঙ্গে পরে আসছি৷
এখানে একটি কথা বলা দরকার, তা হলো, এই দাম কিন্তু ‘ফিউচার্স কনট্রাক্টু' বা ভবিষ্যৎ চুক্তি৷ এখানে মে মাসে পরিশোধের জন্য দাম করা হচ্ছিলো৷ যুক্তরাষ্ট্রে ডাব্লিউটিআই-এর বেঞ্চমার্ক অনুযায়ী ফিউচার্স কনট্রাক্টের আওতায় কেনা যায়৷ একেকটি চুক্তি হয় এক হাজার ব্যারেলের৷ তা নয় বছর পর্যন্ত হতে পারে৷ বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের ক্ষেত্রেও এমন ভবিষ্যৎ দামের আওতায় বাণিজ্য হয়৷
যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে
যা-ই হোক, সবাই যে প্রশ্নটি করছেন তা হলো, এই প্রথম কি এতটা দাম পড়ল? আসলে এর আগেও দামের বিরাট হেরফের হয়েছে৷ তবে এটা সত্য যে, এই ফিউচার্স কনট্রাক্টের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা, অর্থাৎ শূন্যের নীচে নেমে যাওয়া এবারই প্রথম৷ তবে কেউ যদি ভেবে থাকেন, শূন্যের নীচে নেমে যাওয়ায় এখন কোম্পানিগুলো সবাই পয়সা দিয়ে বিক্রি করা শুরু করে দিয়েছে, তাহলে ভুল হবে৷ হ্যা, কিছু কিছু কোম্পানি হয়তো করছে৷ কিন্তু সবাই নয়৷ বিশ্লেষকরা এই পড়তি দামকে ‘টেকনিক্যাল' বলতে চান৷ অর্থাৎ ভবিষ্যতের ‘ভবিষ্যৎ চুক্তি'র ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে৷ হিসেব বলছে, বেশিরভাগ ক্রেতারা মে মাসের চেয়ে জুনের সরবরাহের দিকে মনোযোগী হয়েছেন৷ তাই মে মাসের এই হাল৷
বিশ্লেষকরা এপ্রিলের শেষ নাগাদ বা মে মাসের শুরুর দিকে সংকট শুরুর কথা আগেই সাবধান করেছিলেন৷ যেহেতু পরিবহণ খাত প্রায় বন্ধ, এ সময়টায় পেট্রোল ও জেট ফুয়েলের ব্যবহার একেবারে কমে গেছে৷
লম্বা পথ পাড়ি দেবার সময় বোতলের পানির চেয়ে খালি বোতল যেমন কখনো কখনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তেমনি তেলের চেয়ে তেলের ট্যাঙ্ক হয়ে গেছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ, ট্যাঙ্ক খালি না হলে পাইপলাইনের বাকি তেল রাখার জায়গা থাকবে না৷ আর রাখার জায়গা না থাকলে সেই তেল হয় সাগরে ভাসিয়ে দিতে হবে, অথবা তেলক্ষেত্র বন্ধ করে দিতে হবে৷ আর সেই ঝুঁকি কোম্পানিগুলো নেবে না, কারণ, তাতে তেলক্ষেত্রটিই নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ সেক্ষেত্রে উৎপাদনের হার কমানো যেতে পারে৷
সম্প্রতি এসব দিক বিবেচনা করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে অ্যামেরিকার চাপে ওপেক ও তার মিত্ররা প্রতিদিন ৯.৭ মিলিয়ন ব্যারেল কম জ্বালানি তেল উৎপাদনের চুক্তি করে, যা বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ১০ ভাগ৷ কিন্তু তাতেও রক্ষা হলো না ডনাল্ড ট্রাম্পের দেশের৷ যদি এ অবস্থা অনেকদিন চলতে থাকে, তাহলে অপরিশোধিত তেলের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো এবং উৎপাদন কমানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই৷
আর শেষ কথা হলো, আগে পেট্রোলের দাম কমলে জনগণের লাভ হতো৷ এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে গ্যালনপ্রতি (৩.৭ লিটার) এক ডলারে নেমে এসেছিল পেট্রোলের দাম৷ তাতে মানুষ উপকার পেয়েছেন৷ গাড়ি চালিয়ে খুব আরাম পেয়েছেন৷ এখন লকডাউনে গাড়ি চালাবারও উপায় নেই৷ তাই এই দাম কমায় সাধারণেরও লাভ নেই৷
জ্বালানির যত উৎস
লন্ডন ভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিল’ বা ডাব্লিউইসি-এর ‘বিশ্ব জ্বালানি সম্পদ ২০১৬’ প্রতিবেদনে কোন জ্বালানি কী পরিমাণ ব্যবহত হচ্ছে তার হিসেব প্রকাশ করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
১. তেল
লন্ডন ভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড এনার্জি কাউন্সিল’ এর ‘বিশ্ব জ্বালানি সম্পদ ২০১৬’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হওয়া জ্বালানি হচ্ছে তেল৷ মোট ব্যবহৃত জ্বালানির প্রায় ৩২.৯ শতাংশই হচ্ছে তেল৷ আর তেল উৎপাদনে শীর্ষ তিন দেশ হচ্ছে সৌদি আরব (বছরে ৫৬৯ মিলিয়ন টন), যুক্তরাষ্ট্র (বছরে ৫৬৭ মিলিয়ন টন) ও রাশিয়া (বছরে ৫৪১ মিলিয়ন টন)৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২. কয়লা
২৯ শতাংশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হওয়া জ্বালানির তালিকায় তেলের পরেই আছে কয়লা৷ তবে নব্বই দশকের পর ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো কয়লা উৎপাদন কমেছে৷ বিশ্বের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৪০ ভাগ কাজে কয়লা ব্যবহৃত হয়৷ শীর্ষ তিন উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে চীন (বছরে ২ দশমিক ৬২ হাজার এমটিওই), যুক্তরাষ্ট্র (৫৬৯ এমটিওই) ও ভারত (৪৭৪ এমটিওই)৷ উল্লেখ্য, এমটিওই মানে হচ্ছে এক মিলিয়ন মেট্রিক টন অফ ওয়েল ইকুইভ্যালেন্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Roland Weihrauch
৩. গ্যাস
তিন নম্বরে আছে গ্যাস (প্রায় ২৪ শতাংশ)৷ আর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির তালিকায় কয়লার (৪০ শতাংশ) পরে আছে গ্যাস (২২ শতাংশ)৷ শীর্য তিন গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র (বছরে ৬৯১ এমটিওই), রাশিয়া (বছরে ৫১৬ এমটিওই) ও ইরান (বছরে ১৭৩ এমটিওই)৷
ছবি: Imago
৪. পানিবিদ্যুৎ
নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন উৎসের মধ্যে পানি বা জলবিদ্যুতের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি৷ ২০১৫ সালে উৎপাদিত মোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্রায় ৭১ শতাংশই এসেছে জলবিদ্যুৎ থেকে৷ আর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হওয়া জ্বালানির তালিকায় তেল (৩৩ শতাংশ), কয়লা (২৯ শতাংশ) ও গ্যাসের (২৪ শতাংশ) পরেই আছে পানিবিদ্যুৎ (প্রায় ৭ শতাংশ)৷ শীর্ষ তিন উৎপাদনকারী চীন (বছরে ৯৬.৯ এমটিওই), ব্রাজিল (৩২.৯ এমটিওই) ও ক্যানাডা (৩২.৩ এমটিওই)৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Jourdier
৫. পরমাণুশক্তি
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হওয়া জ্বালানির তালিকায় পাঁচ নম্বরে আছে এটি (৪ দশমিক ৪ শতাংশ)৷ অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানির একটি উৎস পানিবিদ্যুতের (প্রায় ৭ শতাংশ) চেয়েও এর ব্যবহার কম৷ ইউরেনিয়াম উৎপাদনে শীর্ষ তিন দেশ হচ্ছে কাজাখস্তান (বছরে ২২ দশমিক ৮ হাজার টন), ক্যানাডা (৯ দশমিক ১৪ হাজার টন) ও অস্ট্রেলিয়া (৪ দশমিক ৯৮ হাজার টন)৷
ছবি: Kerry Skyring
৬. বায়ুশক্তি
বিশ্বের মোট বিদ্যুতের ৭ শতাংশ আসে বায়ুবিদ্যুৎ থেকে৷ ২০১৫ সালে ৪৩২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল৷ এর মধ্যে ৪২০ গিগাওয়াট অনশোর (ভূমি) ও ১২ গিগাওয়াট অফশোর, অর্থাৎ সাগরে বসানো টারবাইনের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়৷ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হওয়া জ্বালানির তালিকায় ছয়ে আছে এটি (১.৪৪ শতাংশ)৷ শীর্ষ তিন বায়ুশক্তি উৎপাদনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র (বছরে ১৫.৮ এমটিওই), চীন (১৩.৬ এমটিওই) এবং জার্মানি (৪.৯৩ এমটিওই)৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Vaughn
৭. সৌরশক্তি
২০১৫ সালে সারা বিশ্বে মোট সৌরশক্তি উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২২৭ গিগাওয়াটে৷ ফলে মোট বিদ্যুতের এক শতাংশ এসেছিল সৌরশক্তি থেকে৷ সৌরশক্তি উৎপাদনে শীর্ষ তিন দেশ চীন (৪৩ দশমিক ১ গিগাওয়াট), জার্মানি (৩৯ দশমিক ৬ গিগাওয়াট) ও জাপান (৩৩ দশমিক ৩ গিগাওয়াট)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Gupta
৮. অন্যান্য উৎস
জিওথার্মাল, ই-স্টোরেজ, মেরিন এনার্জি, বর্জ্য থেকে শক্তি, বায়োএনার্জি (যেমন বায়োমাস) ইত্যাদি সহ আরও অনেক উৎস দিয়েও জ্বালানি উৎপাদন করা হয়ে থাকে৷ ছবিতে আইসল্যান্ডের একটি জিওথার্মাল পাওয়ার স্টেশন দেখা যাচ্ছে৷ ডাব্লিউইসি-র প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন উপরের ‘+’ চিহ্নে৷