শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফরমে অভিভাবক হিসেবে বাবার নাম লেখার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা আর থাকছে না৷ বাবা, মা এবং আইনগত অভিভাবক- এই তিন বিকল্পের একটি ব্যবহার করলেই চলবে বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট৷
বিজ্ঞাপন
এসএসসিতে মায়ের নাম দিয়ে রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ চেয়ে প্রায় এক দশক আগের করা এক রিট মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেয়৷
ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের খবর অনুযায়ী রিটকারীর পক্ষে শুনানিতে অংশ নেওয়া আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকী পরে সাংবাদিকদের বলেন, ১৪ বছর আগে যখন রিট মামলাটি ফাইল করা হয়, তখন একজন শিক্ষার্থীকে অভিভাবক হিসেবে বাবার নাম উল্লেখ করতে হত, এরপর মায়ের নাম উল্লেখ করতে হত৷ ফলে একজন শিক্ষার্থী চাইলে বাবার নাম উল্লেখ না করে মায়ের নাম উল্লেখ করতে পারত না৷ "আজ শুনানি শেষে হাইকোর্ট বলেছে, বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের মধ্যে যে কোনো একটি উল্লেখ করে ফরম পূরণ করা যাবে৷”
আদালতে রুলের পক্ষে শুনানিতে আরো ছিলেন অ্যাডভোকেট এমএম রেজাউল করিম, অ্যাডভোকেট আয়েশা আক্তার৷ রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত৷
শিক্ষার্থী তথ্য ফরমে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বাবার নাম পূরণ না করায় ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের এক তরুণীকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায় রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড৷
মা ও সন্তানকে স্বীকৃতি না দিয়ে বাবা চলে যাওয়ায় ওই তরুণী তার মায়ের একার চেষ্টায় বড় হচ্ছিলেন৷ পরে এই ঘটনার যথাযথ অনুসন্ধানের ওপর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট মানবাধিকার সংগঠন ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)', ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ' ও ‘নারী পক্ষ' হাইকোর্টে জনস্বার্থে এই রিট আবেদন করে৷
রিটের প্রাথমিক শুনানি হয় ২০০৯ সালে ৩ আগস্ট বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর বেঞ্চে৷ সে সময় আদালত রুল জারি করে৷
মানবাধিকার, সমতার পরিপন্থি ও বিশেষভাবে শিক্ষা অধিকারে প্রবেশগম্যতার বাধাস্বরূপ বিদ্যমান বৈষম্যমূলক এই বিধানকে কেন আইনের পরিপন্থি এবং অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে না– তা জানতে চাওয়া হয় রুলে৷ সেই রুলের নিষ্পত্তি করে মঙ্গলবার রায় দিল আদালত৷
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের শিশু অভিভাবকত্ব আইন
কোন দেশে বাবা, কোন দেশে মা, আবার কোন দেশে দুইজনই শিশুর আইনগত অভিভাবক৷ বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর শিশু কার অধিকারে বা সঙ্গে থাকবে তা নিয়েও আইনের পার্থক্য আছে দেশে দেশে৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্ডিয়ানশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৬ অনুযায়ী, পাঁচ বছরের নিচে হিন্দু শিশুর অভিভাবকত্ব পাবে তার মা৷ বর্তমানে আদালতের রায়ে বাবা-মা দুইজনকেই আইনগত অভিভাবকত্ব দেয়া হয়, যাতে দুইজনের সঙ্গেই শিশুর যোগাযোগ থাকে৷ একক অভিভাবকত্বের প্রশ্নে মাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়৷ যদি মা সম্মতি দেন বা অসমর্থ হন কিংবা শিশু যদি ১৩ বছরোর্ধ হয় এবং নিজে সিদ্ধান্ত নেয় এমন ক্ষেত্রে বাবা অভিভাবকত্ব পেতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/blickwinkel/K. Wothe
পাকিস্তানে নতুন আইন
১৮৯০ সালের আইন সংশোধন করে ২০২২ সালে নতুন ‘গার্ডিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ২০২০’ পাস করেছে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ৷ এই আইন অনযায়ী, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলে সাত বছর বয়স পর্যন্ত শুধু মা অভিভাবকত্বের অধিকার পাবেন৷ আর মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে তা বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানো বা ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত৷ এক্ষেত্রে মা অসমর্থ হলে যথাক্রমে নানি, দাদি, বোন, খালা, ফুপুসহ নারী আত্মীয়রা অভিভাবকত্ব পাবেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Tabassum
আফগানিস্তানে বাবার অধিকার
‘আফাগানিস্তানের সিভিল ল’ অনুযায়ী ছেলে শিশু সাত বছর ও মেয়ে শিশু নয় বছর পর্যন্ত দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব মায়ের৷ তালাকের ক্ষেত্রে আদালত ভরনপোষণের জন্য বাবাকে মাসে ২০০০ থেকে ৩০০০ আফগান মুদ্রা দেয়ার নির্দেশ দিতে পারে৷ নির্দিষ্ট বয়সের পর অভিভাবকত্ব পায় বাবা বা বাবার দিকের কোনো পুরুষ আত্মীয়৷ এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে চাচা বা চাচাত-ফুপাত ভাইরাও আইনত অভিভাবকত্বের অধিকার পেতে পারে৷
ছবি: Hector Retamal/AFP/Getty Images
জাপানে শুধু একজন
জাপানের পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে সন্তানের অভিভাবকত্ব ও দায়িত্ব যৌথভাবে দুইজনের উপর থাকে৷ তবে বিবাহ বিচ্ছেদের পর বাবা অথবা মা যেকোন একজন সন্তানের আইনগত অধিকার পান৷ বিবাহ বিচ্ছেদের সময়ই এই বিষয়ে দুইজনকে একমত হতে হয়৷ না হলে পরবর্তীতে আদালত এই সিদ্ধান্ত দেয়৷ অবিবাহিত বাবা-মায়ের সন্তানের ক্ষেত্রে শুধু মা অভিভাবকত্ব পান৷
ছবি: picture-alliance/Zuma/Sopa/V. Kam
জার্মানিতে শিশুর স্বার্থ আগে
বিয়ের মাধ্যমে, যৌথ অভিভাবকত্বের ঘোষণা অথবা পারিবারিক আদালতের রায়ে জার্মানিতে বাবা-মা দুইজনই সন্তানের অভিভাবকত্ব পান, অন্যথায় মা অভিভাবক হন৷ বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলেও অভিভাবকত্বে সাধারণত পরিবর্তন হয় না৷ তবে ১৪ বছরের উপরের সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সম্মতিতে আদালত একজনের অভিভাবকত্ব মঞ্জুর করতে পারে৷ যেকোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শিশুর স্বার্থ ও কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয় জার্মানির পারিবারিক আদালত৷
ছবি: imago/photothek/U. Grabowsky
যুক্তরাষ্ট্রে বাবা-মায়ের সমানাধিকার
যুক্তরাষ্ট্রে বিবাহ বিচ্ছেদের সময় সন্তানের অভিভাবকত্বের বিষয়টিরও সুরাহা হয়৷ সাধারণত বিবাহিত অবস্থায় এবং বিচ্ছেদের পরও সন্তানের উপর বাবা-মায়ের সমান অভিভাবকত্ব থাকে৷ শিশু কার সঙ্গে থাকবে সেটি নির্ধারণে আদালত শিশুর নিজের ইচ্ছা, বাবা-মা, ভাই-বোন ও নিকট আত্মীয়দের মত নেয়৷ থাকার জায়গা, স্কুল, লোকালয় এবং যার সঙ্গে থাকবে তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যসহ ‘শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থকে’ অগ্রাধিকার দেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/J. Lawler Duggan
বাংলাদেশে অভিভাবক পিতা
অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ এবং মুসলিম আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নাবালক সন্তানের অভিভাবক তার পিতা৷ পিতার অবর্তমানে দায়িত্ব পাবেন মা৷ তবে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে উচ্চ আদালত এক রায়ে মাকেও অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর তথ্য সংক্রান্ত ফরম পূরণের ক্ষেত্রে বাবা, মা এবং আইনগত অভিভাবক- যে কোনো একজনের নাম ব্যবহার করলেই চলবে৷