পড়াশোনা এবং কর্মক্ষেত্র বাড়ি থেকে অনেক দূরে হওয়ায় মায়ের হাতের পিঠা শেষ কবে খেয়েছি, মনেও পড়ে না৷ গ্লোবালাইজেশনের যুগে পিঠাও এখন উঠে এসেছে দোকানে৷ কিন্তু পিঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত আরো অনেককিছু কি হারাতে বসেছে?
বিজ্ঞাপন
ছোটবেলায় অপেক্ষা করে থাকতাম শীতকালের জন্য৷ শীতে বেশি বেশি কাপড় গায়ে জড়ানো যায়, এটা কেন জানি আমার খুব ভালো লাগতো৷ কিন্তু তার চেয়েও বেশি মজার ছিল শীতের পিঠা৷
এখনও মনে আছে, পৌষ সংক্রান্তির অনেক আগে থেকেই শুরু হতো মায়ের পিঠা বানানোর প্রস্তুতি৷ যেসব পিঠায় নারিকেলের প্রয়োজন, সেগুলো তৈরির জন্য নারিকেল কুচি করা, সেই কুচির অর্ধেক চিনি, বাকি অর্ধেক গুড় দিয়ে ভাজা হতো৷
তবে আমার অবশ্য নারিকেলের পিঠা বানানো পর্যন্ত তর সইতে ভালো লাগতো না৷ মা-কে লুকিয়ে নারকেল কুচির এক তৃতীয়াংশ শেষ করে ফেলতাম পিঠা বানানোর আগেই৷ মা নিশ্চয়ই সেটা টের পেতেন, তবে আমি কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে ঘুরে ঘুরে পিঠা হতে কত দেরি সেই তদারকি করতাম৷
আমার সবচেয়ে পছন্দের পিঠা ছিল পুলি৷ ফলে পুলিটাই বেশি তৈরি হতো৷ সাথে নারিকেলের পাটিসাপটা ও অন্যান্য পিঠাও আমার বেশ পছন্দই ছিল৷ তেলের পিঠা বা মালপোয়া একেবারেই পছন্দ ছিল না বলে সেটা শুধু নিয়মরক্ষা এবং আইটেম বাড়ানোর তাগিদেই বানানো হতো৷
পিঠার গল্প, জীবনের গল্প
বাংলাদেশে পিঠার ঐহিত্য সুপ্রাচীন৷ ঘরে বানানো সেই পিঠা এখন নগরের দোকানেও পাওয়া যায়৷ আর শীতকালে তো ঢাকার পথে পথে বসে পিঠার দোকান৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: DW/H. Ur Rashid
পথের পিঠা
শীতের বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকার অলিতে গলিতে পড়ে যায় পিঠা বিক্রির ধুম৷ রাস্তার পাশেই চুলা পেতে তৈরি হয় পিঠা৷ এসব দোকানে ক্রেতাও অনেক৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
চিতই আর ভাপা
পথের পিঠায় চিতই আর ভাপা পিঠারই প্রাধান্য৷ দামও কম৷ গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠার এই আয়োজন নগরে শীতের আমেজ এনে দেয়৷ চিতই পিঠার সাথে থাকে নানা ধরনের ভর্তা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
ভর্তা ফ্রি
রাজধানীতে চিতই পিঠার সাথে নানা ধরনের ভর্তা খাওয়ার রেওয়াজ আছে৷ এই ভর্তার মধ্যে শুটকি, ধনেপাতা, সরিষা বাটাই প্রধান৷ সব দোকানেই পিঠা খেলে ভর্তা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
ভর্তাই যখন পিঠার আকর্ষণ
শুক্রাবাদে এরশাদের চিতই পিঠার দোকানে যেন ভর্তাই প্রধান আকর্ষণ৷ এরশাদের মতে, ভর্তার কারণেই তাঁর গ্রাহক বেশি৷ ৫ টাকার চিতই পিঠার সাথে তিনি দেন ১২ রকমের ভর্তা৷ শুধু শুটকি ভর্তাই আছে ৫ প্রকারের৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
এক সাথে ১৬ চুলায় পিঠা
মোহাম্মদপুর হাউজিংয়ে দেখা গেল ১৫-১৬টি চুলায় একই সঙ্গে চিতই পিঠা ভাজার দৃশ্য৷ আছে ভাপা পিঠাও৷ দু’জন নারী এখানে পিঠার ব্যবসা করেন৷ সন্ধ্যা থেকেই পিঠার জন্য ভীড় করেন নগরবাসী৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
অভিনব ডিম চিতই
তাঁদের কেউ শিখিয়ে দেয়নি, স্বাদের ভিন্নতা আনতেই তাঁরা ডিম চিতই ‘আবিস্কার’ করেন৷ ভাজার সময় চালের গোলার সঙ্গে একটি ডিম ভেঙে দেন– হয়ে গেল ডিম চিতই৷ ডিম চিতইয়ের চাহিদাও বেশ৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
সাধারণ উপকরণ
চালের গুঁড়া, গুড়, লবন আর নারকেল– এই হলো চিতই আর ভাপা পিঠার উপকরণ৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
সংসার চালায় পিঠা
বিলকিস বেগমের বাড়ি শরিতপুর৷ ঢাকায় আসেন ১০ বছর আগে৷ মোহাম্মদপুরে এই পিঠা বিক্রি করেন ৫ বছর ধরে৷ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি – এই তিন মাস তিনি পিঠা বিক্রি করেন৷ স্বামীসহ পরিবারের সদস্য ৬ জন৷ তিনি জানান, পিঠা বিক্রির এই তিন মাসের আয়ে তাঁর প্রায় সারা বছর চলে যায়৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
চুলার বিশেষত্ব!
আরেক পিঠা বিক্রেতা রোজিনা বেগমের দাবি, তাঁদের এই চুলা একটু বিশেষ ধরনের৷ এঁটেল মাটি দিয়ে নীচে স্টিলের প্লেট দিয়ে এই চুলা তাঁরা নিজেরাই তৈরি করেন৷ চুলায় কাঠের আগুনে চিতই আর ভাপা’র স্বাদ নাকি বেড়ে যায়৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
যখন খুশি তখন খাই
সড়কের পাশে এই পিঠার এত চাহিদা কেন? বাসায়ও তো তৈরি করে খেতে পারেন৷ নির্ঝর আর জামান জানান বললেন, বাসায় তো আর প্রতিদিন আয়োজন করা যায় না৷ আর ঝক্কিও অনেক৷ তাই এখানে এসে যখন মন চায় তখনই পিঠা খাই৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
ঢাকায় প্রথম রেস্টুরেন্ট কাম পিঠাঘর
বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে খাবার-দাবার পিঠাঘর সম্ভবত রাজধানীতে প্রথম রেস্টুরেন্টে পিঠা বিক্রি শুরু করে৷ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর তাঁর মা, কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উৎসাহে রেস্টুরেন্টে পিঠার ব্যবসা শুরু করেন৷ পিঠা ছাড়াও হাঁসের মাংশ, খিচুড়িসহ নানা ব্যতিক্রমী খাবার পাওয়া যায় এখানে৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
কত রকমের পিঠা
খাবার দাবার পিঠাঘরে ১২ রকমের পিঠা তৈরি হয়৷ দোকানের ম্যানেজার রবিউল আলম জানান, ভাপা, পাটিসাপটা, পোয়া, পুলি, চিতই তাঁরা তৈরি করেন৷ শীত কালে চাহিদা বেশি, তবে সারাবছরই তাঁরা পিঠা বিক্রি করেন৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
নিজস্ব ডিজাইন
আজকাল পিঠা তৈরির নানা ধরনের সাজ পাওয় যায়৷ কিন্তু খাবার দাবার পিঠাঘরের সব পিঠাই হাতে ডিজাইন করা হয়৷ কোনো সাজ ব্যবহার করা হয় না৷ এখানে যে-কেনো ধরনের পিঠার হয় ২৫ টাকা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
শুধুই পিঠার দোকান
বেইলি পিঠাঘরের অবস্থান বেইলিরোড নাটক সরণীতে৷ আর এখানে তারা পিঠার ব্যবসা করেন ২৫ বছর ধরে৷ তাদের রয়েছে ৪০ ধরনের পিঠা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
বাহারি নামের পিঠা
বেইলি পিঠাঘরে আছে বাহারি সব নামের পিঠা৷ স্বাদেও আছে ভিন্নতা৷ দেশে প্রচলিত পিঠার সাথে তাঁরা যুক্ত করেছেন বিবি খানা, শাহী রস পাকন, ক্ষীর লুচি, লবঙ্গ লতিকা, শাহী জবা, রস ফুল, সুন্দরী পাকনসহ আরো নানা নামের ও স্বাদের পিঠা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
পিঠা যায় বিদেশে
বেইলি পিঠাঘরের পিঠা ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়৷ দোকান কর্তৃপক্ষ জানায়, এই পিঠার চাহিদা আছে সারা দেশে৷ বঙ্গভবন, গণভবন আর সচিবালয়ে তাঁরা নিয়মিত পিঠা দেন৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
বিদেশিদের নজর কেড়েছে
ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসে যেসব বিদেশি কাজ করেন, তাঁদের আকর্ষণ করতে পেরেছে বেইলি পিঠাঘরের পিঠা৷ এখানে নাকি ভারতের অন্তত ২ জন প্রধানমন্ত্রী পিঠা খেয়েছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা নাকি এই দোকানের নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
দামি পিঠা
এখানকার সবচেয়ে দামি পিঠার নাম শাহী মালাই৷ পউরুটি আর দুধের ক্ষীর দিয়ে তৈরি হয় এই পিঠা৷ তাদের দাব, এই পিঠা তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড৷ প্রতি পিসের দাম ৫০ টাকা৷ আর অন্য পিঠার দাম ২০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
যে চার ধরনের পিঠার চাহিদা সবচেয়ে বেশি
ঢাকায় চার ধরনের পিঠার চাহিদা সবচেয়ে বেশি৷ এগুলো হলো ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা এবং পোয়া৷ এই পিঠাগুলো সুস্বাদু এবং এগুলো সংরক্ষণ করাও সহজ৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
পিঠার কারিগর
বাংলাদেশে পিঠা তৈরি প্রশিক্ষণ দেয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই৷ সবাই দেখতে দেখতেই শেখেন৷ এটা নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেন৷ তাঁদেরই একজন বেইলি পিঠাঘরের মোহাম্মদ বাসান৷ তিনি ১৫ বছর ধরে এখানে পিঠা তৈরি করছেন৷ তাঁর সঙ্গে কাজ করেন আরো ১২ জন৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
ফাস্টফুড ও মিষ্টির দোকানেও পিঠা
এখন ফাস্টফুড আর মিষ্টির দোকানে ১২ মাসই পাটিসাপটা পিঠা পাওয়া যায়৷ তবে শীতকালে অভিজাত কিছু দোকানে আয়োজন করে পিঠা বিক্রি হয়৷ চিতই, ভাপা ছাড়াও পুলি, পাক্কন পাওয়া যায় সেখানে৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
সবই কি স্বাস্থ্যসম্মত?
সড়কের পাশের অথবা অভিজাত দোকানের পিঠা বিক্রেতা- সবারই দাবি তাঁর দোকানের পিঠা স্বাস্থ্যসম্মত৷ কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি সব ক্ষেত্রে তা বলে না৷ পিঠার মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও নেই বিআইএটিএ’র৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
পিঠার সাজ
পিঠা তৈরির জন্য নানা ধরনের সাজের প্রয়োজন হয়৷ ঢাকার বিভিন্ন মার্কেট ও কাঁচাবাজারে ভাপা ও চিতই পিঠার মাটির সাজ পাওয়া যায়৷ দাম ৪০ থেকে ৮০ টাকা৷ নকশি পিঠার প্লাস্টিকের সাজও পাওয় যায় বাজারে৷ এসব সাজ দিয়ে ঘরে বসেই বানাতে পারেন পিঠা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
আতপ চালের রকমভেদ
পিঠার প্রধান উপাদান আতপ চাল৷ যে চাল সিদ্ধ না করে সরাসরি শুকানো হয়, তা-ই আতপ চাল৷ এর দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ১২০ টাকা৷ চিতই আর ভাপা তৈরি হয় সাধারণ আতপ চালে৷ আর নকশি পিঠা চিনিগুঁড়া চালে৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
যে গুড়ে পিঠা হয়
চাল ছাড়াও পিঠার অন্যতম উপাদান হলো গুড়, চিনি ও দুধ৷ এই গুড় কিনতে হবে বুঝেশুনে৷ ঢাকার কৃষি মার্কেটসহ আরো কয়েকটি মার্কেটে যশোর এবং রাজশাহীর ভালো মানের খেজুরের গুড় পাওয়া যায়৷ দাম প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
পিঠার নারকেল
পিঠার স্বাদ বাড়ায় নারকেল৷ বিশেষ করে জনপ্রিয় ভাপা পিঠা তো নারকেল ছাড়া হবেই না৷ বরিশাল, খুলনার ভালো নারকেল পাবেন কারওয়ান বাজার ও কৃষি মার্কেটে৷ তবে এই নারকেল ফাটানো ও কোরানো এক ঝক্কির বিষয়৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
অনলাইনে পিঠা
এখন ঢাকায় অনলাইনে অর্ডার করেও পিঠা পেতে পারেন৷ এরকম প্রচুর অনলাইন শপ গড়ে উঠেছে৷ সাধারণভাবে দুধ চিতই আর চুই পিঠা দোকানে পাওয় যায় না৷ তবে অনলাইনে পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
পিঠা উৎসব
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শীতে আয়োজন করা হয় পিঠা উৎসব আর পিঠা মেলার৷ কোনোটি বড় আবার কোনোটি ঘরোয়া পরিবেশে৷ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে জাতীয় পিঠা উৎসব পিঠার সবচেয়ে বড় আয়োজন৷ শুরু হয় ২০ জানুয়ারি৷ এরইমধ্যে ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি আয়েজন করেছিল পিঠা উৎসবের৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি করে ঢাকায় তিন তলা বাড়ি
হানিফ হাওলাদার ভাগ্যের টানে ঢাকায় আসেন ১২ বছর বয়সে৷ এখন বয়স প্রায় ৫০৷ তিনি চার সন্তানের জনক৷ ৩৫ বছর ধরে ঢাকার জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে চিতই পিঠা বিক্রি করছেন৷ আর এই পিঠা বিক্রির টাকায় সংসার চালিয়ে, সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে ঢাকার কামরাঙ্গির চরে করেছেন তিন তলা পাকা বাড়ি৷ তার চিতই পিঠার সুখ্যাতি পুরো এলাকা জুড়ে৷ প্রতিদিন গড়ে আয় করেন ৩ হাজার টাকা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
29 ছবি1 | 29
কিন্তু আমার ছোট বোনের জন্মের পর ধীরে ধীরে পালটাতে লাগলো পরিস্থিতি৷ কেন জানি মালপোয়াই সবচেয়ে পছন্দের পিঠা বলে প্রচার শুরু করলো সে৷ ফলে পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে সব দৃষ্টি ঘুরে গেল তার দিকেই৷ আমাদের বাড়িতে পুলি সাম্রাজ্যের পতন ঘটলো, শুরু হলো মালপোয়ার রাজত্ব৷
এ নিয়ে মৃদুমন্দ ঝগড়া হলেও তাতে আমাদের মজাটা কিন্তু কমেনি৷
এরপর বড় হতে হতে একসময় উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসা৷ পড়াশোনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ হঠাৎ এক শীতে আবিষ্কার করলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌরঙ্গী চত্ত্বরে এক খালা লাকড়ির চুলায় বানিয়ে বিক্রি করছেন ভাপা আর চিতই পিঠা৷ এই পিঠা এত জনপ্রিয় হলো, কয়েক বছরের মাথায় এখন রীতিমতো দোকান খুলে শত রকমের পিঠা বিক্রি হয়৷ পিঠা খেতে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে অর্ডার দিতে হয়৷ বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে দল বেঁধে পিকনিকের আমেজে ঢাকা থেকেও লোকজন সে পিঠা খেতে যান৷
ঢাকা শহরে এখন কিছু দোকান রয়েছে, যেখানে সারা বছরই নানা রকমের পিঠা বিক্রি হয়৷ ফলে বাঙালির পিঠা না খেতে পারার সে দুঃখ আর এখন নেই৷
কিন্তু সবকিছু কর্পোরেট হয়ে গেলে পণ্যের জোগান ও প্রাপ্তি বাড়লেও আবেগ, অনুভূতিগুলো ক্রমশ সরতে থাকে দূরে৷ সংক্রান্তি উপলক্ষে বাড়ি যাওয়া, সবার সাথে শীতের আমেজে আনন্দ ভাগ করে নেয়া, সেটা তো আর দোকানে সরবরাহ সম্ভব না৷
শীতের পিঠা এখনো আমার কাছে, গুড়-নারকেল কুচি চুরি করে খাওয়া, বোনের সঙ্গে মালপোয়া না পুলি, তা নিয়ে ঝগড়া করা, খেতে না চাইলেও জোর করে ‘আরেকটা খা' বলে পাতে তুলে দেয়া মায়ের আদর৷
কিন্তু পুঁজিবাদের যুগে সবই বাজারে পাওয়া যায়৷ ফলে এখন আর কাউকে কষ্ট করে কিছুই ঘরে তৈরি করতে হয় না৷ প্রায় সব পরিবারেই ঘরে তৈরি পিঠার চেয়ে কিনে আনা পিঠার প্রচলন শুরু হয়েছে৷ দিন যেতে থাকলে এ হার আরো বাড়ারই শঙ্কা করছি৷ একসময় হয়তো কোনো বাসায় যে রীতিমতো উৎসব করে পিঠার প্রস্তুতি চলতো, তা-ও জানবে না বাচ্চাকাচ্চারা৷
এখনো পিঠা খাই, পেট ভরেই খাই৷ কিন্তু এখন শুধু পিঠাই খাই, মায়ের আদর খাই না৷
পিঠা বাংলার নিজস্ব এক সংস্কৃতি৷ আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের পিঠা দেখা যায়৷ গ্রামাঞ্চলে সাধারণত নতুন ধান তোলার পর থেকেই পিঠা তৈরির ধুম লাগে৷ নানা ধরনের পিঠা নিয়ে আমাদের এই বিশেষ ছবিঘর...
ছবি: Farukh Ahmed
ভাপা পুলি
পুর ভরা থাকে এবং ভাপ দিয়ে তৈরি হয় বলে এ পিঠার নাম ভাপা পুলি পিঠা৷ পুর হিসেবে পছন্দ অনুযায়ী নারকেল, ক্ষীর বা ঝালযুক্ত উপকরণ দেয়া হয়৷ রুটি তৈরি করে চাঁদের মতো করে কাটা হয় বলে একে চন্দ্রপুলি পিঠাও বলা হয়৷
ছবি: Farukh Ahmed
ডিম সুন্দরী
চালের গুঁড়ার সাথে ভাজা ডিম চুবিয়ে পরতে পরতে ভাজা হয়৷ সুন্দর ঘ্রাণের জন্য এলাচ-দারচিনির গুঁড়াও মিশানো হয় এতে৷ কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া অঞ্চলে এ পিঠাটির প্রচলন বেশি৷
ছবি: Nowrin Akther
পোয়া/তেলে
সবচেয়ে পরিচিত, সহজ ও দ্রুত তৈরি করা যায় এই পিঠা৷ ফলে শীত-গ্রীষ্ম সারা বছরই এর চাহিদা বেশি থাকে৷ চালের গুঁড়ার সাথে খেজুর বা আখের গুড় মিশিয়ে গোলা তৈরি করে ডুবো তেলে ভেজে এ পিঠা তৈরি করা হয়৷ কখনো কখনো এতে নারকেলও মিশানো হয়৷
ছবি: Nowrin Akther
মুগ পাক্কন
মুগের ডালের সাথে চালের গুঁড়া ও নারকেল মিশিয়ে কাই তৈরি করে বিভিন্ন আকৃতিতে কাটা হয়৷ তারপর তেলে ভেঁজে পিঠাটিকে চিনি বা গুড়ের সিরায় চুবিয়ে খাওয়া হয় ৷
ছবি: Farukh Ahmed
নকশি পিঠা
কোনো পিঠার উপর যখন নকশা করা হয়, তখন তাকে নকশি পিঠা বলে৷ খেজুর কাঁটা, খোঁপার কাঁটা, সুচ, পাটকাঠি, খড়কা ইত্যাদির সাহায্যে হাতে দাগ কেটে-কেটে নকশা তোলা হয়৷ হাতের পরিবর্তে ছাঁচের সাহায্যেও এ নকশা তৈরি করা যায়৷
ছবি: Farukh Ahmed
মেরা বা হাতমুঠি
এটিকে শীতকালীন পিঠাও বলা যেতে পারে৷ হেমন্তে নতুন ধানের চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় বলে এ পিঠার স্বাদই হয় অন্যরকম৷ মূলত চালের গুঁড়াকে পানিতে মিশিয়ে তা প্রয়োজনমতো সিদ্ধ করে কাই বানানো হয়৷ এ কাইকে ছোট ছোট বিভিন্ন আকৃতি দিয়ে তা আবার সিদ্ধ করে নেয়া হয়৷ কেউ কেউ আবার এতে চিনি বা গুড়ও মেশান৷
ছবি: Farukh Ahmed
ভাপা পিঠা
শীতকালীন এ পিঠাটি মূলত চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয়৷ ছোট বাটিতে প্রথমে মাখানো চালের গুঁড়ার সাথে নারকেলের গুঁড়া ও খেজুর গুড় বাটিতে রাখা হয়৷ এরপর বাটির মুখ পাতলা কাপড় দিয়ে মুড়ে ফুটন্ত হাঁড়ির ছিদ্রতে বসিয়ে এ পিঠাটি তৈরি করা হয়৷ তবে গুড় ও নারিকেলের পরিবর্তে কেউ কেউ চালের গুঁড়ার সাথে শুধু ধনে পাতা মিশিয়েও এটি তৈরি করে থাকেন৷
ছবি: Amena Anar
মালপোয়া
মালাই ও চালের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই পিঠা৷ তবে সাধারণ পোয়া পিঠার মতো ফুলকো থাকে না৷ ভীষণ নরম ও খেতে সুস্বাদু হয় পিঠাটি৷
ছবি: Farukh Ahmed
ঝাল পাক্কন
স্বাদে ঝাল বলে একে বলা হয় ঝাল পাক্কন পিঠা৷ চালের গুঁড়ার সাথে, ডিম, কাঁচা মরিচ, ধনে পাতা, পিয়াজ ইত্যাদি মিশিয়ে কাই তৈরি করা হয়৷ তারপর পছন্দ অনুযায়ী কেটে তেলে ভেজে এ পিঠাটি তৈরি করা হয়৷
ছবি: Farukh Ahmed
লবঙ্গলতিকা
লবঙ্গ দিয়ে এ পিঠাটির উপর গাঁথুনি দেয়া হয় বলে একে বলা হয় লবঙ্গলতিকা পিঠা৷ মিষ্টি স্বাদের এ পিঠাটির ভেতরে থাকে নারকেলেন পুর৷ চিনির শিরায় ডুবিয়ে পিঠাটির উপরে দেয়া হয় চিনির প্রলেপ৷
ছবি: Farukh Ahmed
খোলা জালি
চালের গুঁড়ার সাথে ডিম আর প্রয়োজন মতো লবন মিশিয়ে মাটির খোলায় এ পিঠা তৈরি করা হয় বলে এর নাম খোলা জালি পিঠা৷ কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও বিক্রমপুর এলাকায় পিঠাটির প্রচলন বেশি৷
ছবি: Amena Anar
চন্দ্রপুলি
এ পিঠাটি বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই জনপ্রিয়৷ নারকেলের গুঁড়া, দুধ, সুজি, এলাচের গুঁড়া ও বাদাম ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরি করা হয় এ পিঠাটি৷
ছবি: Farukh Ahmed
চিতই
মূলত শীত কালে এ পিঠাটি বেশ জনপ্রিয়৷ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে এ পিঠার জনপ্রিয়তা রয়েছে৷ চালের গুঁড়া দিয়ে পাতলা ‘কাই’ বানিয়ে খোলায় সেঁকে এ পিঠাটি তৈরি করা হয়৷বিভিন্ন রকমের ভর্তা দিয়ে শীতকালে এ পিঠা খাওয়া হয়৷
ছবি: Amena Anar
দুধ পুলি/দুধ চিতই
দধে চুবিয়ে তৈরি করা হয় বলে এর নাম দুধ পুলি পিঠা৷ চালের গুঁড়ার কাই দিয়ে ছোট ছোট রুটি বানানো হয়৷ তারপর নারকেলের পুর দিয়ে রুটিকে এঁটে দিয়ে জাল দিয়ে রাখা দুধে মিশিয়ে সামান্য আগুনের আঁচে প্রয়োজনমতো জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু এ পিঠাটি৷ একই পদ্ধতিতে বানানো হয় দুধ চিতইও৷
ছবি: Nowrin Akther
চাপড়ি/চাপটি
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলের ভীষণ পরিচিত পিঠা চাপড়ি বা চাপটি৷ চালের গুঁড়ার সঙ্গে ঝাল মশলা মিশিয়েই গোলা তৈরি করে তাওয়ায় পাতলা করে ভাজা হয় এই পিঠা৷ মাংস বা সবজি তরকারি দিয়ে এই চাপটি খাওয়া হয়৷ কোথাও কোথাও চাপড়ি বানানোর সময়েই মাংস তরকারি বা সবজি মিশিয়ে বানানো হয়৷
ছবি: Nowrin Akther
বাহারি চিতই
শুধু চালের গুঁড়া আর লবণ দিয়েই চিতই বানানো হয়৷ এরপর সেই চিতই দুধে ভিজিয়ে কিংবা তরকারি দিয়ে খাওয়া হয়৷ তবে অনেক স্থানেই চিতই গোলানোর সময় ইচ্ছামতো মাংস, সবজি ও ডিম দেওয়ার রেওয়াজ আছে৷ এটি বাহারি চিতই নামে পরিচিত৷
ছবি: Amena Anar
বিবিখানা
দেখতে কেকের মতো এ পিঠাটি চালের গুঁড়া, লবণ, ঘন দুধ, ঘি ও নারকেলের গুঁড়া দিয়ে তৈরি৷ বিক্রমপুরে এ পিঠাটির প্রচলন বেশি৷