মাহবুব উল আলম হানিফ, এমপি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সরকার পরিচালনায় রাজনীতিবিদ ও আমলাদের ভূমিকা নিয়ে, কথা বলেছেন আমলাদের এক্তিয়ারের সীমা নিয়েও৷
মাহবুবউলআলমহানিফ: রাজনীতিবিদরাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনপ্রতিনিধি হয়৷ দেশের মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্খা তারাই বাস্তবায়ন করেন৷ দেশ পরিচালনায় রাজনীতিবিদ অপরিহার্য৷ মুক্তিযুদ্ধ, দেশের স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও অগ্রগতি- যা কিছু অর্জন তা রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে৷ আর সেটা হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে৷ সরকারি কর্মচারিদের কাজ হলো সরকারের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করা৷ সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে গঠন করা হয়৷
কেউ কেউবলেনরজনীতিবিদনাথাকলেদেশচলে , কিন্তুআমলানাথাকলেদেশচলে না...
এটা যারা বলেন তারা বিরাজনীতিকরনের পক্ষে৷ পৃথিবীতে এমন কোনো উন্নত দেশ দেখাতে পারবেন না যে দেশটা রাজনীতি ছাড়া ভালোভাবে চলছে৷ সেটা সম্ভব নয়৷ আমলাদের দিয়ে দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়৷ রাজনীতিবিদরা যে পরিকল্পনা করেন, দেশের মানুষের জন্য আমলারা তা বাস্তবায়ন করেন৷
এটা আমাদেরে দেশের একটা দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে দেশে রাজনীতি ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়েছে ৷ এই দেশে সামরিক এবং বেসামরিক আমলাদের দিয়ে সরকার পরিচালনার চেষ্টা করা হয়েছে৷ জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে রাজনীতি জটিল করার চেষ্টা করেছেন৷ জিয়াউর রহমান প্রায়ই বলতেন আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ানস৷ এরপর এরশাদ ক্ষমতায় এসে একই কাজ করেছেন৷ তারা রাজনীতি সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছেন৷ এসব কারণে দেশে আমলাদের একটা আধিপত্য তৈরি হয়েছে৷ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বিএনপি-জামায়াত স্বাধীনতার পক্ষে ও বিপক্ষে একটা বিভাজন সৃষ্টি করেছে৷ আর এই বিভাজনের কারণেই আমলারা শক্তিশালী হয়েছে৷
এর একটি কারণ আছে৷ এবার করোনা মহামারির কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারবিশ্বই হতভম্ব হয়ে পড়েছে৷ এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তার মধ্যে একটি আছে লকডাউন৷ আর সেকারণে অনেকের আয় বন্ধ হয়৷ সেই সব নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ত্রাণ ,প্রণোদনা, সহায়তা পৌঁছে দিতে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়৷
মাহবুব উল আলম হানিফ
এটাকিজনপ্রতিনিধরাপারতেননা?
তৃণমূল পর্যায়ে মেম্বার, চেয়ারম্যানরা এটা করতে গিয়ে বুঝে হোক আর না বুঝে হোক চাল বা ত্রাণ যখন ভাড়া করা জায়গায় রেখেছেন বা নিজেদের বাড়িতে রেখেছেন, তখন তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট হয়৷ ত্রাণ আত্মসাৎ বা চুরির অভিযোগ ওঠে৷ নেতিবাচক রিপোর্ট হয়৷ একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷ রাজনীতিবিদরা বিতর্কে পড়ে যান৷ এই বিতর্ক যাতে না হয়, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের বিতর্কের বাইরে রাখতেই সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব দেয়া হয়৷
আমার কাছে মনে হয় বয়সের কারণেই আমরা অনেক সময় কথা বলতে গিয়ে স্পিড হারিয়ে ফেলি৷ এটা আসলে কারুর দোষ নয়, বার্ধক্যের দোষ হতে পারে৷ বৃদ্ধ বয়সের একজন মানুষের সব কথা বিবেচনা করা বা সেটা নিয়ে আলোচনা করার দরকার আছে বলে আমরা মনে হয় না৷
আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল৷ আওয়ামী লীগের আমলা-নির্ভর হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷ তবে কোনো কোনো নেতা যারা মন্ত্রিপরিষদে রয়েছেন তাদের অনেকের ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে মনে হতে পারে তাদের চেয়ে আমলারা শক্তিশালী৷ তবে আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল৷ এই দলের কাছে জনগণ কখনো আমলা-নির্ভরতা প্রত্যাশা করে না৷
সেভাবে দেখার সুযোগ নেই৷ এখানে উভয় পক্ষের বাড়াবাড়ি ছিল৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকার কঠোর অবস্থানে গিয়েছে৷ আর দিন শেষে দেখা গেছে রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা নয়৷ এসব ঘটনায় যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷
এটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই৷ কারণ, আমাদের জেনারেল সেক্রেটারি ইতিমধ্যেই বলেছন, যিনি বলেছেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে বলেছেন৷ যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে তার সাথে অধিকাংশ সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তারা একমত নন৷ আর যে বা যারা আন্দোলিত হয়ে এই বিবৃতি দিয়েছেন, তারা তাদের কর্তৃত্বের সমস্ত সীমা লংঙ্ঘন করে এই বিবৃতি দিয়েছেন বলে সবাই মনে করেন৷
লকডাউনের পর ঢাকা যেমন আছে
প্রায় চার মাস ধরে চলা কঠোর লকডাউন শেষে গত ১১ আগস্ট থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে গণপরিবহন, অফিস-আদালত, বিনোদনকেন্দ্র, শপিং মল ও দোকানপাট৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুললেও ঢাকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পুরান ঢাকায় যানজটের পুরাতন চিত্র
পুরান ঢাকার নয়াবাজার এবং বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রচণ্ড যানজট৷নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক পুলিশ জানান, পুরান ঢাকায় দিনব্যাপী প্রচণ্ড যানজট থাকা নৈমিত্তিক ঘটনা৷ স্বাভাবিক কর্মদিবসে তো বটেই, ছুটির দিনেও যানজট সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কাঁচাবাজারে ভিড়
ঢাকার অন্যতম প্রধান কাঁচাবাজারের মধ্যে মিরপুর ১, কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার যথেষ্ট সমাগম রয়েছে৷ কারো মাঝে নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই৷ অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই, কেনাকাটা করছেন গা ঘেঁষে৷ সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে কেউ কেউ তড়িঘড়ি করে মাস্ক পরলেও বাকিরা ছিলেন নির্বিকার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাস্ক পরায় উদাসীনতা
ছেলের চিকিৎসা করাতে কামরাঙ্গীরচর থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে এসেছিলেন মোছা. লিমা খাতুন৷ চিকিৎসাশেষে ফিরে যাওয়ার সময় মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘টিভিতে দেখসি ভাইরাসের এহন তেমন একটা মানুষ মরতাসে না৷ তাই এহন আর মাস্ক পরি না৷ আর এই গরমে মাস্ক পইরা থাকাও কঠিন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
স্বাভাবিক হচ্ছে জীবনযাত্রা
ঢাকার অলি-গলির চায়ের দোকান, বিপণিবিতান, ছোট-বড় হোটেল-রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখা যায়, সেখানে সাধারণ মানুষের আনাগোনা বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে আড্ডা, কেনাকাটা৷ বেশ কয়েকজন ক্রেতা, বিক্রেতা এবং পথচারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, লকডাউন তুলে নেওয়া এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ায় মানুষজন এখন কাজে বের হচ্ছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
গণপরিবহণে উপেক্ষিত সরকারি নির্দেশনা
সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন শিথিল করলেও গণপরিবহণে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী না নেওয়া এবং জীবাণুনাশক স্প্রে দেওয়ার ব্যাপারে কঠোরভাবে নির্দেশনা প্রদান করা হয়৷ কিন্তু কোথাও এ নির্দেশনা মানতে দেখা গেল না৷ সরেজমিনে গিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন পরিবহণের পাশাপাশি খোদ সরকারি পরিবহণ সংস্থা বিআরটিসি’র বাসেও এসব নিয়ম লঙ্ঘনের ব্যত্যয় দেখা গেল না৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জমে উঠছে ফুটপাথের কেনাকাটা
ঢাকার শ্যামলি, গুলিস্তান, ফার্মগেট এলাকায় ফুটপাথে ব্যবসা করেন এমন একাধিক হকারের সাথে কথা বলে জানা যায়, লকডাউন তোলার পর তাদের স্বস্তি কিছুটা ফিরেছে৷ তবে স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না বলেও মন্তব্য করেন অনেকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
খুলে দেওয়া হয়েছে বিনোদনকেন্দ্র
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই গত ১৯ আগস্ট থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে বিনোদনকেন্দ্রগুলো৷ ঢাকার শ্যামলির ডিএনসিসি ওয়ান্ডারল্যান্ডের টিকেট বিক্রয় প্রতিনিধি নাজিফা ইসলাম জানান, স্বাভাবিক দিনের চেয়ে বন্ধের দিনে দর্শনার্থী বেশি আসছেন, যদিও করোনা মহামারির আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ দর্শনার্থীও হয় না৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বিয়ের কেনাকাটায় মন্দা
ঢাকার বাটা সিগনালের বিয়ের সামগ্রীর বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকান ক্রেতাশূন্য৷ কেনাবেচা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে বর-কনে নামক দোকানের স্বত্বাধিকারি মোফাজ্জল হোসেইন বলেন, বিয়ের কেনাকাটার বাজার একদম খারাপ৷ করোনা মহামারির প্রভাবে হাতে টাকা-পয়সা না থাকার কারণে ঘরোয়াভাবেই বিয়ের কাজ সারছেন অধিকাংশ মানুষ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বড় মার্কেটে ক্রেতা সমাগম কম
ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, চাঁদনি চক, নিউ মার্কেটের মতো বড় মার্কেটে ঘুরে দেখা যায় ক্রেতা সমাগম তুলনামূলক কম৷ দোকানের চেয়ে ফুটপাথে বিক্রি বেশি বলে দাবি করেন অনেক দোকানমালিক৷ কারণ জানতে চাইলে বিক্রয়কর্মী শাহাদাত হোসেন বলেন, ফুটপাথের জিনিস আমাদের দোকানের চেয়ে সস্তা৷ যেহেতু মানুষের হাতে পয়সাপাতি নেই, তাই মানুষ সস্তা জিনিস দিয়েই আপাতত প্রয়োজন সারছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ব্যাংকপাড়ায় বাড়ছে ব্যস্ততা
ঢাকার মতিঝিল, কাকরাইল, কারওয়ান বাজারের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্তব্যরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লকডাউনের পর তাদের ব্যস্ততা বহুগুণে বেড়েছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত যেহেতু প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই খুলে দেওয়া হয়েছে, সেই হিসেবে আর্থিক লেনদেনও বেড়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হাসপাতালের এ কেমন চিত্র?
ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, পিজি হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং প্যাথলজি বিভাগে মানুষজন গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন৷ কেন কেউ স্বাস্থ্যবিধি বা নিয়ম মানছেন না জানতে চাইলে কর্তব্যরত এক আনসার সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘‘জায়গার সংকটের কারণে ইচ্ছা থাকলেও নিয়ম মানানো যাচ্ছে না৷ তাছাড়া সাধারণ মানুষ করোনার ব্যাপারে উদাসীন, তাই বারবার সতর্ক করেও লাভ হচ্ছে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই
লকডাউনের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর ঢাকার বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার, গণপরিবহণ ইত্যাদি জায়গা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের সচেতনতা নেই৷ কেউ মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি৷ অধিকাংশ মানুষেরই মুখে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্ব রেখে কাজ করার কোনো প্রবণতা নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আর যেন লকডাউন দেওয়া না হয়
ঢাকার মিরপুর,ফার্মগেট, গুলিস্তানসহ একাধিক জায়গার ব্যবসায়ী এবং খেটে খাওয়া মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, লকডাউনের কবলে তাদের আয় রোজগার শূন্যের কোঠায় প্রায়৷ নিম্ন আয়ের মানুষদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ তারা চাইছেন সরকার যেন সবাইকে টিকার আওতায় আনে এবং লকডাউন আর না দেওয়া হয়৷