1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এতটা স্বাধীন গণমাধ্যম আগে কখনো দেখিনি

ডয়চে ভেলের অতিথি লেখক মাসুদ কামাল৷
মাসুদ কামাল
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই কিছু পরিচিত মুখ যেন হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যায়।

ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে সাংবাদিকদের প্রতিই মানুষের প্রত্যাশা ছিল সবচেয়ে বেশিছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS

শেখ হাসিনা নিজে পালিয়ে যান, তার মন্ত্রীরা পালিয়ে যায়, আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারা কোথায় যেন ডুব মারেন, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন লীগের নেতারাও গর্তে ঢুকে পড়েন। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে দেখা গিয়েছিল, তার পতনের পর মন্ত্রীদের পাশাপাশি সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাও পালিয়েছিলেন! সেটা ছিল একটা বিস্ময়কর ঘটনা। সরকার পতনের পর বিরোধীদলীয় নেতার তো বুক ফুলিয়ে চলার কথা । কিন্তু সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা আ স ম আবদুর রবের ক্ষেত্রে ঘটনটি হয়েছিল উল্টো। তিনি সপরিবারে পালিয়েছিলেন। এবার অবশ্য বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদের পালাননি। তবে পালিয়েছে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। কেন পালালেন তারা? তারা কি নিজেরাই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাদের অপরাধের পাল্লা এতটাই ভারি হয়ে গিয়েছিল যে, না পালিয়ে কোনো উপায় নেই?

অথচ এই সাংবাদিকদের দাপট আমরা লক্ষ্য করেছি। গত ১৬ বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে তাদের উত্থান দেখেছি, প্রভাব দেখেছি। দেখেছি সাংবাদিকের লেবাসে কিভাবে তারা প্রকৃত সাংবাদিকদের অপমান করেছে, কিভাবে সাংবাদিকতার সংজ্ঞাকেই পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আর এসবের বিনিময়ে নিজেরা করেছে তদবির বাণিজ্য, করায়ত্ত্ব করেছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বিদেশে সেকেন্ড হোম করেছে, সন্তানদের বিদেশের ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়েছে। সামান্য সর্দ্দি জ্বরের চিকিৎসার জন্যও চলে গেছে সিঙ্গাপুর বা পশ্চিমা কোনো দেশে।

পতিত এবং পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা অভ্যাস ছিল, বিদেশ থেকে ফিরে প্রায় প্রতিবারই তিনি সাংবাদিকদের নিয়ে বসতেন। নামে সংবাদ সম্মেলন হলেও সেখানে যা হতো, সেটাকে পৃথিবীর কেউই প্রেস কনফারেন্স বলতে পারবেন না। সেখানে মূলত হতো মোসাহেবি আর তৈল মর্দনের প্রতিযোগিতা। বিপরীত দিকে শেখ হাসিনার দিক থেকে আত্ম অহংকারের দুর্বিনীত প্রকাশ, হাসি-ঠাট্টা আর তার দুপাশে দলীয় নেতাদের চুপচাপ ক্লাউনের মতো বসে থাকা। এই দৃশ্য আবার প্রতিটি সরকারি, বেসরকারি টেলিভিশনে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত দেখানো। মানুষ দেখতো আর তাদের মধ্যে বাড়তে থাকতো ক্ষোভ আর ঘৃণা। সেই ঘৃণার বিষয়টা বোধকরি এই সাংবাদিকরাও টের পেতেন। কিন্তু যেহেতু তারা সাধারণ মানুষকে আসলে মানুষই মনে করতেন না, মনে করতেন নিছক কীট-পতঙ্গ মাত্র, কাজেই পাত্তাও দিতেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর, সেই কীটপতঙ্গই যখন ক্ষমতাবান হয়ে গেল, পালিয়ে গেলেন তারা। মহাক্ষমতাবান সেই সাংবাদিকদের আর খুঁজে পাওয়া গেল না। এর মধ্যে দু-একজন আবার পালিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তে বাধাপ্রাপ্ত হলেন, কেউ কেউ দাঁড়ি-গোঁফ কামিয়েও রক্ষা পেলেন না। জনগণ ঠিকই তাদেরকে চিনে ফেললো, আটকে ফেললো।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সুবিধাভোগীদের মধ্যে এই সাংবাদিক নামধারীরাই কি শীর্ষ পর্যায়ে ছিল? তা হয়তো নয়। বরং তালিকা করলে তাদের নাম হয়তো অনেক নিচেই থাকবে। কিন্তু সরকার পতনের পর বিভিন্ন হত্যা মামলা যখন হতে থাকলো, তখন দেখা গেল প্রতিটিতেই দশ-বারো জন করে সাংবাদিকের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এমনো এক মামলা দেখলাম যেখানে ৫৬ জনের মধ্যে ২৯ জনই সাংবাদিক। কেন এমন হলো? কারণটা যে খুবই অস্পষ্ট, তা কিন্তু নয়। আসলে ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে সাংবাদিকদের প্রতিই মানুষের প্রত্যাশা ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রতিটি আন্দোলনেই এরকম হয়। মানুষ মনে করে, তাদের অধিকারের কথাটি সাংবাদিকরা সবচেয়ে আগে তুলে ধরবেন। কিন্তু বাস্তবে সে জায়গায় তারা হতাশ হয়েছে। কেবল যে হতাশা এলো তা নয়, বরং দেখা গেল সাংবাদিকরা উল্টো হাসিনাকে উস্কে দিচ্ছে। তারা একটা পক্ষ হয়ে যাচ্ছে, পক্ষ হয়ে ছাত্রদের আন্দোলনকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার সবশেষ সংবাদ সম্মেলন, যেটা একেবারে আন্দোলনের চরম মুহূর্তে হচ্ছিল, সেখানেও এই একই দৃশ্য দেখা গেল। ফলে ওই সংবাদ সম্মেলনে যত সাংবাদিক ছিলেন, তারা সবাই আন্দোলনকারীদের চোখে খুবই ঘৃণিত হয়ে পড়লেন। তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পারলাম পরে হওয়া মামলাগুলোতে।

এই যে মামলা, কোন কোনটিকে তো প্রায় পাইকারি হারে মামলাও বলা যায়, সেগুলোতে আসামীদের নাম দেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু অনিয়ম যে হয়নি, তা বলা যাবে না। অনেক ধান্দাবাজই এখানে ঢুকে পড়েছিল। ফলে, ঘটনার আশপাশে ছিল না, দূরবর্তী কোনো সম্পর্কও ছিল না, এমন অনেকের নামও আসামীর তালিকায় ঢুকে পড়েছিল। আমার পরিচিত এক সাংবাদিক সেদিন আমাকে দুঃখ করে জানালেন, হাসিনা সরকারের আমলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে তাকে যেতে দেওয়া হতো না, নিষিদ্ধ থাকার কারণে গত সাত বছরে একদিনও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কোনো প্রোগ্রামে যেতে পারেননি, অথচ তারপরও একাধিক মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। এরকম ঘটনা অনেক আছে। হয়তো চারজন দায়ীর সঙ্গে ১৫ জন নিরপরাধীর নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

এরকম ঢালাও মামলার দায় কি নতুন সরকার নেবে? সরকার হয়তো বলবে, এসব মামলা তো আমরা করিনি। কে করেছে, কার প্ররোচনায় করেছে, আমরা জানি না। সরকারের এমন বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি বিষয়গুলো একেবারে শুরুর দিকেই থামিয়ে দিতে পারতো না? সরকার শেষ দিকে অবশ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বলেছে, মামলা হলেই গ্রেপ্তার নয়। আগে তদন্ত করে দেখতে হবে, তারপর কেবল দায়ী হলেই গ্রেপ্তার করা যাবে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের পর অবশ্য ঢালাও মামলা কিছুটা কমেছে। কিন্তু যে কয়টা মামলা এরই মধ্যে হয়ে গেছে, সেগুলো থেকেও  যাতে নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার না হয়, সেসবও দেখার দায়িত্ব কিন্তু এই সরকারকেই নিতে হবে। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও ঠিক, যারা প্রকৃতই অপরাধী, তা সে সাংবাদিকও যদি হয়, তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া জরুরি। এই যে সাংবাদিকদের কথা বলা হচ্ছে, যারা এতদিন সরকারের মোসাহেবি করার জোরে চারদিকে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, তারা যাতে সাজাকে এড়িয়ে আবার নিজ নিজ আসনে এসে দাপটের সঙ্গে বসতে না পারে, সে বিষয়গুলোও সতর্কভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।

নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে দেড় মাস হলো। এর মধ্যে তারা অনেক কিছু করে ফেলেছে, কিংবা অনেক কিছু করে ফেলা সম্ভব—তেমন দাবি করা যায় না। দ্রব্যমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ এসব ক্ষেত্রে তারা আসলে ইতিবাচক তেমন কিছুই করতে পারেনি। তারপরও আজ যখন সাংবাদিক বা গণমাধ্যম নিয়ে লিখছি, তখন বলতেই হয়—সামগ্রিক গণমাধ্যমে কিন্তু আমি খুবই ইতিবাচক একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। গণমাধ্যমকে তারা নিজেদের করায়ত্ত্ব করে রাখতে চাইছে না। গণমাধ্যমের ওপর তারা কোনো হস্তক্ষেপই করছে না। পত্রিকা বা টেলিভিশন, এমনকি সরকারি মালিকাধীন বিটিভিকে পর্যন্ত নিজেদের মতো করে চলার ক্ষেত্রে কোনোরকম বাধা দিচ্ছে না। বেসরকারি গণমাধ্যমগুলোতে এখন আর আগের মতো ‘উপর’ থেকে টেলিফোন আসে না। এটা যাবে, ওটা যাবে না, এটা কেন গেল—এসব বলে এখন আর কেউ ধমকে ওঠে না। বিটিভির একটি খবর বেসরকারি টেলিভিশনগুলোতে প্রচারের যে বাধ্যবাধকতা ছিল, সেটাও এখন উঠে গেছে। এর বাইরে বিটিভি’র কিছু কিছু অনুষ্ঠান দেখে এখন দর্শকরাই বরং বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে লেখাটি শেষ করবো। অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে আমি যাই। যাই মানে, আমন্ত্রণ পাই। ৩৬ বছর ধরে আমি সাংবাদিকতা করছি, গত ২০ বছর হলো নিয়মিত বিভিন্ন টেলিভিশনে গিয়ে নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছি। কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একবারের জন্যও আমাকে বিটিভি থেকে ডাকা হয়নি। এই ডাকাডাকির বিষয়গুলো, যারা এতদিন নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারা যে আমার অপরিচিত ছিলেন, তা-ও নয়। তারা ডাকতেন না এ কারণে যে, তারা আমার অ্যান্টিএস্টাবলিশমেন্ট টাইপ কথাবার্তাকে ভয় পেতেন। সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের সমালোচনা বিটিভিতে করা যাবে—এটা তারা কল্পনাও করতে পারতেন না। সেই কাজ এখন বিটিভিতে অহরহই হচ্ছে। বিটিভি সরকারবিরোধী নয়, তবে কেউ যদি সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করে, সেই সমালোচনাকে তারা গলা টিপে থামিয়ে দিচ্ছে না। এর মাঝে আমি নিজেই দুবার বিটিভির দুটি টকশোতে আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমি আমার মতো করেই কথা বলেছি, সেখানে সরকারের- এমনকি সরকার প্রধানের সমালোচনাও করেছি। পরে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, সেই অনুষ্ঠান তারা কোনো পরিবর্তন না করেই প্রচার করেছে। বিটিভির ইতিহাসে আগে এমন কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

গণমাধ্যমের এমন স্বাধীনতা আগে কখনো আমার চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ে না।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ