এস্টার পেয়ারবান্ড – বার্লিনের নামকরা এক ফ্যাশন ডিজাইনার৷ ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা এস্টারকে নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশে৷ যে দেশ পোশাক শিল্প ও রপ্তানিতে এত দ্রুত এগিয়ে গেছে, সেখানকার শ্রমিকদের অবস্থা আদতে কেমন?
বিজ্ঞাপন
এ প্রশ্নটা বরাবরই জাগতো এস্টারের মনে৷ তাই ঠিক একবছর আগে জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাঁচদিনের জন্য ঢাকা যান এস্টার৷ লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে ছোট্ট একটা তথ্যচিত্র তৈরি করা৷ কিন্তু সেই কাজ করতে গিয়ে যে সব অভিজ্ঞতার মধ্যে এস্টারকে যেতে হয় – তা একদম বদলে দেয় তাঁকে৷
মস্কো আর প্যারিসে পড়াশোনা করেছেন এস্টার পেয়ারবান্ড ৷ পড়াশোনা শেষে রাজধানী বার্লিনে নিজস্ব লেবেলে দোকান খুলেছেন৷ শহরটির মতোই এস্টারের ডিজাইনে রয়েছে ঐতিহ্য আর তারুণ্যের ছোঁয়া৷ রয়েছে রাজনীতির নানা রঙ, ব্যক্তি স্বাধীনতার শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ৷ কিন্তু বাংলাদেশ সফর, সেখানকার সাধারণ মানুষের জীবন এস্টারকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়৷ এই ভিডিও-টা দেখলেই সে কথা বুঝতে পারবেন৷ ইউটিউব-এ দু'লক্ষেরও বেশিবার দেখা হয়েছে ভিডিও-টি৷
(ভিডিও-টা জার্মান ভাষায়৷ কিন্তু কথায় আছে না, ছবির কোনো ভাষা নেই৷ এস্টার যেমন বাংলা না বুঝেই এতটা বুঝেছেন, আপনারাই বা বুঝবেন না কেন?)
‘‘সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা সংস্কৃতি এত কাছ থেকে জীবনে এর আগে কখনও আমি দেখিনি৷'' নিজের ফেসবুকে লিখেছেন এস্টার৷ লিখেছেন, ‘‘প্রথম দু'দিন আমি শুধু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি – পোশাক শ্রমিক, শ্রমিক নেতা, কারখানার ম্যানেজার – অগুন্তি৷ একটার পর একটা ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করেছি, নিজে মেশিনে বসে কাজও করেছি, গেছি এমন সব জায়গায় – যা ছিল অকল্পনীয়৷''
শেষের ক'টা দিন এস্টার শ্রমিক নেত্রী নাজমা আখতারের সঙ্গে কথা বলেন, আবর্জনার স্তূপের মতো দাঁড়িয়ে থাকা রানা প্লাজার সামনে গিয়ে দাঁড়ান, এমনকি পৌঁছে যান পোশাক কর্মীদের বাড়ি...৷ এস্টারের কথায়, ‘‘ওদের বাড়িগুলো (অবশ্য যে ঘরগুলোতে ওরা থাকে, সেগুলোকে বাড়ি বলা যায় কিনা সন্দেহ) দেখেছি৷ দেখছি তারা কীভাবে থাকে, কী খায়...৷ আমি জানতাম, পড়েছিলাম, শুনেছিলাম তাদের অবস্থা৷ কিন্তু নিজের চোখে দেখা যে অন্য জিনিস৷ একটা সময় আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না...৷ অথচ এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ওদের মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো, অবিশ্বাস্য!''
এস্টার ইতিমধ্যে তাঁর ‘ডকুমেন্টারি' শেষ করেছেন৷ বাংলাদেশের পোশাক বর্জন যে কোনো সমাধান নয়, সেটাও বুঝতে পেরেছেন এস্টার৷ কিন্তু তাহলে উপায়? এস্টারের কথায়, ‘‘পোশাক কেনার সময় তুমি কি প্রশ্ন করছো, পোশাকটা কীভাবে তৈরি হয়েছে? শ্রমিকরা পর্যাপ্ত মজুরি পেয়েছে কিনা? আসলে তুমি কী কিনছো, কোথায় কিনছো – সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷''
রানা প্লাজার বিভীষিকার কথা জার্মানরা ভোলেনি...
বন শহরে ছোট্ট একটা জমায়েত৷ উদ্দেশ্যটা কিন্তু বড় এবং মহৎ৷ আয়োজকরা চান, বাংলাদেশের আর কোনো পোশাক কারখানায় যেন মৃত্যুর বিভীষিকা নেমে না আসে৷ সেই লক্ষ্যে সচেতনতা বাড়াতেই ‘স্বচ্ছ কাপড়’-এর দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিল ফেমনেট৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
ক্ষতিপূরণ এবং ন্যায্য মূল্য দাও
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের দুরবস্থা সম্পর্কে ইউরোপকেও সজাগ করেছে৷ বাড়ছে সবার মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ৷ ‘ফেমনেট’ নামের সংগঠনটি সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে৷ জার্মান কোম্পানিগুলো যাতে বাংলাদেশ থেকে কাপড় কেনার সময় ‘ন্যয্য’ দাম দেয় এবং এর মাধ্যমে যাতে শ্রমিকদের দুর্ভোগ কমানোয় ভূমিকা রাখে – এই দাবি তুলছে তারা৷ বুধবার বন শহরে আয়োজিত সমাবেশেও তোলা হয়েছে এই দাবি৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
কারা আপনার পোশাক তেরি করছে তা কি জানেন?
দর্শকদের জন্য স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কিছু নমুনা৷ পোশাকের সঙ্গে সাদা কাগজে বড় করে লেখা হয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জার্মান ক্রেতা কোম্পানিগুলোর নাম৷ এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই রানা প্লাজার ধসে নিহত, আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং পোশাকের ন্যায্য মূল্য দাবি করেছে ফেমনেট৷ কাপড়ের স্ট্যান্ডটির অদূরে একটি ব্যানার, তাতে লেখা, ‘কারা আপনার পোশাক তেরি করছে তা কি জানেন?’
ছবি: DW/A. Chakraborty
বন্ধুর হাত....
কফিনের কাপড় দিয়ে তৈরি ‘বডি ব্যাগ’৷ বুধবারের সমাবেশে মৃতদেহ বহনের কাজে লাগে এমন কিছু ব্যাগও ছিল৷ বাংলাদেশের শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ পায় না৷ অনেক সময় কাজ করতে গিয়ে লাশ হতে হয় তাদের৷ ‘বডি ব্যাগ’-এ হাতের ছাপ দিয়ে রানা প্লাজা ট্র্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণ এবং পোশাক শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দাবি করা হলো৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
সহমর্মী...
স্থানীয় সাংবাদিকদের একজন দায়িত্ব পালন শেষে নিজের হাতদুটোও রংয়ে রাঙালেন৷ ‘বডি ব্যাগ’-এ হাতের ছাপ দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে যে! ‘ক্লিন ক্লথ’ অর্থাৎ স্বচ্ছ পোশাক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে ফেমনেট৷ তাদের সঙ্গে আরো রয়েছে খ্রিশচান ইনিশিয়েটিভ রোমেরো, ইনকোটা-নেটওয়ার্ক এবং স্যুডভিন্ড ফাউন্ডেশন নামের তিনটি সংগঠন৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
৫ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে
স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠন ফেমিনেটের এক কর্মী৷ তাঁর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘বেনেটন, পাঁচ মিলিয়ন ডলার দাও৷’’ তৈরি পোশাক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা ইতিমধ্যে সাফল্যের মুখ দেখেছে৷ ‘পার্টনারশিপ ফর সাস্টেনেবল টেক্সটাইল’ নামের একটি জোট তৈরি হয়েছে জার্মানিতে, যারা শ্রমিকদের স্বার্থকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
চলতে চলতে ছবি তোলা...
পোশাক কারখানার মালিকরা কম মজুরি দিয়ে যে পোশাক তৈরি করে, বিদেশি ক্রেতারা কম দামে যে কাপড় কেনে তাতে তো শ্রমিকের কষ্টের অদৃশ্য কালি লেগেই থাকে! সেই কালিমুক্ত কাপড়ের দাবি পূরণ করতে ফেমিনেট-এর এই ‘স্বচ্ছ কাপড়’ ক্যাম্পেন৷ তাদের সমাবেশের পাশ দিয়ে যাবার সময় ব্যস্ত পথচারীরা থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন৷ কাজের তাড়া ছিল বলে যাঁরা বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি তাঁদের অনেকেই যাবার আগে ছবি তুলে স্মৃতি রেখে দিতে ভুল করেননি৷