জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বলেছেন, তাঁর ভাই জি এম কাদের মহাজোটের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন৷ তাই মহাজোটের সঙ্গে তাঁর আর সেভাবে সম্পর্ক নেই৷ এদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন, এরশাদ এখন সময় পার করছেন৷
বিজ্ঞাপন
এরশাদ মহাজোট ছাড়ছেন এটা অনেক পুরনো খবর৷ তিনি নিজেই গত ২ বছরে অন্তত ১০ বার মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন৷ কিন্তু ছাড়েননি৷ তাঁর স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস সবার জানা থাকলেও তাতে মহাজোট ভেঙ্গে নতুন জোট গঠনের বাস্তব রূপ কবে দেখা যাবে তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকরই৷ এখনো যে সংশয় কেটেছে তা নয়৷ তবে এরশাদকে এখন আগের চেয়ে একটু ‘সাহসী' মনে হচ্ছে৷
দুই নেত্রীর ফোনালাপের আগে প্রধানমন্ত্রী প্রথম যে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি হলেন এরশাদ৷ গণভবনে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে৷ তবে পরদিন এরশাদ এর প্রতিবাদ করেন৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এরপর নতুন জোট গঠনের কথা বলেন এরশাদ ৷ কথা ছিল গত বৃহস্পতিবার নতুন জোটের ঘোষণা আসবে৷ কিন্তু এরশাদ পিছটান দেয়ায় নতুন জোটের দেখা মেলেনি বৃহস্পতিবার৷ এর এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী৷ তিনি এরশাদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘এত বেশি খেলা ভালো নয়৷''
এরপর এরশাদ শনিবার জাতীয় যুব সংহতির অনুষ্ঠানে বললেন নতুন কথা৷ তিনি বলেছেন, ‘‘নির্বাচনে অংশ নিলে সবাই বেঈমান বলবে৷ আবার নির্বাচনে অংশ না নিলে দেশের ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত৷'' তিনি বলেন, ‘‘যেখানেই যাই লোকে বলে, দুই মহিলাকে চাই না৷ আপনাকে ভোট দেব৷ আমি কি যে বোঝা বহন করছি, তা জানি না৷ পথ হারিয়ে ফেলেছি৷ দিশেহারা হয়ে পড়েছি৷ কিন্তু মানুষ মুক্তি চায়৷''
তিনি তাঁর বক্তব্যে মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা না দিলেও অনুষ্ঠান শেষে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘মহাজোটের মধ্যে ছিলেন আমার ভাই (মন্ত্রী জি এম কাদের)৷ তিনি পদত্যাগ করেছেন৷ কাজেই মহাজোটের সঙ্গে আমাদের সেভাবে সম্পর্ক নেই৷ দু'এক দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন জোটের ঘোষণা দেয়া হবে৷''
তবে এরশাদ কি করবেন তা নিয়ে এখনো কথা বলার সময় আসেনি বলে মনে করেন যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এরশাদ সাহেবের শেষ কথা শোনার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে৷'' আর কয়েকদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক দৃশ্য পটে রংধনুর আবির্ভাব হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এরশাদ একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ৷ তিনি আসলে নানা ধরনের কথা বলে সময় পার করছেন৷ তিনি দেখছেন কোন দিকে গেলে তাঁর লাভ হবে৷ তাই তিনি ঠিক এখনই কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না৷''
শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘‘এরশাদ দু'টি বিষয় বিবেচনায় নিচ্ছেন৷ আর তা হল সরকার পরিবর্তন থেকে তিনি কি ফায়দা পাবেন৷ আর শেষ বয়সে তাকে যেন আর কারাগারে যেতে না হয়৷ তাই যারা ক্ষমতায় যাবে বলে এরশাদের কাছে মনে হবে তিনি শেষ পর্যন্ত তাদের দিকেই থাকবেন৷''