প্রায় তিন বছর পর মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন খাতে কর্মী নেয়ার দুয়ার খুলে দিয়েছে। একদিন আগে মালয়েশিয়ায় দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এবারও সিন্ডিকেটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
মালয়েশিয়ায় এর আগে কর্মী পাঠানোর নানা অনিয়মের জন্য দায়ী ১০ রিক্রুটিং এজেন্সিও সক্রিয়। তাদের সাথে যুক্ত আছে মালয়েশিয়ার প্রভাবশালী একটি চক্র। আশঙ্কা করা হচ্ছে এবারও আগের মত ২০-২৫টি এজেন্সির হাতে চলে যাবে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি। আর যদি তাই হয় তাহলে আবারও নানা প্রতারণার মুখে পড়বেন মালয়েশিয়ায় যেতে চাওয়া বাংলাদেশি বেকার যুবকেরা।
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন সাক্ষরিত এমওইউ এ অভিবাসন খরচ কত হবে তা বলা হয়নি। বলা হয়েছে নিয়োগকর্তাই সব খরচ বহন করবেন। আর এজেন্ট ঠিক করবে মালয়েশিয়ার সরকার। আর এই সুযোগে নিয়োগকর্তার নামে অনেক টাকা হাতিয়ে নেয়া হতে পারে। এবার রিক্রুটমেন্ট হবে অনলাইনে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করবে কারা সেটাও চূড়ান্ত হয়নি। বাছাই প্রক্রিয়া কী হবে তাও স্পষ্ট করা হয়নি। আর এইসব প্রক্রিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার আগের সিন্ডিকেট ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে।
এখনো নিশ্চিত করা যায়নি যে, সব রিক্রুটিং এজেন্ট লোক পাঠাতে পারবে, না নির্দিষ্ট কয়েকটি এজন্সিকে কাজ দেয়া হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০-২৫টি এজেন্সিকে দায়িত্ব দিয়ে আরো ২০০-২৫০টি এজেন্সিকে সাব এজেন্ট নিয়োগ করা হবে। এজেন্ট এবং সাব এজেন্ট-এর এই পদ্ধতি অভিবাসন ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেবে।
শরিফুল হাসান
মালয়েশিয়ার সঙ্গে এবার পাঁচ বছর মেয়াদে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ কর্মী নেবেন তারা। এর আগের বার ১০ লাখ লোক নেওয়ার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত নিয়েছে সাত লাখ ২১ হাজার কর্মী।
ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান জানান,"২০০২-২০০৩ সাল থেকে মালয়েশিয়া বেশ কয়েকবার নতুন চুক্তি করেছে আবার বাতিল করেছে। প্রতিবারই তারা বলেছে সিস্টেমের গলদের কারণে প্রতারণা হয়েছে। অনেক বেশি অর্থ আদায় করা হয়েছে। মানব পাচার হয়েছে। এসব অবৈধ কাজে মালয়েশিয়ার সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষের ব্যয় অনেক বেড়ে যায় । যদি এবারও সিন্ডিকেট হয় তাহলে একই অবস্থা হবে।”
অভিবাসন বিশ্লেষক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন মনে করেন," সিন্ডিকেট ক্ষতিকর। আবার বাংলাদেশের এক হাজার ৫০০ রিক্রুটিং এজেন্ট-এর সবার জন্য ওপেন করাও সমস্যা। সবার জন্য ওপেন করলে তারা মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিলাম শুরু করতে পারে। তাই প্রয়োজন যোগ্য এজেন্টদের বাছাই করা।”
আবুল বাসার
এবার অভিবাসন খরচ সর্বোচ্চ এক লাখ ৬০ হাজার টাকা হতে পারে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে। কিরন বলেন,"মালয়েশিয়া যতই বলুক পুরো খরচ নিয়োগকর্তা বহন করবেন বাস্তবে এটা কথার কথা। আমাদের দাবি হলো সরকার নির্ধারিত খরচের বাইরে যাতে কেউ না নিতে পারে এবং যাতে কেউ প্রতারিত না হন।”
অনলাইনে সফটওয়ারের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। তবে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এবার যুক্ত হচ্ছে। তাদের অধীনে কাজ করবে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজন্টরা। তারাই এখানকার এজেন্ট ঠিক করার কথা বলে জানান বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাসার। তিনি বলেন,"যদি সিন্ডিকেট না হয় তাহলে আমরা ধারাবাহিকভাবে জনশক্তি রপ্তানি করতে পারব। কোনো ঝামেলা হবে না। যে টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে চাইলে আরো দুইটি পদ্মাসেতু তৈরি করা যাবে।”
যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি
প্রতি বছরই বাংলাদেশিরা কাজ নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে৷ বৈধপথে বিদেশে যাওয়া এসব প্রবাসীর হিসাব রাখে সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি৷
ছবি: DW
এক কোটি প্রবাসী
বাংলাদেশের ঠিক কতজন নাগরিক প্রবাসে আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ বিএমইটি-র হিসাবে ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তবে কতজন ফিরে এসেছেন সেই পরিসংখ্যান নেই সেখানে৷
ছবি: Positive light
১৪ লাখ কোটি টাকা
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের আয়৷ এর কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভের অঙ্কটাও এখন বেশ শক্তিশালী৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে মাত্র ২৪ লাখ ডলার বা প্রায় ৩৬ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে৷ সেই তুলনায় রেমিটেন্স অনেক বেড়েছে৷ শুধু গত বছরই এসেছে ১৮৩৫ কোটি ডলার বা এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা৷ সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার বা ১৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা৷
ছবি: AFP
এক তৃতীয়াংশ সৌদি আরবে
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর গন্তব্য সৌদি আরব, যেখানে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ৪১ লাখ ৮৪ হাজার বাংলাদেশি পাড়ি জমিয়েছেন৷ ১৯৭৬ সালে মাত্র ২১৭ জন দিয়ে এই শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু৷ ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৫১ হাজার কাজ নিয়ে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে৷ আর চলতি মে পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছেন এক লাখ ৩৪ হাজার জন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
আরব আমিরাতের মন্দা বাজার
শুরুর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতই ছিল বাংলাদেশের বড় বাজার৷ ২০০৮ সালে দেশটিতে একবছরে সবচেয়ে বেশি ৪ লাখ ১৯ হাজার জন বাংলাদেশি গেছেন৷ তবে ২০১৩ সালের পর থেকে এই বাজারটিতে মন্দা চলছে৷ গতবছর মাত্র তিন হাজার ৩১৮ জন দেশটিতে পাড়ি জমানোর সুযোগ পেয়েছেন৷ ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৩ লাখ ৭২ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্য ছিল আরব আমিরাত, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ১৮ ভাগের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/J. Schwenkenbecher
পড়তিতে ওমান
প্রবাসীদের গন্তব্যের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে পারস্য উপসাগরের দেশ ওমান৷ ১৫ লাখ ১৮ হাজার বাংলাদেশি কাজ নিয়ে গেছেন সেখানে৷ তবে গত ৩ বছর ধরে এই বাজারটিতেও প্রবাসী যাওয়ার সংখ্যা কমছে৷ ২০১৬ সালে যেখানে এক লাখ ৮৮ হাজার জন ওমানে পাড়ি জমিয়েছেন, গেল বছর তা নেমে এসেছে ৭২ হাজার ৬৫৪ জনে৷ আর চলতি বছর মে পর্যন্ত গেছেন মাত্র ১৭ হাজার ৪০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/A. Farnsworth
আকর্ষণীয় মালয়েশিয়া
বাংলাদেশিদের কাছে মালয়েশিয়া আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে শুরু করে মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে৷ ২০০৭ সালে সেখানে সবচেয়ে বেশি ২ লাখ ৭৩ হাজার জনের বেশি শ্রমিক কাজের জন্যে গেছেন এশিয়ার দেশটিতে৷ মাঝে এই প্রবণতা কমলেও সম্প্রতি আবার বেড়েছে৷ ২০১৮ সালে দেশটিতে গেছেন প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার জন আর ২০১৯ এ মাত্র ৫৪৫ জন৷ সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি৷
ছবি: picture-alliance/FOTOGRAMMA/M. Alberico
সম্ভাবনার কাতার
২০০৬ সাল পর্যন্তও কাতারের বাজার বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রপ্তানিতে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না৷ তবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিও এখন বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷ কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন সেখানে অনেক বাংলাদেশির জন্যেই কাজের সুযোগ তৈরি করেছে৷ এখন পর্যন্ত আট লাখ ১১ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে কাজ নিয়ে গেছেন৷
ছবি: picture-alliance
দক্ষ শ্রমিকের বাজার সিঙ্গাপুর
দেশের দক্ষ শ্রমিকদের জন্য পছন্দের এক গন্তব্য সিঙ্গাপুর৷ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশটিতে এখন পর্যন্ত চাকরি নিয়ে ৭ লাখ ৯২ হাজার বাংলাদেশি পা রেখেছেন, যা মোট প্রবাসীর ছয় ভাগের কিছু বেশি৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ হাজার জন গেছেন ২০১৩ সালে৷
ছবি: picture-alliance/Global Travel Images
কুয়েতে ৫ ভাগ
বাংলাদেশিদের জন্য কুয়েতের মতো গুরুত্বপূর্ণ এক শ্রমবাজার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলা চলে৷ ২০০৮ থেকে ২০১৩— এই সময়ে মাত্র ৪১৪ জন দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন৷ ২০১৪ সাল থেকে তা বাড়তে শুরু করলেও গত দুই বছর ধরে আবার পড়তির দিকে৷ সব মিলিয়ে ছয় লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি গেছেন কুয়েতে, যা মোট প্রবাসীর প্রায় ৫ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/G. Hellier
পারস্য উপসাগরের দ্বীপে
চার লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্যের দেশ বাহরাইন৷ ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৭২ হাজার মানুষ কাজ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পারস্য উপসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে৷ তবে ২০১৯ সালে গেছেন মাত্র ১৩৩ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.Al-Shaikh
ইউরোপে সর্বোচ্চ ইটালিতে
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে ইটালিতে৷ ২০০২ সাল থেকে সেখানে পাড়ি জমানোর তথ্য আছে বিএমইটির কাছে৷ সে অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫৫ হাজার বাংলাদেশি বৈধ পথে গেছেন পশ্চিম ইউরোপের দেশটিতে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Medichini
11 ছবি1 | 11
তিনি অভিযোগ করেন,"আগে যারা সিন্ডিকেট করেছে তারা ১০০-২০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে রাতারাতি। বেগমপাড়ায় টাকা পাচার করেছে। তারাই এখন আবার সিন্ডিকেট করতে চায়। সেটা হলে মালয়েশিয়া যেতে অনেক টাকা লাগবে। মানুষ প্রতারিত হবে। আবার লোক নেয়া বন্ধ হবে। তবে আশা করি সরকার এবার সেটা হতে দেবে না।”
এদিকে বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ। তিনি আশ্বস্ত করেছেন এবার সিন্ডিকেট হবে না।
বিশ্লেষকেরা বলছেন এখনো চুক্তির বিষয়গুলো এখনো প্রকাশ করা হয়নি। হলে তখন স্পষ্ট হবে যে আসলে কী হতে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বিএমইটির হিসাব মতে এপর্যন্ত মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে প্রায় ১১ লাখ বাংলাদেশি কর্মী গেছেন।