এবারও পারলো না নিউজিল্যান্ড, ভারতই চ্যাম্পিয়ন
৯ মার্চ ২০২৫
ব্রিজটাউন থেকে দুবাই, ২০ ওভারের রোমাঞ্চ থেকে ৫০ ওভারের পানসে হতে বসা ক্রিকেট; বিশ্ব আসরে জয়ী দলের নাম ভারত৷ রোহিত শর্মার নেতৃত্বে মাস আটেক আগে ক্যারিবিয়ানে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত৷ পরের আইসিসি ইভেন্ট চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, সেখানেও ভারত অপ্রতিরোধ্য৷ প্রতিভা অন্বেষণ এবং প্রতিপালন, শক্তিশালী ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো, উঁচু মানের দক্ষতা এবং সবার উপরে তীব্র প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ মানসিকতা ভারতের ক্রিকেটকে নিয়ে গেছে অনন্য চূড়ায়৷ ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের সবগুলো ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকেই হারিয়ে ফাইনালে এসে শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে গিয়েছিল রোহিত শর্মার দল৷ কিন্তু পরের দুটো আসরে সেই একই ভুল আর হয়নি তাদের৷ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের পর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ই প্রমাণ করে, এই সময়ে সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতই সেরা৷
দুবাইতে ফাইনাল শুরুর আগেই নিউজিল্যান্ড খানিকটা ব্যাকফুটে, আসরের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ম্যাট হেনরি চোটের কারণে একাদশের বাইরে৷ তার জায়গায় অলরাউন্ডার নাথান স্মিথ এসেছেন একাদশে, এই আসরে প্রথমবারের মতো তার মাঠে নামা৷ অন্যদিকে ভারত মাঠে নামে অপরিবর্তিত একাদশ নিয়ে৷
রোহিত শর্মার টসভাগ্য বদলায়নি৷ এই নিয়ে টানা ১২ ওয়ানডেতে টসে হারলেন রোহিত, ভাগ বসালেন ব্রায়ান লারার বিশ্বরেকর্ডের কৃতিত্বে৷ নিউজিল্যান্ড দলপতি মিচেল স্যান্টনার নিলেন ব্যাটিং৷
সাত ওভারে নিউজিল্যান্ড বিনা উইকেটে ৫০, রাচিন রবীন্দ্রকে দেখাচ্ছিলো দারুণ আত্মবিশ্বাসী৷ এইটুকু পর্যন্ত ম্যাচটা নিউজিল্যান্ডেরই ছিল৷ বরুণ চক্রবর্তীর বলে মাঠের আম্পায়ার পল রেইফেল আউট দেয়ার পরও রিভিউ নিয়ে বাঁচলেন রাচিন,পরের বলটা মিডউইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ব্যাটে বলে না হলেও বেঁচে যান শ্রেয়াস আইয়ার ক্যাচ ছাড়ায়৷
শুরুটা দেখে ভারতীয় সমর্থকরা বোধহয় ভেবেছেন, আবারও ফাইনালে নিউজিল্যান্ড জুজু ভর করেছে৷ কিন্তু হাওয়া বদলে গেল সেই ওভারেই৷ উইল ইয়ং লেগবিফোর উইকেটের শিকার হলেন বরুণের পঞ্চম বলে৷ ওয়ান ডাউনে নামা কেন উইলিয়ামসন দর্শণীয় চার মারলেও ওয়ানডে ফাইনালের দুর্ভাগ্য কাটাতে পারলেন না৷ ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ১২ রান, ২০১৯ এর ফাইনালে ৩০ আর এবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ১১ রান৷ উইলিয়ামসনকে ফিরিয়েছেন কুলদীপ যাদব৷ তার আগে অবশ্য বিপদজনক হয়ে ওঠা রাচিনকে বোল্ড করেছেন ম্যাচে নিজের প্রথম বলেই।
১০ ওভার শেষ, প্রথম পাওয়ার-প্লে শেষে ১১তম ওভারে কুলদীপকে বোলিংয়ে আনেন রোহিত। প্রথম বলেই উইকেট তুলে নিয়ে অধিনায়কের মান রেখেছেন কানপুরের ছেলে। পরের ওভারে কেন উইলিয়ামসনকেও কট অ্যান্ড বোল্ড করেছেন কুলদীপ। দুটো বড় শিকার নিজের প্রথম দুই ওভারেই বগলদাবা করেছেন কুলদীপ, সহজ করে দিয়েছেন অধিনায়কের কাজটা।
পাওয়ার প্লে'র পরেই ভারতের স্পিনাররা চেপে ধরেন কিউই ব্যাটসম্যানদের। কুলদীপের জোড়া আঘাতের ক্ষত শুকাবার আগেই টম ল্যাথামকে লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে ফেলেন রবীন্দ্র জাদেজা। ৩০ বলে ১৪ করে আউট হয়ে যান ল্যাথাম।
এরপর ড্যারেল মিচেল আর গ্লেন ফিলিপস মিলে খানিকটা স্বস্তি ফেরান কিউই সমর্থকদের মনে৷ দুজনে মিলে পঞ্চম উইকেটে যোগ করেন ৫৭ রান, বল খেলেন ৮৭টি৷ বিপদজনক হয়ে ওঠা জুটি ভাঙ্গেন বরুণ চক্রবর্তী, ফিলিপসকে ৩৪ রানে বোল্ড করে৷ মিচেল একপ্রান্ত আগলে রেখে হাফসেঞ্চুরি তুলে নেন ৯১ বলে, গোটা হাফসেঞ্চুরিতে মাত্র ১টি বাউন্ডারি৷ ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মার্টিন গাপটিলের ৯৫ বলে হাফসেঞ্চুরির পর নিউজিল্যান্ডের হয়ে গত ১১ বছরে মন্থরতম হাফসেঞ্চুরি৷
মোহাম্মদ শামির বলে রোহিতের হাতে ক্যাচ দিয়ে সমাপ্তি ঘটে মিচেলের ১০১ বলে ৬৩ রানের ইনিংসের৷ যদিও অন্যপ্রান্তে মিচেল ব্রেসওয়েল ছিলেন কিছুটা মারমুখী, তার সঙ্গে ড্যারেল মিচেলের ষষ্ঠ উইকেটের জুটিটা ৪৭ বলে ৪৬ রানের৷ শেষ পর্যন্ত ৪০ বলে ৫৩ রানে অপরাজিত ছিলেন মিচেল ব্রেসওয়েল৷ আরেক ‘মিচেল', অধিনায়ক মিচেল স্যান্টনার রান আউট হন আট রান করে৷ সব মিলিয়ে ৫০ ওভারে সাত উইকেটে ২৫১ রানে থামে নিউজিল্যান্ডের ইনিংস৷
জিততে হলে ৫০ ওভারে ভারতকে করতে হবে ২৫২ রান৷ কাজটা খুব সহজ না হলেও একেবারে অসম্ভব কিছু নয়, বরং বলা চলে হাতের নাগালেই৷ সেমিফাইনালেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৬৪ রান তাড়া করে ১১ বল হাতে রেখেই জিতেছিল ভারত, শিরোপা জিততে হলে তো তার চেয়ে ১২ রান কম করতে হবে৷ রান তাড়ায় শুরুতেই একটা ঝড় বইয়ে লক্ষ্যের সঙ্গে ব্যবধানটা কমিয়ে আনার দায়িত্বটা অনেক দিন ধরেই অধিনায়ক রোহিত নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন৷ এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়৷ শুরুতে শুভমান গিল একটু সাবধানী, রোহিত মারমুখী৷ সাত দশমিক দুই ওভারেই দলীয় ৫০ রান উঠে গেল স্কোরবোর্ডে, এই আসরের ভারতের দ্রুততম৷ পাওয়ার প্লে'তে বিনা উইকেটে ৬৪৷ ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই ছক্কা মেরে শুরু করা রোহিত যে ঝড় তুলতেই নেমেছেন সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গোড়াতেই৷ শুভমান গিলের ক্যাচটা ড্যারিল মিচেল হাতে জমাতে পারলে হয়তো জুটিটা অল্পতেই ভেঙ্গে যেত, কিন্তু মিচেল ক্যাচটা ছাড়ায় প্রথম উইকেটের পতন হল ১০৫ রানে, ১৮.৪ ওভারে৷ ৫০ বলে ৩১ রান করে মিচেল স্যান্টনারের হাতে ক্যাচ দিয়ে বিদায় শুভমানের। ওয়ানডাউনে নামা বিরাট কোহলি মাত্র দুই বলে এক রান করে সেই স্যান্টনারের বলেই লেগ বিফোর উইকেটের শিকার, রিভিউ নিয়েও বাঁচলেন না ‘চেজমাস্টার'।
দুই রানে দুটো উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচে ফিরল নিউজিল্যান্ড, দলীয় সংগ্রহে আরো ২০ রান যোগ হতেই রোহিতেরও বিদায়৷ সম্ভাব্য সেঞ্চুরিকে জলাঞ্জলী দিয়ে ডাউন দ্য উইকেটে এসে স্টাম্পড হন, নামের পাশে তখন ৮৩ বলে ৭৬ রান৷ বিনা উইকেটে ১০৫ থেকে ১২২-৩৷ ১৭ রানের ভেতর ৩ উইকেট নিয়ে নিউজিল্যান্ডও বোলিংয়ে হয়ে উঠল আরেকটু আত্মবিশ্বাসী৷ কিন্তু পুরানো সেই দুঃস্বপ্নই ফিরে এল৷ গ্রুপ পর্বের ম্যাচেও শ্রেয়াশ আইয়ার-অক্ষর প্যাটেল জুটি বাঁচিয়ে দিয়েছিল ভারতকে, ফাইনালে ব্যাটিং বিপর্যয়ে সেই দুজনেই ত্রাতা৷ অক্ষরের ৪০ বলে ২৯ রানের ইনিংসের সঙ্গে শ্রেয়াশের ৬২ বলে ৪৮ রান, চতুর্থ উইকেটে দুজনের ৭৫ বলে ৬১ রানের জুটিটাই বিপদ বাড়তে দেয়নি ভারতের৷ বরং এই দুজন মিলে দলকে নিয়ে গেছেন জয়ের বন্দরের বেশ কাছাকাছি।
গ্লেন ফিলিপসের বলে কাইল জেমিসন ছেড়েছেন শ্রেয়াশের সহজ ক্যাচ, অবশ্য ক্ষতিটা বেশি হয়নি কারণ এরপর মাত্র তিন রান যোগ করেই রাচিনের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন এই ডানহাতি ব্যাটার। অক্ষরও ব্রেসওয়েলের বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন৷ আবারও ২০ রানের ব্যবধানে ২ উইকেটের পতন, রান এবং বলের ব্যবধান ক্রমশ কমছে। হার্দিক পান্ডিয়া দ্রুতই ম্যাচটা শেষ করার সম্ভাবনা জাগালেও কাইল জেমিসনের শর্ট বলটায় পুল করতে গিয়ে ১৮ বলে ১৮ রান করে থেমে গেছেন৷ অন্যদিকে লোকেশ রাহুলও বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কেন ঋষভ পান্টের বদলে তাকেই উইকেটের পেছনে এবং সামনে চাইছেন গৌতম গম্ভীর৷ এই আসরে ম্যাচশেষ করে আসার কাজটা ভালভাবেই করেছেন রাহুল, বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪১* আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪২*৷ ফাইনালেও অন্যপাশে উইকেট পতনের ধারা অব্যহত থাকলেও রাহুল ছিলেন অবিচল, মাঠ ছেড়েছেন দলকে জিতিয়েই৷ উইল ও রুর্কের বলে ফাইন লেগ দিয়ে মারা চারে ভারতের শিরোপা নিশ্চিত করেন রবীন্দ্র জাদেজা, ম্যাচ শেষ হতে তখনো ছয় বল বাকি৷
২০১৭ সালে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সবশেষ আসরের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে একপেশে ভাবে হেরেছিল ভারত৷ আট বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফিরেছে মাঠে, স্বাগতিক দেশ ছিল পাকিস্তান৷ তারপরও পাকিস্তানে না গিয়ে, দুবাইর নিরপেক্ষ ভেন্যুতে কোনো ম্যাচ না হেরে শিরোপা জিতল ভারত৷ মধুর প্রতিশোধ বুঝি একেই বলে!
এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জিতলো ভারত। ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে শিরোপা ভাগাভাগি করতে হয়েছিল বৃষ্টির কারণে, তবে এরপর জিতেছে ২০১৩ এবং ২০২৫ সালে৷ নয় আয়োজনের তিনটিতেই শিরোপা জিতে এই আসরের সফলতম দল হিসেবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করলো ভারত, ছাড়িয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার দুইটি শিরোপাকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর-
নিউজিল্যান্ড ৫০ ওভারে ২৫১-৭
ভারত ৪৯ ওভারে ২৫৪-৬
ফল- ভারত ৪ উইকেটে জয়ী