রোজেন মোনটাগ বা গোলাপি সোমবারে রাইনল্যান্ডের উৎসব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে৷ কিন্তু করোনার কারণে গোলাপি সোমবার এবার বর্ণহীন৷
বিজ্ঞাপন
রাইন নদীর ধারে গড়ে ওঠা শহরগুলিকে একসঙ্গে বলে ‘রাইনল্যান্ড’৷ কার্নেভাল সেই রাইনল্যান্ডেরই উৎসব৷ আর রোজেন মোনটাগে কার্নেভাল উৎসব পৌঁছে যায় একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে৷ শীতকালকে বিদায় জানাতেই আয়োজন করা হয় এই উৎসবের৷
প্রতি বছর জার্মনিতে টেলিভিশনের পর্দায় সরাসরি প্রচার করা হয় এই উৎসব৷ কার্নেভাল কোনো ধর্মীয় উৎসব নয়৷ অথচ গত একশ বছর ধরে এই উৎসবটি পালন করা হচ্ছে৷ কোলন, বন ছাড়াও ড্যুসেলডর্ফ এবং মাইনৎস শহরেও কার্নেভালের পরশ লাগে৷ রোজেন মোনটাগে বিশাল প্যারেড বের হয় এসব শহরে৷ কোলনে লাখো পর্যটক ভিড় করেন এই উৎসবে যোগ দিতে৷ পানশালাগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে৷
জার্মানির কার্নিভাল: খ্রিস্ট ধর্মের আগে ও পরে
জার্মানিতে কার্নিভালের মৌসুম মানে বিরাট উৎসব৷ নানা পোশাকে সেঁজেগুজে এ সময়টা মানুষ খুব উদযাপন করেন৷ কিন্তু কে কতটা এর ইতিহাস জানেন? সেই মধ্যযুগ থেকে চলছে এই উৎসব৷ আরো জানতে পুরো ছবিঘরটি দেখুন, পড়ুন৷
ছবি: Reuters/T. Schmuelgen
মধ্যযুগের আগেও
এখন যেই কার্নিভাল হয়, তার সূত্রপাত মধ্যযুগে৷ কিন্তু শীতের শেষ উদযাপনের জন্য জার্মানরা আগেও উৎসব করতেন৷ খ্রিস্টধর্ম আসার আগে লৌহযুগ বা প্রাকমধ্যযুগে ‘হেথেন’ আচারে শীত শেষ হবার খুশি উদযাপন করা হতো৷ তখন জার্মানিক গোত্রগুলো এই উৎসব উদযাপন করত৷
ছবি: www.imago-images.de
দেবতা দিওনিসুসের সম্মানে
রোমান যুগে রাইনের পাড়ের মানুষ বসন্ত এলে মদের দেবতা দিওনিসুসের সম্মানে বিরাট ভোজের আয়োজন করতেন৷ সেখানে প্রচুর মদ্যপান এবং হাসিতামাশা করা হতো৷ সে সময় কয়েকদিনের জন্য সাধারণ মানুষ শাসকগোষ্ঠীর খোলাখুলি সমালোচনা করতে পারতেন৷ কোনো ভয় ছিল না৷ এমন কিছু ঐতিহ্য এখনো আছে৷
ছবি: Reuters/C. Mang
যেভাবে হলো কার্নিভাল
রাইন অঞ্চলে যখন খ্রিস্ট ধর্ম এলো, তখন চার্চ হেথেন উৎসবকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করল৷ একে চার্চের পঞ্জিকায় স্থান দেয়া হলো এবং ‘কার্নিভাল’ নাম দেয়া হলো৷ এটি ল্যাটিন ‘কার্নে লেভারে’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘মাংস ছাড়া’৷ লোক ব্যুৎপত্তিতে এর সংস্কার করে করা হয় ‘কার্নে ভালে’ বা ‘মাংসকে বিদায়’৷ অর্থাৎ, লোকাচার দাঁড়ায় উপবাসের আগে প্রচুর মাংস খেয়ে নাও৷
ছবি: Reuters/C. Mang
উপবাস
ইস্টারের ছয় সপ্তাহ আগে উপবাস শুরু হয়৷ ৪০ দিনের এই উপবাসের আগে কার্নিভাল পালিত হয়৷ উপবাসের সময়টিকে ‘লেন্ট’ বলা হয়৷ চার্চের ভাষায় এ সময় শান্ত থাকা উচিত৷ পানাহারে নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত৷ যিশু খ্রিস্টের ওপর চলা নির্যাতন ও তাঁর মৃত্যুর সময়টিকে সম্মান জানাতেই এই ব্যবস্থা৷ তাই উপবাসের আগে এ অঞ্চলের খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বীরা সর্বোচ্চ মজাটুকু করে নিতে চান৷
ছবি: Reuters/K. Pfaffenbach
প্যারেড ও শ্রেণি বদল
কার্নিভালের একটি বড় ব্যাপার হলো এর প্যারেড৷ নানান পোশাক পরে মানুষ প্যারেডে অংশ নেন৷ পাশে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো মানুষদের দিকে খাবার ও উপহার ছুড়ে দেন৷ শুরুতে এ সময়টায় শ্রেণিবদল করতেই এই আয়োজন ছিল৷ যেমন, সাধারণ শ্রমজীবীরা এ সময় রাজা-রাজপুত্র বা প্রশাসকদের পোশাক পরতেন৷ তাদের আসল পরিচয় ঢাকা পড়ত মাস্কের পেছনে৷ প্যারেড থেকে তারা খাবার ও ওয়াইন ছুঁড়ে দিতেন৷ ক’দিনের জন্য ঠিক রাজাদের মতোই আচরণ করতেন৷
ছবি: Reuters/K. Pfaffenbach
কার্নিভাল প্রতিবাদেরও ভাষা
ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে কার্নিভালকে আনুষ্ঠানিকতা দেয়া হয়৷ সে সময় রাইন অঞ্চল শাসন করতেন প্রুশিয়ানরা৷ কার্নিভালের পুরোনো ঐতিহ্য অনুযায়ী, এ সময় প্রশাসকদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা বা সমালোচনা করা যেতো৷ তাই এ অঞ্চলের মানুষ প্রুশিয়ান সেনাদের পোশাক পরে তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন৷ সেটি ছিল একরকম প্রতিবাদের ভাষা৷
ছবি: Reuters/R. Orlowski
আজকের দিনের কার্নিভাল
আজকের দিনে কার্নিভালে শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরা নানান পোশাক পরে প্যারেডে যোগ দেন৷ এটি জার্মানির বন, কোলন, মাইনৎস, ডুস্যলডর্ফসহ রাইন অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উৎসবের একটি৷ কেউ কেউ এর ধর্মীয় দিকটি মাথায় রাখেন৷ কারো কারো কাছে এটি শুধুই উৎসব৷ মুখোশ, চকোলেট, খেলনা, পানীয় নিয়ে বড় বড় প্যারেড হয়৷ তা বিলানো হয় রাস্তার দু’পাশে মানুষের মাঝে৷
ছবি: Reuters/T. Schmuelgen
7 ছবি1 | 7
সব দোকানপাট থাকে বন্ধ৷ শহরের কেন্দ্রে মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে দেখে প্যারেড৷ ছোট-বড় সবাই নানা ধরনের পোশাকে সেজে মেতে ওঠে চকোলেট সংগ্রহের উৎসবে৷ ‘আলাফ’ আর ‘কামেলে’ শব্দে মুখরিত হয় চারপাশ৷ কেবল যে একটি দিনেই এই উৎসব সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়৷ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিসে এক একদিন উদযাপিত হয় এই উৎসব৷ কার্নেভালের অনেকগুলো দোকান আছে বন শহরে সেগুলোতে মাস ধরে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় নজরে পড়ে৷
আমি থাকি বন শহরের একেবারে কেন্দ্রে৷ গত দুই বছর ধরে বাড়ির জানালা দিয়েই কার্নেভালের প্যারেড উপভোগ করেছি, কারণ বৃষ্টি৷ শহরের কেন্দ্রে থাকার কারণে যে-কোনো উৎসবের আমেজ আগে থেকে টের পাওয়া যায়৷ বাড়ির পাশেই একটা কিয়স্ক থাকায় সপ্তাহখানেক ধরে হৈ হুল্লোড় শুনে বোঝা যেতো কার্নেভাল আসন্ন৷
আর এবার করোনাকালে লকডাউনের কারণে গোলাপি সোমবার যে আসন্ন তা একেবারেই বোঝার উপায় নেই৷ অন্য বছর যেমন দুই-তিন সপ্তাহ আগে থেকেই রাস্তায় বিভিন্ন সাজপোশাকে মানুষকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো, এবার একেবারেই চোখে পড়ছে না৷
করোনার কারণে এবার কার্নেভাল উৎসব বাতিল করা হয়েছে৷ চলছে লকডাউন৷ কিন্তু কোলনে এ বছরও রোজেন মোনটাগে কার্নেভালের আয়োজন হয়েছে৷ তবে এই কার্নেভালে অংশ নিচ্ছে পাপেটরা৷ অর্থাৎ, ১৫ ফেব্রুয়ারি পাপেটদের নানা ধরনের পোশাকে সাজিয়ে বের করা হবে ইনডোর প্যারেড৷ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হবে এটি৷ ৩২ মিটার দীর্ঘ মঞ্চে হেঁটে বেড়াবে ১৫৫টি পাপেট৷
তবে কার্নেভাল না হওয়ায় সবচেয়ে কষ্টে আছে শিশুরা৷ এই লকডাউনে আমরা হোম অফিস করে, বাসার কাজ করে সময় কাটাচ্ছি, কিন্তু শিশুদের অন্য শিশুদের সঙ্গে দেখা করার উপায় নেই৷ কার্নেভালের মতো উৎসবের জন্য যে শিশুরা পুরো বছর মুখিয়ে থাকে, তাদের জন্য এটা বড় কষ্টের, বড় বেদনার৷
২০১৮ সালের আয়োজনের ছবি দেখুন...
গোলাপ সোমবারের কার্নিভাল
জার্মানির বহু অঞ্চলেই ‘রোজেন মোনটাগ’ বা গোলাপি সোমবার পালিত হয়৷ ক্যাথলিক কার্নিভালের যা অন্যতম বৈশিষ্ট্য৷ তবে রাইনল্যান্ডে এই উৎসবের জৌলুস অন্যরকম৷ বিশেষত কোলন এবং বন শহরে৷ বন কার্নিভালের কিছু মুহূর্ত ধরা রইল ক্যামেরায়৷
ছবি: DW/S. Ghosh
রঙিন সাজের দিন
কার্নিভাল মানেই নানা রঙের পোশাক৷ এই দিন বনের মানুষেরা আজগুবি সব পোশাক পরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন৷ পরিচিত মানুষেরাও নিজেদের আর চিনতে পারেন না৷
ছবি: DW/S. Ghosh
ভাল্লুক থেকে নভশ্চর
কেউ ভালুকের পোশাকে তো কেউ নভশ্চর৷ কেউ বা কিম্ভূত কিমাকার৷ কেউ বা সাজে জোকার৷ কার্নিভাল মানে মজার মজার সাজপোশাকে উত্তাল ফুর্তি৷ সঙ্গে বিয়ার পান৷
ছবি: DW/S. Ghosh
প্যারেড এবং চকোলেট
বিভিন্ন সংস্থা তাদের ট্যাবলো নিয়ে চলে আসে সিটি সেন্টারে৷ সেখানেই হয় কার্নিভাল৷ রাস্তার দু’দিকে সকলে দাঁড়িয়ে থাকেন৷ আর ট্যাবলো থেকে দেওয়া হয় রাশি রাশি চকোলেট৷
ছবি: DW/S. Ghosh
ব্যান্ড মাস্টার
প্রতিটি ট্যাবলোর সঙ্গে থাকে ব্যান্ড৷ ছোট থেকে বৃদ্ধ সকলেই ব্যান্ডের তালে তালে প্যারেডে অংশ নেন৷ পাশে দাঁড়ানো দর্শকরাও গেয়ে ওঠেন গান৷
ছবি: DW/S. Ghosh
সাইবেরিয়ার ঘোড়া
যে সে ঘোড়া নয়, রীতিমতো সাইবেরিয়ার৷ কার্নিভালের প্যারেডে দেখতে পাওয়া যায় নানা ধরনের ঘোড়া৷ কেউ টানছে গাড়ি৷ কারোর উপর সওয়ার রাজপোশাকে সজ্জিত মানুষ৷