এবার অরূপের সন্ধানে অলকানন্দা
২২ জুন ২০১৮ভারতীয় ধ্রুপদী নাচের জগতে অলকানন্দা রায় কেবলই আরও একটা বিখ্যাত নাম নয়৷ অলকানন্দা তাঁর নাচের ব্যবহারিক প্রয়োগ করেন জীবনে৷ সেই নাচের মাধ্যমে উত্তরণ ঘটে৷ জীবনের, মনুষ্যত্বের উত্তরণ৷ এর আগে বিভিন্ন কারাগারের বন্দিদের নিয়ে নাচের ওয়ার্কশপ করে, তাঁদের দিয়ে অনুষ্ঠান করিয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন অলকানন্দা৷ কে জানতো, খুনের আসামী, চোর, ডাকাতরাও এমন বিভোর হয়ে মেতে উঠতে পারে সৃজন-আনন্দে! এমনকি ওই পোড় খাওয়া অপরাধীরাও জানতেন না, তাঁদের কঠোর বহিরঙ্গের নীচে সুপ্ত থাকা শিল্পসত্ত্বার কথা৷ যেদিন জানলেন, সেদিন মানুষ হিসেবেও ওঁরা যেন একটু উঁচুতে উঠে, আত্মবিশ্বাসে শিরদাঁড়া টান করে, মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কারা দপ্তর বিশেষ স্বীকৃতি দিয়েছিল অলকানন্দা রায়ের উদ্যোগকে, যা কারাবন্দিদের আত্মগ্লানির এক আশ্চর্য নিরাময় হয়ে উঠেছিল৷ সিনেমা তৈরি হয়েছিল এই নিয়ে৷ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল৷ আরও বেশি লোক জানতে পেরেছিল অলকানন্দা রায় আর তাঁর ‘ডান্স থেরাপি’ সম্পর্কে৷
কাজেই এবারের ২৫শে বৈশাখে রূপান্তরকামীদের রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে গিয়ে অলকানন্দা রায় যখন স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে পা মিলিয়েছিলেন নৃত্যরত শিল্পীদের সঙ্গে, ওঁরাও সাহস করে বলে ফেলেছিলেন কথাটা, ‘‘আপনি আমাদের নাচ শেখাবেন?’’
ডয়চে ভেলেকে অকপটেই জানালেন শিল্পী যে, তখনই ওঁদের হ্যাঁ বলেননি৷ কারণ, মনস্থির করেননি তখনও৷ কিছু ভেবে উঠতে পারেননি হঠাৎ করে৷ আর এখন যখন ভেবেছেন, সায় জানিয়েছেন ওঁদের প্রস্তাবে, তখন পুরো রাস্তাটা হাঁটবেন ওই রূপান্তরকামীদের হাত ধরে৷ কারণ, ‘‘একবার যখন হ্যাঁ বলে দিই, তখন আর আমি পিছু হটি না!’’ প্রত্যয়ী গলায় জানালেন অলকানন্দা৷ এই দৃপ্ত আত্মবিশ্বাসই তিনি নিশ্চিত ছড়িয়ে দেবেন ওই নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে, সমাজের বাঁকা নজরে যাঁদের শিল্পীসত্তার থেকেও বড় হয়ে ওঠে তাঁদের লিঙ্গ পরিচয়৷ বাধ্য করে অসম্মানের রাস্তাতেই হাঁটতে৷ যাঁরা কর্মশালায় শামিল হবেন, তাঁদের মধ্যেই এমন একজন আছেন, যিনি কিশোর বয়স থেকে ভরতনাট্যমের মতো দুরূহ ধ্রুপদী নাচ শিখেও একসময় বাধ্য হয়েছিলেন বিহার, উত্তরপ্রদেশের ‘লৌন্ডা নাচ’ করতে, যে নাচ আদতে বিকৃতকাম পুরুষদের কুৎসিত বিনোদন ছাড়া আর কিছু নয়৷ আছেন এমন অনেকে, যাঁদের নাচের দক্ষতাকে ম্লান করে দেয় তাঁদের বাহ্যিক আচরণের প্রতি সমাজের তীব্র বিতৃষ্ণা৷ প্রশংসা নয়, বিদ্রুপ আর উপহাসই যাঁদের নিয়মিত প্রাপ্য৷
এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে নাচই ওঁদের হাত ধরে টেনে তুলতে পারে, ফিরিয়ে দিতে পারে হারানো আত্মবিশ্বাস৷ এবং রূপান্তরকামীদের নিয়ে এই নাচের কর্মশালার প্রেক্ষিতে একটা খুব জরুরি কথা বলেছেন অলকানন্দা রায়৷ বলেছেন, নাচ মানে তাঁর কাছে শুধুই হাত-পা নাড়া নয়৷ বরং আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করা৷ অলকানন্দা বলছেন, ওঁরা যে যা হতে চান, নারী অথবা পুরুষ, সেই সাজে, সেইভাবেই ওঁরা নাচবেন৷ রূপান্তরকামীদের জন্যে এটা নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ যা হতে চাই, তেমনটাই হতে পারাটা৷ শিল্পের রূপ নয়, সেই অনন্ত অরূপের সন্ধান করবে ওঁদের নাচ৷
২৬ জুন থেকে শুরু হচ্ছে কর্মশালা৷ অলকানন্দা রায় ডয়চে ভেলেকে জানালেন, একই সঙ্গে চলবে কিশোর, অর্থাৎ অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের নিয়ে একটি কর্মশালা, যারা ঘটনাচক্রে চলে এসেছে ভুল পথে৷ জড়িয়ে গেছে অপরাধের সঙ্গে, এখন সংশোধনাগারে আটক৷ তারাও এসে হাত ধরেছে তাঁর৷ অলকানন্দা এসে ওঁদের নাচ শেখাবেন শুনে বলেছে, ‘‘তুমি আসবে তো? আসবে বলে আর এলে না, এমন হবে না তো?’’
‘‘হ্যাঁ, আসব৷’’ কথা দিয়ে এসেছেন অলকানন্দা৷