ইউক্রেন সীমান্তের কাছে মহড়ারত লাখো রুশ সৈন্যকে নিজ ঘাঁটিতে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন৷ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ইউক্রেন সফরকে কেন্দ্র করেই এই নির্দেশ – এমনটাই ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
বিজ্ঞাপন
তবে এটা নিশ্চিত নয় ঠিক কী কারণে পুটিন তাঁর অবস্থান থেকে পিছু হটে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিলেন৷ মঙ্গলবার ভোরে পুটিনের মুখপাত্র রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলোকে জানায় যে, পুটিনের নির্দেশ ইউক্রেন সীমান্তের কাছে যেসব রুশ সেনা মহড়া দিচ্ছিল তারা যাতে নিজেদের মূল ঘাঁটিতে ফিরে যায়৷
এদিকে মঙ্গলবারও ইউক্রেন সেনাদের প্রতিরোধ করতে ক্রাইমিয়ায় অবস্থানরত রুশপন্থিরা সতর্ক বার্তা পাঠাতে ফাঁকা গুলি ছুড়েছে৷ তবে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি৷
সময়সীমা শেষ
এর আগে সোমবার ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া উপদ্বীপে অবস্থানরত দেশটির সেনাদের আত্মসমর্পণ করতে সময়সীমা বেঁধে দেয় রাশিয়া৷ এরই মধ্যে সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে৷ সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার পর রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভ্লাদিমির আনিকিন সোমবার বলেন, এমন কোনো ‘আল্টিমেটাম' বা সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি৷
কেরির সফর এবং নিষেধাজ্ঞা
ইউক্রেনের নতুন সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমর্থন জানাতে রাজধানী কেয়েভে গেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি৷ এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বৃহস্পতিবারের মধ্যে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে রাশিয়াকে সব সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে৷ অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে রাশিয়াকে৷ প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউরেনিয়াম এবং কয়লা শিল্পের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে৷
এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সোমবার রাশিয়ার আচরণকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে৷ এমনকি মার্কিন কংগ্রেসে নতুন ইউক্রেন সরকারকে সহায়তা দিতে অর্থ সহায়তা অনুমোদনের প্রস্তাব দেন তিনি৷
হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, সোমবার রাতে দু'ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাথে বৈঠক করেছেন ওবামা৷ সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেরি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেলের সাথে ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন তিনি৷
এরপরই পেন্টাগন রাশিয়ার সাথে যৌথ মহড়া, দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, বন্দর সফর এবং সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেয়৷ মার্কিন এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, রাশিয়ার সাথে কোনো ধরনের বাণিজ্য সম্পর্কে যাবে না যুক্তরাষ্ট্র৷ এদিকে মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস বলেছেন, রাশিয়া যদি তার অবস্থান থেকে না সরে তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ যৌথভাবে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিবে৷
ইয়ানুকোভিচের পলায়ন, টিমোশেঙ্কোর মুক্তি
কখনো কখনো সময়ের পরিবর্তন দেখে অবাক হতে হয়৷ ইউক্রেনের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ এখন পলাতক আর তাঁর প্রতিপক্ষ টিমোশেঙ্কো কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ক্ষমতায় ফেরার অপেক্ষায়৷ এই নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ভীষণ ক্লান্ত, তাতে কী!
কারাগারে আড়াই বছর কাটিয়ে ইউলিয়া টিমোশেঙ্কো ভীষণ ক্লান্ত৷ তবে বড় কথা হলো, গত শনিবার থেকে তিনি মুক্ত৷ তাঁর রাজনৈতিক শত্রু বলে পরিচিত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতা হারানোর পরপরই রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে পালিয়েছেন৷ প্রায় একই সময়ে মুক্ত জীবনের আস্বাদ পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী টিমোশেঙ্কো ফিরেছেন কিয়েভে৷ কে বলবে কয়েকদিন আগেও পিঠের প্রচণ্ড ব্যথা সইতে না পেরে খারকিভের হাসপাতালে ভর্ত্তি হতে হয়েছিল তাঁকে!
ছবি: Reuters
ঐতিহাসিক সংসদ অধিবেশন
গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের আসন এমনিতেই টলে গিয়েছিল৷ তাই ইউক্রেনের সংসদ ভেরহোভনা রাডায় বিরুদ্ধে অভিসংশনের প্রস্তাব পাশ হওয়ায় পালানো ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর৷ একই অধিবেশনে কারাবন্দী টিমোশেঙ্কোকে মুক্তি দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়৷ ঐতিহাসিক এ অধিবেশনে ইউক্রেনের সংসদ সদস্যরা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনও চূড়ান্ত করেছেন৷ আগামী ২৫শে মে নির্বাচন হবে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে৷
ছবি: Reuters
সংগ্রামমুখর কয়েকটি বছর
নিজের মুক্তির দাবি আদায়ের জন্য এতদিন চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি ৫৩ বছর বয়সি টিমোশেঙ্কো৷ কারাগারে অনশন ধর্মঘট করেছেন বেশ কয়েকবার৷ পরিবারের সদস্যরা তাঁর পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছেন দেশে-বিদেশে৷ কারাগারে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন টিমোশেঙ্কো৷ অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিতে হয়েছিল বার্লিনের শারিটে হাসপাতাল থেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রাজনৈতিক সুবিচার
গত কয়েকবছর ধরে ইউক্রেন সরকার এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সম্পর্কের মাঝে কাঁটা হয়ে ছিলেন ইউলিয়া টিমোশেঙ্কো৷ দু’দফা ক্ষমতায় ছিলেন তিনি৷ তখন ইউক্রেনকে ইইউ-র অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছেন অবিরাম৷ সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ ইইউ-র সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর না করায় দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়, সেই চুক্তির শর্তের মধ্যে টিমোশেঙ্কোর মুক্তির বিষয়টিরও উল্লেখ ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্ট্রাসবুর্গের ভর্ৎসনা
টিমোশেঙ্কোকে কারাদণ্ডাদেশ দিয়ে ইউক্রেনের আদালত শুধু যে ইইউ-র সমালোচনার শিকার হয়েছে, তা কিন্তু নয়৷ ২০১৩ সালে এক ঘোষণায় স্ট্রাসবুর্গে অবস্থিত ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত জানায়, ইউক্রেনের আদালত টিমোশেঙ্কোর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে৷ ঘোষণায় আরো বলা হয়, টিমোশেঙ্কোকে অযৌক্তিকভাবে কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত৷
ছবি: Patrick Hertzog/AFP/Getty Images
ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত
২০১১ সালের আগস্ট মাসে টিমোশেঙ্কোকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় তাঁকে৷ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাশিয়ার গ্যাস কম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করার কারণে এই শাস্তি দিয়েছিল আদালত৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
প্রতীকী ব্যক্তিত্ব
ইউক্রেনের অনেক মানুষের কাছে টিমোশেঙ্কো দশ বছর আগের ‘কমলা বিপ্লব’-এর প্রতীকী ব্যক্তিত্ব৷ গণতন্ত্র মুক্তির সেই আন্দোলনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল৷ সেই সুবাদে দু-দুবার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন তিনি৷
ছবি: Reuters
ভালো-মন্দে মেশানো অতীত
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বে টিমোশেঙ্কোর এখনো খুব সমাদর৷ তবে বিনুনি কাটা চুলের এই রাজনৈতিক নেত্রী প্রধানমন্ত্রী হবার পর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি৷ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: SERGEI SUPINSKY/AFP/Getty Images
বিক্ষোভেও তিনি ছিলেন
ইউক্রেনের সাম্প্রতিক বিক্ষোভে বিক্ষোভকারীদের হাতে হাতে ছিল টিমোশেঙ্কোর ছবি৷ কারামুক্তির পর টিমোশেঙ্কো ফিরেছেন কিয়েভে৷ ফিরেই জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন৷ ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে শাস্তি পাওয়া টিমোশেঙ্কো তাই আবার ক্ষমতায় ফেরার অপেক্ষায়৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
এদিকে, জেনেভায় জাতিসংঘের অধিবেশনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, কিয়েভের নতুন কর্তৃপক্ষ সেখানকার সংখ্যালঘুদের মৌলিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছে, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে৷ তিনি পশ্চিমাদের হুমকি, নিষেধাজ্ঞা এবং বয়কটেরও নিন্দা জানান৷
মঙ্গলবার ক্রেমলিন জানায়, ইউক্রেনের কারণে যদি যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যাংককে ঋণ দেয়া হবে না৷ এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে তবে একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়েছে ক্রেমলিন৷
অন্যদিকে, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের কথা হয়েছে৷ এ সময় পুটিন ইউক্রেন নিয়ে আলোচনার জন্য একটি প্রতিনিধিদল গঠনে রাজি হয়েছেন৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল বলেছেন, ‘‘ক্রাইমিয়ায় যা ঘটছে, তা নিয়ে আমরা বিশেষভাবে চিন্তিত৷''