ভারতের উপহারের ২০ লাখসহ মোট ৭০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড টিকা এখন বাংলাদেশের হাতে৷ তা দিয়েই বুধবার শুরু করোনা টিকাদান কর্মসূচি৷
বিজ্ঞাপন
কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তবে বুধবার, ২৭ জানুয়ারি শুরু হলেও ব্যাপকভাবে টিকা দেয়া হবে আগামী মাস থেকে৷
বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি এই কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন৷ প্রথম দিন ২০-২৫ জনকে টিকা দেয়া হবে৷ পরের দিন ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে আরো ৫০০ জনকে এই টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে৷ শুরুতে যারা টিকা পাচ্ছেন, তাদের উপহারের টিকা থেকে দেয়া হচ্ছে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক এবং করোনা টিকা কর্মসূচির মুখপাত্র ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, ‘‘প্রথম যে ২০-২৫ জন টিকা পাচ্ছেন, তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন পেশার ফ্রন্ট লাইনার আছেন৷ তাদের তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়েছে৷ পরের দিন পাঁচটি হাসাপাতালে শুধু ৫০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেয়া হবে৷’’
এরপর সাত দিন বিরতি দেয়া হবে৷ ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে টিকা দেয়া শুরু হবে৷ সেটাই মূল কর্মসূচি৷
ডা. নাজমুল ইসলাম
বুধবার উদ্বোধনের পর ঢাকার যে পাঁচটি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার টিকা দেয়া হবে সেগুলো হলো: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী জেনারেল হাসপাতাল , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, টিকায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে এটা ধরে নিয়েই টিকা দেয়া হচ্ছে৷ জাতীয় ইম্যুনাইজেশন কর্মসূচির চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ আছে৷ করোনা টিকার জন্য বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়েছে৷ যেসব হাসপাতালে টিকা দেয়া হবে, সেখানে মেডিক্যাল টিম থাকবে৷ ওই টিমে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকবেন৷
বুধবার থেকে ভ্যাকসিনের নিবন্ধন অ্যাপটি কাজ শুরু করবে৷ এই অ্যাপে ভ্যাকসিন পেতে হলে নিবন্ধন করতে হবে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷ ৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে শুরু হতে যাওয়া টিকা কর্মসূচিতে ৪২ হাজার কর্মী কাজ করবেন৷ তার মধ্যে ১৪ হাজার টিকা দেবেন৷ বাকিরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করবেন৷ স্বেচ্ছাসেবকরা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির৷ আর যেসব হাসপাতালে এই টিকা দেয়া হবে তাদের জনবলও এই কর্মসূচিতে যুক্ত থাকছে৷
এদিকে করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশের কিছু মানুষের মধ্যে এখনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে৷ নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৪.৬ শতাংশ নাগরিক একটি কার্যকর, নিরাপদ, চিকিৎসক কর্তৃক সুপারিশকৃত টিকা নিতে চায় বিনামূল্যে৷ ৭.৮ শতাংশ নাগরিক একেবারেই টিকা নিতে ইচ্ছুক নন এবং ১৭.৬ শতাংশ নাগরিক টিকা নেবেন কিনা এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত৷ ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে ৩ হাজার ৬৪৭ জন নাগরিকের ওপর পরিচালিত জরিপ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে৷
ডা. লেলিন চৌধুরী
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘‘টিকা নিতে চান না, দ্বিধাগ্রস্ত এরকম মানুষ সারা বিশ্বেই আছে৷ আবার টিকা দেয়া শুরু হলে এদের সংখ্যা কমে আসে৷ টিকার কার্যকারিতা আস্থা বাড়িয়ে দেয়৷’’
তিনি বলেন, কেউ কেউ মনে করেন, টিকার কার্যকারিতা থাকবে ছয় মাস থেকে এক বছর, তাহলে টিকা নিয়ে লাভ কী? এই চিন্তা ঠিক নয়৷ কারণ, এই সময়ে টিকার কারণে করোনা সংক্রমণ কমে যাবে৷ ফলে করোনাও কমে যাবে৷ এক সময়ে করোনা গুরুত্বহীন সর্দি-কাশির মতো হয়ে যাবে৷
তার মতে, ‘‘এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে টিকার প্রস্তুতি ভালো৷ তবে নিবন্ধনের জন্য অ্যাপের বিকল্প থাকতে হবে৷ আর জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়াও অন্য বিকল্প ডকুমেন্ট গ্রহণ করা উচিত৷'' তিনি বলেন, অনেকেরই অ্যাপ থেকে নিবন্ধন করার মতো ফোন বা প্রযুক্তি নেই৷ আর যার কোনো ডকুমেন্ট নেই, সে যেন ইউপি চেয়ারম্যানের সনদ নিয়ে নিবন্ধিত হতে পারে৷
বাংলাদেশে বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে মোট তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনছে৷ তার ৫০ লাখ ডোজ সোমবার এসেছে৷ এরপর প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ আসবে৷ আরো হাতে আছে উপহারের ২০ লাখ ডোজ৷ ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার কথা রয়েছে৷
করোনা ভ্যাকসিনের যত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বিশ্বের অনেক দেশে শুরু হয়েছে করোনার টিকাদান৷ তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী সেটি নিয়ে এখনও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
সাধারণ প্রতিক্রিয়া
যেকোন টিকারই সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে৷ যেমন, শরীরে ইনজেকশন দেয়ার স্থানটি লাল হয় বা ফুলে যায়৷ তিনদিনের মধ্যে অবসাদ, জ্বর, মাথা ব্যাথা, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যাথা হতে পারে৷ তবে এর কোনটিই দীর্ঘস্থায়ী নয়৷ শরীরে টিকার কার্যকারিতা শুরু হলে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ায় এমন প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক৷ অনুমোদন পাওয়া করোনা ভ্যাকসিনগুলোর ক্ষেত্রেও এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে৷
ছবি: Mark Lenninhan/AFP/Getty Images
গুরুতর প্রতিক্রিয়া
বিরল হলেও কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা থাকে৷ যেমন, যুক্তরাজ্যে টিকা কর্মসূচি চালুর পর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুইজনের অ্যালার্জি দেখা দেয়৷ দেশটির কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সমস্যা যাদের আছে তাদেরকে সতর্ক করেছে৷ তবে সার্বিকভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণেই করোনার বিভিন্ন টিকার অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি, যুক্তরাজ্যের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
টিকার উপাদান
সাধারণত টিকায় দুর্বল বা মৃত ভাইরাস থাকে৷ যার মাধ্যমে শরীর সেই ভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে৷ তবে করোনার টিকাগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রথমবারের মতো এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি৷ এতে কোন ভাইরাস থাকে না৷ তার বদলে কোভিড-১৯ এর জীবাণুর ব্লুপ্রিন্ট বা প্রতিরূপ থাকে৷ তাই দুই ধরনের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দুই রকম হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
বায়োনটেক-ফাইজার
অনুমোদন পর্যায়ে বায়োনটেক-ফাইজার উদ্ভাবিত টিকার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি৷ কোন কোন ক্ষেত্রে টিকা গ্রহীতা সাময়িক অবসাদ আর মাথা ব্যাথায় ভুগেছেন৷ এমআরএনএ ভ্যাকসিনটির ব্যবহার শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে একজন ও ব্রিটিনে দুইজনের ত্বক লাল হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল৷ যাদের অ্যালার্জি সমস্যা রয়েছে তাদেরকে সতর্ক করেছে বিট্রিশ মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি৷
ছবি: Jacob King/REUTERS
মডার্না
বায়োনটেক-ফাইজারের মতোই এমআরএনএ ভিত্তিক মডার্নার টিকাটি৷ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই টিকাগ্রহীতাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি৷ হালকা যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে সেগুলো ছিল সাময়িক৷ তবে ১০ শতাংশ অবসাদে ভুগেছেন বলে জানিয়েছে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক প্যানেল৷ অল্প কয়েকজন রোগী অ্যালার্জি ও মুখের স্নায়ু নিষ্ক্রিয় হওয়ার মতো জটিলতায় ভুগেছেন৷ তবে কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি৷
ছবি: Dado Ruvic/Reuters
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে একজন মেরুদণ্ডের প্রদাহে ভুগেছেন৷ সেপ্টেম্বরে এই ঘটনার পর কিছুদিন ট্রায়াল বন্ধ ছিল৷ কিন্তু পরে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরীক্ষার পর জানিয়েছে সেটির কারণ ভ্যাকসিন নয়৷ এছাড়া টিকাটি নেয়ার পর ইনজেকশনের স্থানে ও পেশিতে ব্যথা, মাথাব্যাথা ও অবসাদগ্রস্ততার মতো সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে৷ তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক কম ছিল৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/J. Porzycki
স্পুটনিক ফাইভ
তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরুর আগে গত আগস্টেই নিজেদের টিকা স্পুটনিক ফাইভ এর অনুমোদন দেয় রাশিয়া৷ দুই ধরনের পরিবর্তিত অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে এতে৷ রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জ্বর, মাথাব্যাথার মতো টিকাটির কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে৷ তবে কোন গুরুতর প্রতিক্রিয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি৷ তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ না করার অভিযোগ রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে৷
ছবি: Sergei Karpukhin/TASS/dpa/picture alliance
দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত যত তথ্য জানা গেছে সেগুলোর কোনটিই আসলে পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরছে না৷ দীর্ঘ মেয়াদে টিকাগুলোর ব্যবহার মানবদেহে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তা অজানা৷ সেটি হয়ত সামনের মাস বা বছরগুলোতেই পরিস্কার হবে৷