পরিবেশের উপর মাংসের কুপ্রভাব ও বেড়ে চলা জনসংখ্যার প্রোটিনের চাহিদার সমাধানসূত্র হিসেবে পোকার কদর বেড়ে চলেছে৷ ইটালিতে ঝিঁঝিঁর ময়দা মিশিয়ে পিৎসা তৈরির চেষ্টা চলছে৷
বিজ্ঞাপন
এক খামারে হাজার হাজার ঝিঁঝিঁ পোকা পালন করা হচ্ছে৷ সেগুলি পিৎসার টপিং হিসেবে শোভা পাবে৷ কারো কাছে সেটা একটা দুঃস্বপ্ন মনে হলেও কার্লো দেল বুয়োনো ও জোসে চানির মতে, সেই ব্যবসার ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল৷ নিউট্রিইনসেক্ট ক্রিকেট ফার্মের চানি বলেন, ‘‘এই ঝিঁঝিঁ পোকাগুলির আজই জন্ম হয়েছে৷ জীবনের প্রথম দিন! প্রথম তিন বছরের গবেষণার ফল হিসেবে আমরা প্রতিটি প্লাস্টিকের আধারের জন্য ঝিঁঝিঁপোকার নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ণয় করতে পেরেছি৷ কারণ পোকাগুলি জীবনের প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই থাকবে৷''
ইটালির কেন্দ্রভাগে মন্টেকাসিয়ানোয় এক পুরানো গুদামে জোসে চানি এক বন্ধুর সঙ্গে নিউট্রিইনসেক্ট নামের স্টার্টআপ কোম্পানি খুলেছেন৷ জার্মানি থেকে ১০,০০০ ঝিঁঝিঁ পোকা আমদানির মাধ্যমে সেই অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়েছিল৷ সেটাই ছিল বিদেশ থেকে প্রথম এবং শেষ আমদানি৷ তখন থেকেই ক্রিকেট ব্রিডিং প্রক্রিয়া চলছে৷ জোসে চানি বলেন, ‘‘এই আধারে প্রায় দশ হাজার ক্রিকেট রয়েছে৷ অর্থাৎ সেটা দিয়ে আমরা এক কিলো ক্রিকেট ময়দা তৈরি করবো৷ তার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ প্রোটিন৷ প্রতি কিলোগ্রাম ক্রিকেটের জন্য মাত্র পাঁচ লিটার পানির প্রয়োজন হয়৷ মনে রাখতে হবে, এক কিলো গরুর মাংসের জন্য পনেরো হাজার লিটার পানি লাগে৷''
পিৎসার টপিং ঝিঁ ঝিঁ পোকা
04:28
জোসের মতে, এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালানো হচ্ছে৷ তিনি মাসে দুই টন ক্রিকেট ফ্লাওয়ার উৎপাদন করেন৷ চলতি বছরের শুরুতেই ইটালি মানুষের খাদ্য হিসেবে ঝিঁঝিঁপোকার ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে৷ এরই মধ্যে চানি অর্ডারের চাপ সামলাতে পারছেন না৷
এই পোকার আয়ু ৩০ দিনের মতো৷ সেই প্রাণীর ঘুমিয়ে পড়া ও মারা যাওয়া পর্যন্ত এক রেফ্রিজরাটর যন্ত্রে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমানো হয়৷ ব্যবসায়ী হিসেবে চানির দাবি, এর ফলে পোকাগুলি বিনা যন্ত্রণায় মারা যায়৷
কাছেরই এক কোম্পানি সেই পোকা গুঁড়া করে ময়দায় রূপান্তরিত করে৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই ধূসর পাউডার কি ইটালির রন্ধনপ্রণালীর পবিত্র জগতে প্রবেশ করতে পারবে? শুরুতে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার আশা করা হচ্ছে৷
রোমের উপকণ্ঠে নিজের পিৎসেরিয়ায় কার্লো দেল বুয়োনো এমন ক্রিকেট পিৎসা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন৷ প্রচলিত পিৎসার মণ্ডে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ক্রিকেট ফ্লাওয়ার যোগ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন৷ হাতেনাতে সেই প্রক্রিয়া দেখিয়ে কার্লো বলেন, ‘‘এবার আমি ময়দার তাল বেলে নিয়ে তার উপর আমাদের ক্রিকেট ফ্লাওয়ার ছড়িয়ে দিচ্ছি৷ প্রচলিত ডো-এর সঙ্গে ভালোভাবে যাতে মেশে, তার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি৷ আমরা সবজি ও একটু মোৎসারেলা চিজ দিয়ে একটা পিৎসা তৈরি করছি৷''
টমেটো সস, মোৎসারেলা ও নানা ধরনের সবজি এবং অল্প ক্রিকেট পাউডার৷ এখনো সেই উপকরণ বেশ দামী৷ কারণ এক কিলো ক্রিকেট ফ্লাওয়ারের দাম ৬০ ইউরো৷ অর্থাৎ এর বৃহত্তর ব্যবহারের জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে৷
গুস্তাভ হ্যোফার/এসবি
পোকামাকড় যেভাবে আমাদের উপকার করছে
দুনিয়াতে যদি পোকামাকড় না থাকে তাহলে আমাদের জন্য কফি তো থাকবেই না, বরং ক্রমশ খাদ্যাভাবে আমরা হয়ে যাবো দুর্বল৷ গবেষকরা বলছেন পোকামাকড়ের দশ শতাংশ প্রজাতি আগামী কয়েক দশকের মধ্যে হারিয়ে যাবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Pleul
পোকামাকড়ের পৃথিবী
সুন্দর প্রজাপতি থেকে বিরক্তিকর মশা অবধি পোকামাকড়ের জগতটা খুবই বৈচিত্র্যময়৷ এখন অবধি যতটা জানা গেছে তাতে পোকামাকড়ের প্রায় দশলাখ প্রজাতি রয়েছে এবং আরো অনেক প্রজাতি এখনো আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে৷ তবে সম্প্রতি বায়োলজিক্যাল কনজার্ভেশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, পোকামাকড়ের চল্লিশ শতাংশের বেশি প্রজাতি এখন হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে৷
ছবি: Imago Images/Xinhua
দক্ষ পরাগবহণকারী
গমের মতো শষ্য পরাগায়নের জন্য বাতাসের উপর নির্ভরশীল হলেও অনেক খাদ্যশস্য আছে যেগুলো পরাগায়নের জন্য পোকামাকড়ের উপর নির্ভরশীল৷ ফলে তারা হারিয়ে গেলে কৃষকরা বিপাকে পড়বেন৷ বছরে বিশ্বের ২৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ খাদ্য উৎপাদন পরাগায়নের উপর নির্ভরশীল৷ বিপদের কথা হচ্ছে, মৌমাছির অভাবের কারণে চীনের কিছু খামারে এখন আপেলসহ বিভিন্ন গাছের পরাগায়নে শ্রমিক ব্যবহার করতে হচ্ছে৷ ফলে খাবারের দাম বেড়ে যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/K. Frayer
খাদ্যের অভাব দেখা দেবে
পরাগবাহী পোকামাকড় হারিয়ে গেলে অনেক শাকসবজি এবং ফলমূল উৎপাদন আর সম্ভব হবে না৷ ফলে আমাদের খাবার টেবিলে খাবারের পরিমাণ কমে আসবে৷ এমনকি চকলেট এবং কফির সংকটও দেখা দেবে৷
ছবি: AFP/R. Arboleda
প্রকৃতি পরিষ্কার রাখে যারা
গুবরে পোকার মতো অনেক পোকামাকড় মৃত গাছপালা, মরদেহ এবং মল পচতে সহায়তা করে৷ এই পোকামাকড় না থাকলে পচন প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘায়িত হবে, যা পরিবেশ এবং মানুষ - উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হবে৷
ছবি: Imago Images/blickwinkel
অন্য প্রাণীর খাবার
বিভিন্ন উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মূল খাবার পোকামাকড়৷ ফলে পোকামাকড় কমলে তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীও কমতে থাকবে৷ পক্ষীবিদরা মনে করেন, যুক্তরাজ্যে পাখির বিভিন্ন প্রজাতি কমে যাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে পোকামাকড় কমে যাওয়া অন্যতম কারণ৷
ছবি: Imago Images/blickwinkel
কীটপতঙ্গ বাড়বে
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া অনেক পোকামাকড়ের জন্য কঠিন ব্যাপার৷ যেমন ভোমরা মূলত ঠান্ডা এবং স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে অভ্যস্ত৷ ফলে অপেক্ষাকৃত গরম আবহাওয়ায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে৷ আবার ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যেতে পারে, যা কৃষকের বিপদ বাড়াবে৷
ছবি: Imago Images/Design Pics/J. Wigmore
পরাগবহণকারীদের কোনো স্থান নেই
ইউরোপে পোকামাকড় কমে যাওয়ার পেছনে অতিরিক্ত চাষাবাদ এক কারণ৷ সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পোকামাকড় কমে যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/N. Safo
পোকামাকড়ের বসতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে একফসলী চাষের পোকামাকড়বান্ধব কৃষি নীতি গ্রহণ করলে পোকামাকড় রক্ষা সম্ভব হবে৷ পাশাপাশি বাগানে এবং শহুরে অঞ্চলে ফুল গাছ লাগিয়ে পোকামাকড় টিকিয়ে রাখায় ভূমিকা রাখা সম্ভব৷