বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও থানার উত্তর গোড়ান এলাকায় বাসায় ঢুকে ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের একজন সক্রিয় কর্মী নিলয় নীলকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার দুপুরে ওই এলাকার ১৬৭ নম্বর বাসার পাঁচ তলার একটি ফ্ল্যাটে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘দুপুরে জুম্মার নামাজের পর ভাড়াটিয়া সেজে এক যুবক ওই বাসায় ঢোকে৷ পরে তার পিছনে পিছনে ঢোকে আরো তিনজন৷ তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি৷''
নিলয় নীল (৪০) একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) গবেষণা বিভাগে চাকরি করতেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুনতাসিরুল ইসলাম৷ গোড়ানের ওই বাসায় গত দু'বছর ধরে ভাড়া থাকতেন তিনি৷ ‘ইস্টিশন' নামে একটি ব্লগ সাইটে নিয়মিত ব্লগ লিখতেন নিলয়৷
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, বিচারের দাবি
বইমেলা থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাতে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ব্লগার অভিজিৎ রায়৷ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিতকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷
ছবি: DW
যেখানে হামলার শিকার অভিজিৎ, বন্যা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার ফুটপাথ৷ লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের নিহত হবার এই জায়গাটা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ হামলায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন৷
ছবি: DW
বেঁচে গেছেন বন্যা
হামলার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷ দুষ্কৃতিকারীরা তাঁকে কুপিয়ে জখম করলেও প্রাণে বেঁচে যান অ্যামেরিকায় বসবাসকারী এই ব্লগার৷ বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি৷
ছবি: DW
নির্বাক অজয় রায়
ছেলের মৃত্যুর খবরে নির্বাক নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়৷ আজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন৷
ঢাকা মহানগর গেয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘হত্যার ধরণ এবং প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য থেকে মনে হচ্ছে যে, অভিজিৎ রায়সহ অন্যান্য ব্লগারদের যারা হত্যা করেছে, সেই উগ্রবাদী গ্রুপই নিলয়কে হত্যা করেছে৷'' তিনি জানান, ‘‘এরই মধ্যে আমারা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি৷''
উল্লেখ্য, গত ১৫ই মে নিজের ফেসবুক সাইটে একটি ‘স্ট্যাটাস' দিয়ে তাঁকে হত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন নিলয় নীল৷ এ নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছিলেন তিনি৷ অভিযোগ, পুলিশ তাঁকে নিরাপত্তা না দিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল৷ যদিও যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের দাবি, ‘‘এ ধরণের জিডি-র কোনো খবর আমার জানা নেই৷''
এরপর গত ৩রা আগস্ট নিলয় আরেকটি ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘‘ফারাবি আমাকে তার হিটলিস্টে ঢুকিয়েছে৷''
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘গত মে মাসে ব্লগার অনন্ত দাস হত্যার বিচারের দাবিতে আয়োজিত সমাবেশ থেকে ফেরার পথে নিলয়কে দু'জন অনুসরণ করে৷ অথচ এরপরও নিলয় নিরাপত্তা চেয়ে পাননি৷''
‘নাস্তিক ব্লগার’ ইস্যুতে ইসলামি দলের তাণ্ডব
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কথিত ‘ধর্মনিন্দার’ অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিভিন্ন ইসলামি দল৷ এতে প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্র
শুক্রবার (২২.০২.১৩) দুপুর বারোটার দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ ১২টি ইসলামি ও সমমনা দল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের ভাষায় যেসব ব্লগার ইন্টারনেটে ‘ধর্মনিন্দা’ করে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখছে, তাদের ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আন্দোলন করা হবে৷ কিন্তু সেই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই তাণ্ডবে রূপ নেয়৷ এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘পরিকল্পিত অ্যাকশন’
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানিয়েছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবেই সহিংস অ্যাকশনে গেল জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা৷ ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত কটূক্তির কথা বলে তাদের ভাষায় ‘মুরতাদ-নাস্তিকদের’ ফাঁসির দাবিতে আগেই শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কর্মসূচি দেয়৷ আর আজ (২২.০২.১৩) জুম্মার নামাজের আগেই তারা তাণ্ডব শুরু করে৷’
ছবি: Reuters
শাহবাগে হামলার চেষ্টা
শুক্রবার (২২.০২.১৩) পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ইসলামি দলের সদস্যরা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোতে চাইলে সংঘর্ষ পল্টন হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ ককটেল, গুলি আর টিয়ার গ্যাসের সেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকার কাঁটাবনে শাহবাগ বিরোধীরা রাস্তায় নামে৷ তারাও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
ঢাকার বাইরে তাণ্ডব, প্রাণহানি
ঢাকার বাইরে চট্টগামের প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে৷ তাদের হামলায় পুলিশ এবং সাংবদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন৷ বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, চাঁদপুরে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা চালায় তারা৷ হামলা চালায় সিলেট শহীদ মিনারে৷ সেখানে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ শুক্রবার বিকেল অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাইবন্ধায় ২ জন এবং ঝিনাইদহে জাগরণ মঞ্চ বিরোধীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters
শাহবাগে জনতা
দেশব্যাপী ইসলামি দলগুলোর এই তাণ্ডবের পর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আবারো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের ডাকে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এই চত্বরে অবস্থান করছেন অগুনতি মানুষ৷ তাদের মূল দাবি হচ্ছে, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট৷’’
ছবি: Reuters
তাণ্ডবের পর নতুন কর্মসূচি
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি করেন, ‘‘আজকের (২২.০২.১৩) হামলায় উস্কানি দিয়েছে জামায়াত শিবিরের পত্রিকা আমার দেশ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর সম্পাদক মাহামুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে৷ তা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ইন্টারনেটে সতর্ক দৃষ্টি
‘ধর্মীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে’ এরকম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট খুঁজে খুঁজে বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ ইতোমধ্যে কমপক্ষে দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ এবং দশটি ব্লগ পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে৷ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জানিয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি'র ভাইস-চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
রোববার হরতাল
শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ ১২টি ইসলামি দল৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
ইমরান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘‘ এখন ব্লগার হত্যার বিচারের দাবিকারীদেরও হত্যা করা শুরু হলো৷ এতদিন ব্লগারদের রাস্তায় হত্যা করা হতো, আর এখন বাসায় ঢুকে জবাই করা শুরু হলো৷ এই সরকার ব্লগার হত্যায় পৃষ্ঠপোষকতা করছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এ দেশে মায়ের গর্ভে শিশুও নিরাপদ নয়৷ আমার ধারণা, বিচারহীনতার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷''
এর আগে চলতি বছরের ২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকায় হাতে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়৷ সে'সময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও আহত হন৷ ঐ ঘটনার মাসখানেক পর, ৩০শে মার্চ তেজগাঁও এলাকায় দিনে-দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে৷
তারপর ১২ই মে সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে কুপিয়ে হত্যা করে উগ্রবাদীরা৷
ইমরান এইচ সরকার জানান, ‘‘গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত আটজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে৷ অপরাধীরা ব্লগারদের তালিকা করে হত্যা করছে৷'' ইতিমধ্যেই নিলয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শাহবাগে অবস্থান নিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা৷