সুন্দরবনের শেলা নদীতে এখন তেলের ছড়াছড়ি, বাতাসে ভাসছে গন্ধ৷ গত মঙ্গলবার ভোরে শেলা নদীর বাদামতলা খালের মুখে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামে তেল বোঝাই ট্যাংকার ডুবে গিয়ে তাতে থাকা তেল নদীতে ভেসে এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
শুধু শেলা নদী নয়, বনের অভ্যন্তরের বিভিন্ন খাল ও পার্শ্ববর্তী পশুর নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল আর পানি মিলে একাকার৷ সরকারের তরফ থেকে এলাকাবাসীকে তেল তুলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিক্রি করতে বলা হচ্ছে৷ ৩০ টাকা লিটার দরে এই তেল কিনতে নদীপাড়ে অবস্থান করছে পদ্মা ওয়েল কোম্পানির প্রতিনিধিরা৷ সরকারের এই ঘোষণার পর নারী-শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ তেল তুলতে পানিতে নেমে পড়েছে৷ আর এতে করেই চরম স্থাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকার বাসিন্দাদের৷
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরিবেশ এবং প্রাণীকূলের বিপর্যয়ের পর আমরা নিজেরাই সুন্দরবনের আশেপাশের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছি৷ সরকারের তরফ থেকেই বলা হচ্ছে এলাকাবাসীকে তেল তুলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের কাছে বিক্রি করতে৷ এর ফলে গ্রামবাসীদের যাঁরা তেল তুলতে যাচ্ছেন, তাঁদের চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ হতে পারে৷ চুলে ও মুখে এই ফার্নেস অয়েল মিশ্রিত পানি লাগার ফলে চুলও পড়ে যেতে পারে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আসলে বিশ্বের বড় এই ম্যানগ্রোভ বনের সঙ্গে জাতিসংঘেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ যখন একটা বিপর্যয় হয়েই গেছে, তখন আমরা এই সব হাতুড়ে পদ্ধতিতে না গিয়ে জাতিসংঘের কাছে সাহায্য চাইতে পারতাম৷ কিন্তু সেদিকে আমরা গেলাম না৷ আর তেল তো পানিতে ভেসে থাকে৷ তাই পানির উপরে হালকা বাধা দিয়ে তেলগুলোকে একদিকে নিয়ে যাওয়া যেত৷ তারপর সেখান থেকে অপসারণ করলে কাজটা সহজ হতো৷ এখন গ্রামবাসীতে পানিতে নামিয়ে তেল তোলা হচ্ছে৷ এতে অর্ধেক তেলও তোলা যাবে না৷ কারণ ওই ভেসে থাকা তেলে কিছু দিয়ে স্পর্শ করতে গেলেই তা ভেঙে যাবে৷ ফলে যা হচ্ছে সবই অবাস্তব৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সুন্দরবনের যে অঞ্চলে ট্যাংকারটি ডুবেছে ওই এলাকা বিপন্নপ্রায় শুশুকসহ বেশ কয়েকটি জলজ প্রাণীর অভয়াশ্রম৷ এ অঞ্চল দিয়ে জাহাজ চলাচলই নিষিদ্ধ রাখা উচিত৷ তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হবে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘শুশুক বা ডলফিন জাতীয় প্রাণীগুলো পানির উপরে উঠে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে৷ তেলের গন্ধের কারণে তাদের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্থ হওয়ায় মৃত্যু ঝুঁকিও রয়েছে৷ ইতিমধ্যে সাপসহ কিছু জীবজন্তুর মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে৷’’
নাসরীন আহমাদ বলেন, ‘‘সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট৷ এর গাছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মূল মাটির নীচে গিয়ে আবার উপরের দিকে উঠে৷ উপরের দিকে উঠে থাকা মূলের অংশটুকু দিয়ে বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বেঁচে থাকার উপাদান সংগ্রহ করে৷ এই মূলগুলোতে তেল আটকে থাকার কারণে গাছগুলোর বৃদ্ধি আটকে যাবে৷ এমনকি অনেক গাছ মারাও যেতে পারে৷ তবে সুন্দরবনে এই ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম৷ তাই এখনই বলা যাচ্ছে না ক্ষতির পরিমাণ কী রকম হবে৷ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই আসল চিত্র জানা যাবে৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক ড. এ কিউ এম মাহবুব ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সুন্দরবনের ভেতরের নদীগুলোতে যেহেতু জোয়ার-ভাটা হয়, তাই পানিতে ভেসে থাকা তেল বিস্তীর্ণ এলাকায় যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে কারণে খালগুলোর মুখে কলাগাছ বা হালকা কিছু দিয়ে বাঁধ দেয়া যায়৷ বাতাসে তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার কারণে পাখিসহ জীবজন্তুর শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ প্রক্রিয়া ভয়াবহভাবে বাধাগ্রস্ত হবে৷ তেলের গন্ধের তীব্রতার কারণে পাখির চোখ মুখ বা ডানার পালক পুড়ে যেতে পারে৷ হরিণসহ কিছু জীবজন্তু নদী বা খালের কিনারে এসে পানি গ্রহণ করে৷ তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে তারা আর এখন পানি খেতেই পারবে না৷ ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবন চক্রই পাল্টে গেল৷’’
সুন্দরবনের শুশুকছবি: Rubaiyat Mansur
সুন্দরী বন সুন্দরবন
বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন৷ বাংলাদেশ ও ভারতজুড়ে বিস্তৃত এ বনের মোট আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার৷
ছবি: DW/M, Mamun
বিশ্ব ঐতিহ্য
বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬০১৭ কিলোমিটার৷ আয়তনের প্রায় ৭০ ভাগ স্থল আর ৩০ ভাগ জল৷ পুরো সুন্দরবনের ভেতরে জালের মতো অসংখ্য নদী আর খাল রয়েছে৷ জীববৈচিত্রে ভরপুর সুন্দরবনকে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ প্রায় ৪০০ প্রজাতির পাখির বসবাস এই বনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
বাঘের পায়ের ছাপ
সুন্দরবনের কটকা বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য৷ সেখানেই দেখা মেলে বেঙ্গল টাইগারের পায়ের ছাপ৷ এ বনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ডোরাকাটা বাঘ৷ জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যের অভাব আর চোরা শিকারসহ নানা কারণে দিন দিন এখানে কমে আসছে বাঘের সংখ্যা৷ বন বিভাগের মতে, সুন্দরবনে বর্তমানের বাঘের আনুমানিক সংখ্যা ৫০০৷ ২০০৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাঘশুমারি অনুযায়ী এ সংখ্যা ছিল ৪৪০৷
ছবি: DW/M, Mamun
অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রা হরিণ
সুন্দরবনের কটকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে চিত্রা হরিণ৷ সুন্দরবনের সর্বত্রই এ প্রাণীটির দেখা মেলে৷ চিত্রা আর মায়া – এ দুই ধরণের হরিণ আছে সুন্দরবনে৷ তবে সবচেয়ে বেশি আছে চিত্রা হরিণ৷ ৩০ হাজারেরও বেশি চিত্রা হরিণের বসবাস সুন্দরবনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
যার নামে সুন্দরবন
সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছই চির সবুজ ম্যানগ্রোভ শ্রেণির৷ এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী৷ এ গাছের নামেই বনের নামকরণ৷ এছাড়া এই বনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ আছেস যার মধ্যে ১৭টি ফার্ন জাতীয়, ৮৭টি একবীজপত্রী ও ২৩০ প্রজাতি দ্বিবীজপত্রী৷ সারা পৃথিবীজুড়ে যে ৫০ প্রজাতির প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ আছে, তার ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় বাংলাদেশের সুন্দরবনে৷
ছবি: DW/M, Mamun
পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ
প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক আসেন সুন্দরবন ভ্রমণে৷ ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ লাখ ২০ হাজার ৪১৪ জন পর্যটক বেড়াতে এসেছেন এখানে, যাঁদের মধ্যে বিদেশি পর্যটক ৩ হাজার ৮৫৪ জন৷
ছবি: DW/M, Mamun
বিচিত্র সাপ
শরণখোলা রেঞ্জের একটি জঙ্গলে গ্রিন ক্যাট স্নেক বা সবুজ ফনিমনসা সাপ৷ কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ ছাড়াও সুন্দরবনে দেখা যায় কিং কোবরা বা রাজগোখরা, রাসেলস ভাইপার, পিট ভাইপার, পাইথন, ব্যান্ডেড ক্রেইড ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M, Mamun
কুমির দর্শন
জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ – সুন্দরন নিয়ে এরকম প্রবাদ বহুকালের৷ সুন্দরবনের হারবাড়িয়া এলাকার একটি খালে লোনা জলের এই কুমিরটিকে দেখা গিয়েছিল৷ সুন্দরবনের মহা বিপন্ন এ প্রাণীটি আকারে সাত মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়৷ লোনা পানির কুমিরের গড় আয়ু ১০০ বছরের মতো৷
ছবি: DW/M, Mamun
হরিণের বন্ধু
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে তোলা বানরের ছবি৷ সুন্দরবনে চিত্রা হরিণের পর সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ প্রাণীটি৷ সুন্দরবনে বানরকে হরিণের সুহৃদ বলা হয়৷ গাছের ডাল ভেঙ্গে হরিণকে পাতা খেতে বানর সহায়তা করে থাকে৷ এছাড়া বাঘের আগমনের খবরটিও সবার আগে হরিণকে দেয় বানর৷
ছবি: DW/M, Mamun
জঙ্গল উপভোগ
সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্যের ছোট খালে ঘুরে জঙ্গল উপভোগ করছেন পর্যটকরা৷ সকাল এবং বিকেলে এসব খালে বেড়ানোর সময় অনেক বন্য প্রাণীর দেখা মেলে৷
ছবি: DW/M, Mamun
ভ্রমণতরী
সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে একটি বেসরকারি সংস্থার ভ্রমণতরী৷ সুন্দরবন দেখতে আসা বিদেশি পর্যটকদের বেশির ভাগই আসেন বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থাগুলোর সহায়তায়৷ এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগেরও অভাব অনেক৷
ছবি: DW/M, Mamun
পণ্যবাহী জাহাজের কারণে ডলফিনের মৃত্যু
সুন্দরবনের ভেতরে জঙ্গল ঘেঁষে চলাচল করছে বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ৷ এ সব জাহাজের উচ্চ শব্দ যেমন বন্যপ্রাণীদের বিরক্তির কারণ হয়, তেমনি এসব জাহাজের সৃষ্ট ঢেউ ভাঙন ধরায় সুন্দরবনে৷ এ সব জাহাজের প্রোপেলারের আঘাতে প্রায়ই ডলফিনেরও মৃত্যু ঘটে৷
ছবি: DW/M, Mamun
অপরূপ সূর্যাস্ত
সুন্দরবনের কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে সূর্যাস্তের ছবি তুলছেন এক পর্যটক৷
ছবি: DW/M, Mamun
রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষেই এগিয়ে চলছে রামপাল কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ৷ এতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হয় বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও মানব বসতির ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয় না৷ অথচ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের সংরক্ষিত ও স্পর্শকাতর স্থানের দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার৷