প্রতি বছর যে উৎসাহ, উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়, এবার তা অনুপস্থিত৷ কারণ অবশ্যই করোনা সংক্রমণ এড়াতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধান৷
বিজ্ঞাপন
বছরের কয়েকটা দিন কলকাতা শহর এবং শহরতলীতে নিয়ম করে প্রভাত ফেরি বের হয়৷ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ২৫ বৈশাখ, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন ২৩ জানুয়ারি এবং অবশ্যই ১৫ অগাস্ট, ভারতের স্বাধীনতাদিবসে৷ কিন্তু এই বছর ২৫ বৈশাখের সকাল যেমন বেসুরো, বেতাল কেটেছে, ১৫ অগাস্টের সকাল তার থেকেও নিঃসাড়ে কেটে যাবে৷ প্রতি বছর একাধিক অনুষ্ঠান হয় স্বাধীনতার উদযাপন করতে৷ তার মধ্যে বেশ কিছু গান-বাজনার কনসার্ট হালে রীতিমত জনপ্রিয়ও হয়েছিল৷ এবার কোথাও কিছু হচ্ছে না৷ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কুচকাওয়াজ থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় বিচিত্রানুষ্ঠান, সবই এবার বাদ পড়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যদিও রাজ্যবাসীকে বলেছেন, এবার প্রত্যেক ঘরে যেন জাতীয় পতাকা তোলা হয়৷ নয়ত দলগতভাবে যে সব অনুষ্ঠান নিয়মিত হয়, সে সবই এবার নিয়মরক্ষার খাতিরে করা হবে৷ কম লোক নিয়ে৷
দেশভাগের আগুন, যা এখনো জ্বলছে
১৯৪৭ সালের ১৪/১৫ আগস্ট ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল৷ হিন্দু অধ্যুষিত ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান৷ সেই থেকে দুই দেশের কিছু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়া কোনো উন্নতি হয়নি৷ বরং শত্রুতা বেড়েই চলেছে৷
ছবি: AP
দুই দেশের জন্ম
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই দেশে বিভক্ত হয়৷ জন্ম নেয় নতুন দুই রাষ্ট্র৷ ভারত ও পাকিস্তান৷ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তাঁর দল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ প্রথমে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উপর নিজেদের আধিপত্য দাবি করেন এবং পরবর্তীতে মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জানান৷ জিন্নাহ’র বিশ্বাস ছিল হিন্দু আর মুসলিমরা ভবিষ্যতে একসাথে থাকতে পারবে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/United Archives/WHA
রক্তাক্ত পথ
পার্টিশন বা দেশ বিভাগ নৃশংস এবং ভয়াবহ এক অধ্যায়ের নাম৷ ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে৷ ইতিহাসবিদরা বলেন, ঐ দাঙ্গায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷ জন্মভূমি ছেড়ে ভারত থেকে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে ভারতে আসে লাখ লাখ মানুষ৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Images
১৯৪৮ সালের যুদ্ধ
ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা পাওয়ার পর কাশ্মীর নিয়ে আবারো বিবাদে জড়িয়ে পড়ে৷ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল হিন্দু নেতার হাতে৷ কিন্তু জিন্নাহ চাইলেন এটা যাতে পাকিস্তানের অধীন হয়৷ ১৯৪৮ সালে দুই দেশের সেনাবাহিনী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ কাশ্মীর উপত্যকার বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ভারতীয় সেনারা৷ কিন্তু সেই সংঘর্ষের জের অব্যাহত আছে আজও৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/M. Desfor
যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার মতো
উদারপন্থি ইতিহাসবিদরা বলেন, জিন্নাহ এবং মহাত্মা গান্ধী নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র দু’টির মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন চেয়েছিলেন৷ জিন্নাহ’র আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার মতো সম্পর্ক হবে ভারত-পাকিস্তানের৷ কিন্তু ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা নতুন দিল্লির সঙ্গে বিবাদ অব্যাহত রাখে৷
ছবি: AP
উপস্থাপনের ভিন্নতা
ভারত ও পাকিস্তান সরকার দেশভাগের ব্যাপারটিকে একেবারে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করে৷ ভারত এটাকে ব্রিটিশদের শাসন থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফসল হিসেবে উল্লেখ করে, যেখানে মহাত্মা গান্ধীকে এর স্থপতি বলা হয়৷ অন্যদিকে, পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকে ব্রিটিশ এবং হিন্দুদের আধিপত্য থেকে মুক্তির আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৪ আগস্টকে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/M. Desfor
সম্পর্কের টানা-পোড়েন
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গত সাত দশক ধরেই তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে৷ আর গত কয়েক বছর ধরে ইসলামি জঙ্গিবাদের কারণে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে দু’দেশের মধ্যে৷ নয়া দিল্লি বরাবরই পাকিস্তানকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গিবাদে মদদদাতা হিসেবে দায়ী করে আসছে৷ আর ইসলামাবাদ বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে৷
ছবি: Picture alliance/AP Photo/D. Yasin
6 ছবি1 | 6
দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী, পুরসভার ৮৬ নং ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলর দীপ্তি মুখার্জি প্রতি বছরই প্রভাত ফেরি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন স্বাধীনতা দিবসে৷ সাংগঠনিক স্তরে এবং তিনি ও তাঁর স্বামী, তৃণমূল নেতা, প্রাক্তন বরো চেয়ারম্যান দুর্গাপ্রসাদ মুখার্জি যুক্ত আছেন নিজেদের হাতে তৈরি যে সাংস্কৃতিক চক্রের সঙ্গে, সেই বালিগঞ্জ কালচারাল সেমিনার আয়োজিত নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে৷ কিন্তু এবছর কিছুই হচ্ছে না৷ দীপ্তি মুখার্জি জানালেন, ‘‘আমরা ফ্ল্যাগ তুলব, কিন্তু গ্যাদারিং বেশি করছি না৷ করোনার জন্য৷ যতজন মেম্বার আছে, সব মেম্বারকে আমরা বলছি না৷ আমি বলেছি, সবাই নিজেদের নিজেদের পাড়ায় (পতাকা) তোলো৷ আর যেহেতু আমাদের ক্লাব, বালিগঞ্জ কালচারাল সেমিনারের ফ্ল্যাগটা আমাকেই তুলতে হবে, মানে আমাকে এবং দুর্গা মুখার্জিকেই তুলতে হবে৷ কারণ আর যারা মেম্বার, তারা আসতে পারবে না৷ তারা অনেক দূরে দূরে থাকে৷ আমি যেহেতু কাছে থাকি, আমরা দুজনে, সেজন্য আমরা তুলে দেব৷ আর আমাদের ৮৬ নং ওয়ার্ডের যে ফ্ল্যাগ হয়েস্টিং হবে, তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে, সেটা দুর্গা মুখার্জিই তুলবেন৷''
তা হলে প্রতি বছরের মতো অনুষ্ঠান এবার আর হচ্ছে না? দীপ্তি মুখার্জির বক্তব্য, ‘‘কী করে করব বলুন! রিস্ক হয়ে যাবে না! বাচ্চাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করাটা খুব রিস্ক হয়ে যাবে৷ তাদের বাবা-মায়েরাও ছাড়বে কেন বলুন! আমরাই বা কী করে বলব! আমাদের বলাটাও তো অন্যায়৷''
‘"বাচ্চাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করাটা খুব রিস্ক হয়ে যাবে’: দীপ্তি মুখার্জি
কাজেই বেনজিরভাবে এবছর প্রায় আড়ম্বরহীন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই পালিত হবে স্বাধীনতা দিবস৷ অবশ্য সমবেত উদযাপন না হলেও লোকে নিজের বাড়িতে যে দিনটি পালন করবেন, তা বোঝা গেল বাজার ঘুরে৷ বিক্রি হচ্ছে নানা মাপের জাতীয় পতাকা, তিনরঙা কাগজের শিকলি৷ আর এই করোনার আবহে এবার চোখে পড়ছে আরও একটি জিনিস৷ ভারতের জাতীয় পতাকার রঙে রাঙানো মুখ ঢাকার মাস্ক, মাথায় বাঁধার কাপড়৷ সামাজিক দূরত্বের এই দুঃসহ সময়ে ওইটুকুই যা রঙের ছোঁয়া এবারের স্বাধীনতা দিবসে৷