রাইনহোল্ড মেসনারকে বিশ্বের প্রখ্যাততম পর্বতারোহীদের মধ্যে গণ্য করা হয়৷ নিজে এভারেস্ট জয় করেছেন ১৯৭৮ সালে, অক্সিজেন ছাড়াই৷ তিনি এবার শেরপাদের সঙ্গে ইউরোপীয় পর্বতারোহীদের বিরোধে নাক গলিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
সুইজারল্যান্ডের উয়েলি স্টেক ও ইটালির সিমোনে মোরো, দু'জনেই নাম-করা পর্বতারোহী৷ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আবার এক ব্রিটিশ অ্যালপাইন ফটোগ্রাফার৷ এই তিনজনের সঙ্গে শেরপাদের প্রায় হাতাহাতি বাধে গতমাসে মাউন্ট এভারেস্টের ঢালে৷ বিরোধটা স্বভাবতই বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে চড়ার অধিকার ও তার নগদ মূল্য নিয়ে৷
এভারেস্ট জয়ের ষাট বছর
১৯৫৩ সালে এডমান্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন৷ মানব জাতির ইতিহাসে তাঁরাই প্রথম পা রাখেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে৷ আর ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম৷
ছবি: DIAMIR Erlebnisreisen GmbH
প্রথম জয়, প্রথম মৃত্যু
২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের সর্বোচ্চ শেখরে পা রাখেন মুসা ইব্রাহীম (বামে)৷ সেই জয়ের খবরে আনন্দের বন্যা নামে বাংলাদেশে৷ আর ২০১৩ সালে এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে মারা যান সজল খালেদ৷ এই ছবিঘরে মানবজাতির এভারেস্ট জয়ের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে৷ একেবারে সেই ১৯৫৩ সাল থেকে৷
ছবি: Musa Ibrahim
কোড ম্যাসেজ
‘‘স্নো কন্ডিশনস ব্যাড স্টপ অ্যাডভান্সড বেস এবানডন্ড মে টোয়েন্টিনাইন স্টপ অ্যাওয়েটিং ইমপ্রুভমেন্ট স্টপ অল ওয়েল’’ এই ম্যাসেজের অর্থ হচ্ছে: ‘‘হিলারি এবং তেনজিং ২৯ মে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়া জয় করেছে৷’’ ১৯৫৩ সালের পহেলা জুন এই তথ্য লন্ডনে পৌঁছায়৷ এভারেস্টের সর্বোচ্চ শিখরে মানুষের পদচিহ্নের খবর শুনে উৎসবে মেতে ওঠে সবাই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
কে আগে চূড়ায় উঠেছিল?
নিউজিল্যান্ডের এডমান্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং নোরগে (ছবিতে বামে) এভারেস্ট জয়ের পর এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ এই দু’জনের মধ্যে কে আগে চূড়ায় পা রেখেছিলেন তা নিয়ে শুরু হয় তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক৷ নেপাল এবং ভারত এই জয় তাদের দাবি করে৷ তবে এভারেস্ট জয়ের কয়েক বছর পর হিলারি জানান, চূড়ায় ওঠার সময় তিনি তেনজিং এর থেকে কয়েক পা সামনে ছিলেন৷
ছবি: DW/S. Nestler
অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট জয়
হিলারি ও তেনজিং-এর সেই ঐতিহাসিক অভিযানের পরের তিন দশকে বহু পর্বতারোহী বিভিন্ন পথ ধরে এভারেস্টে উঠেছেন৷ ১৯৭৮ সালে সাউথ টাইরোলিয়ান রাইনহোল্ড মেসনার (ডানে) এবং অস্ট্রেলিয়ান পিটার হেবেলার (বামে) অক্সিজেনের বাড়তি জোগান ছাড়াই এভারেস্ট জয় করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দলে দলে এভারেস্ট জয়
১৯৯০ দশকের দিকে দল বেধে পর্বতারোহীরা এভারেস্ট জয় শুরু করেন৷ সেই সময় থেকে প্রতিবছর শত শত পর্বতারোহী এভারেস্টের চূড়ায় উঠছেন৷ রেকর্ড বলছে, এখন অবধি কমপক্ষে ৬,০০০ বার সফলভাবে এভারেস্টের চূড়া জয় করেছে মানুষ৷ আবহাওয়া ভালো থাকলে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে এভাবেই এভারেস্টের চূড়ার দিকে যাত্রা করেন পর্বতারোহীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চূড়ায় পর্বতারোহীদের ভিড়
সফলভাবে এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চূড়ান্ত পর্যায়ে অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্প থেকে কমপক্ষে চারদিন সময় লাগে আর এই সময়টা আবহাওয়া অবশ্যই ভালো থাকতে হবে৷ সাধারণত একইসময়ে অনেক অভিযাত্রী চূড়ার দিকে যাত্রা করেন, কেননা সবাই আবহাওয়ার পূর্বাভাষের উপর নির্ভরশীল৷ ফলে একদিনে অনেক পর্বতারোহীকে চূড়ায় এভাবে ভিড় করতে দেখাটা স্বাভাবিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেরপারা পথ দেখান
শেরপাদের সহায়তা ছাড়া কারো পক্ষে এভারেস্টের চূড়া জয় করা কার্যত অসম্ভব৷ তাঁরা এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার পথের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সদা তৎপর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
৮০ বছরে এভারেস্ট জয়
এভারেস্ট প্রতি বছরই চলে রেকর্ড গড়ার এবং ভাঙার খেলা৷ এই বসন্তে আশি বছর বয়সি জাপানি বৃদ্ধ ইউচিরো মিউরা এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রেখেছেন৷ এর আগে ২০১০ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করেন জর্ডান রেমেরো৷ দুটোই রেকর্ড৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উদ্ধার তৎপরতা
২০০৩ সালে এভারেস্ট বেসক্যাম্পে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দুই ব্যক্তি৷ দশ বছর পর মানে এখন এভারেস্ট বেসক্যাম্প পর্যন্ত হেলিকপ্টারে যাতায়াত স্বাভাবিক ব্যাপার৷ এখন অবধি সর্বোচ্চ ৭,৮০০ মিটার উচ্চতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
এভারেস্টে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এভারেস্টেরও ক্ষতি হচ্ছে৷ গত পঞ্চাশ বছরে সেখানকার বরফের পরিমাণ কমেছে ১৩ শতাংশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গর্বের এভারেস্ট
এভারেস্টের অধিকাংশ অংশই নেপালের আওতায় রয়েছে৷ ফলে এভারেস্টকেন্দ্রিক পর্যটন খাত থেকে বিপুল অর্থ আয় করে দেশটির সরকার৷ প্রতি বছরের ২৯ মে ‘আন্তর্জাতিক মাউন্ট এভারেস্ট দিবস’ উদযাপন করে নেপাল৷ ১৯৫৩ সালের এই দিনে এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিল মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পর্যটক কমাতে অনাগ্রহী নেপাল
এভারেস্টের চূড়ায় আরোহনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন বিধিনিষেধ আরোপ করার পক্ষে নয় নেপাল৷ বরং প্রয়োজনীয় টাকা থাকলে যেকেউ চেষ্টা করতে পারে এভারেস্ট জয়ের৷
ছবি: DW/S. Nestler
বাংলাদেশের এভারেস্ট জয়
২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম৷ এরপর আরো চারজন বাংলাদেশি এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন৷ এদের মধ্যে দু’জন মেয়ে৷ আর ২০১৩ সালে চূড়া জয় করে নামার পথে ‘ডেথ জোনে’ মারা যান সজল খালেদ৷
ছবি: DIAMIR Erlebnisreisen GmbH
13 ছবি1 | 13
ওদিকে মেসনার গেছিলেন কাটমান্ডু – প্রত্যাশা মতোই – হিলারি-তেনজিংয়ের এভারেস্ট বিজয়ের ৬০ বছর পূর্তির উৎসব উপলক্ষ্যে৷ এবং প্রত্যাশা মতোই তাঁকে গতমাসের হাতাহাতি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়৷ মেসনার রেখেঢেকে কথা বলার পাত্র নন৷ তিনি সরাসরি সংশ্লিষ্ট ইউরোপীয় পর্বতারোহীদের ‘‘পরগাছা'' বলে অভিহিত করেছেন৷
‘‘পরগাছা''
মেসনারের যুক্তি হলো, শেরপারা দড়িটড়ি লাগিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখে তারপর দেখে, কিভাবে শ'য়ে শ'য়ে মানুষ এভারেস্টে চড়ছে, যেন হাইকিং করতে এসেছে৷ সকলেই চড়ার সময় শেরপাদের বসানো দড়ি, মই ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে৷ মেসনার আরো খোলসা করে বলেছেন, ‘‘পর্বতারোহীরা যাঁরা খুম্বু আইসফল-এ শেরপাদের বসানো মই ব্যবহার করেন, পরে দড়ি ছাড়া এভারেস্টে চড়েন এবং দাবি করেন যে তাঁরা বিশেষ কিছু করেছে, তাঁরা হলো পরগাছা৷ সকলেই শেরপাদের সৃষ্ট অবকাঠামো ব্যবহার করেন, কিন্তু সকলে তার জন্য পয়সা দিতে রাজি নন৷''
ইউরোপীয়দের সঙ্গে বিরোধ সম্পর্কে শেরপাদের ভাষ্য হলো, ইউরোপীয়দের বলা হয়েছিল বাণিজ্যিক পর্বতারোহীদের জন্য লোৎসে ফেসে দড়ি বসানো হচ্ছে৷ এখন যেন তাঁরা বেস ক্যাম্পেই থাকেন৷ অপরদিকে ইউরোপীয়দের দাবি, তাঁরা তো আর শেরপাদের লাগানো দড়ি ব্যবহার করেননি৷ কাজেই তাঁদের নিজের মর্জি মতো চড়ার অধিকার ছিল৷
পর্বতারোহণ, না ট্যুরিজম?
বিরোধ যা নিয়েই হোক, তার পর সেই বিরোধ নিয়ে হাতাহাতি যেন পর্বতারোহণের মতো একটি সুন্দর, ছিমছাম স্পোর্টে হঠাৎ ‘গার্মেন্টস' ঢুকে যাওয়া! বিত্তশালী পশ্চিমি পর্বতারোহীরা আসছেন এভারেস্টে চড়তে৷ শেরপারা সে তুলনায় অতি কম পারিশ্রমিকে তাঁদের সাহায্য করছেন, পথ দেখাচ্ছেন, মালপত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন৷ এই তো সুপ্রচলিত প্রণালী৷
কিন্তু এভারেস্ট বিজয়ের ৬০ বছর পরে এভারেস্ট আরোহণের ধারাপ্রকৃতি বদলে গিয়েছে, আসল সমস্যাটা সেখানেই৷ রাইনহোল্ড মেসনার, যিনি প্রথম অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্টে চড়েছেন; যিনি প্রথম অক্সিজেন ছাড়া বিশ্বের যে ক'টি শৃঙ্গের উচ্চতা আট হাজার মিটারের বেশি, তাদের মধ্যে সবগুলি, অর্থাৎ চোদ্দটিতেই চড়েছেন; যিনি প্রথম একা, অর্থাৎ সঙ্গী ছাড়াই একটি আট হাজারের মিটারের শৃঙ্গ, নাঙ্গা পর্বতে চড়েন; যিনি পায়ে হেঁটে দক্ষিণ মেরু এবং গোবি মরুভূমি পার হয়েছেন – সেই রাইনহোল্ড মেসনার এএফপি সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন: ‘‘হিলারি আর তেনজিং ৬০ বছর আগে যা করেছেন, তা ছিল আশ্চর্য৷ ইতিমধ্যে এভারেস্ট ট্যুরিস্টদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷''