বিমানযাত্রার ইতিহাসে বোধহয় আর কোনো নিখোঁজ বিমানের এভাবে খোঁজ করা হয়নি: এই পরিমাণ সময় ও শক্তি ব্যয় করে, এই পরিমাণ তীব্রতা ও একাগ্রতা নিয়ে৷ কিন্তু দুর্ঘটনার এতগুলো মাস পরেও বিমানটির কোনো চিহ্ন নেই, নেই হদিশ৷
বিজ্ঞাপন
বিমানটির খুঁটিনাটি মুখস্থ হয়ে গেছে: ৮ই মার্চ, ২০১৪৷ মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ বিমানটি কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে উধাও হয়ে যায়৷ বিমানে ছিলেন ২২৭ জন যাত্রী ও বারোজন ক্রু৷ তাঁরা সব মিলিয়ে ১৪টি দেশের নাগরিক৷ অভিজ্ঞ পাইলট জাহারি আহমদ শাহ-র নেতৃত্বাধীন ক্রু-র সব সদস্যই ছিলেন মালয়েশীয়৷ নয়ত যাত্রীদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিলেন চীনা নাগরিক৷
বিমানটির যাওয়ার কথা ছিল কেএল থেকে উত্তর-পূর্বে কাম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের দিকে৷ কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা যায় যে, বিমান নিশ্চয় তার দিক পরিবর্তন করেছে৷ তারপর খোঁজ চলে দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালী এবং শেষমেষ ভারত মহাসাগরের দক্ষিণাঞ্চলে৷ ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিমান ও জাহাজ পাঠিয়ে এমএইচ৩৭০ উড়ালের খোঁজে সহযোগিতা করে৷
মালয়েশিয়ার বিমান নিখোঁজের সম্ভাব্য কারণ
মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭-এর এমএইচ৩৭০ বিমানটির সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি৷ এটি নিখোঁজের সম্ভাব্য কারণগুলো নিয়ে এখন চলছে ব্যাপক আলোচনা৷ চলুন জানা যাক বিমান নিখোঁজের সম্ভাব্য কারণগুলো৷
ছবি: Reuters
কেন নিখোঁজ?
২০১৪ সালের ৮ই মার্চ নিখোঁজ হওয়া এমএইচ৩৭০ উড়ালের বিমানটি নিয়ে এখন যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সেগুলো হচ্ছে, পাইলট কি নিকটবর্তী কোনো স্থানে বিমানটি অবতরণ করাতে চয়েছিলেন? বিমানটি কি অন্য একটি বিমানের রাডার সিগন্যালের আড়ালে চলতে চয়েছিল? বা এটি কি সত্যিই মালদ্বীপ পর্যন্ত উড়ে গিয়েছিল?
ছবি: Reuters
দ্রুত অবতরণের চেষ্টা
মালয়েশিয়ার এই বিমানটি নিখোঁজের ১২ দিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত কারণগুলোর একটি হচ্ছে, বিমানটির ককপিটে কোনো কারণে আগুন লেগে থাকতে পারে এবং সেকারণে পাইলট এটির যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দ্রুত কাছাকাছি কোনো বিমানক্ষেত্রে অবতরণের চেষ্টা করেছিলেন৷ এ জন্যই হয়ত বিমানটি গতিপথ বদলে ছিল৷
ছবি: Reuters
ছিনতাই চেষ্টা
বিমান নিখোঁজের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ছিনতাইকে এখনো উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে না৷ অনেকে সন্দেহ করছেন, বিমানের পাইলট বা ছিনতাইকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিমানের কমিউনিকেশন সিস্টেমে ভিন্ন একটি ঠিকানা প্রবেশ করিয়েছিলেন৷ ফলে উড়ালের এক পর্যায়ের বিমানটি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়৷ অনেকের সঙ্গে মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডকও এমন ধারণা করছেন৷
ছবি: Reuters
অন্য বিমানের আড়ালে চলার চেষ্টা
এ ধারণাটি অবশ্য হলিউড ছবির জন্য চমৎকার প্লট হতে পারে৷ কেউ কেউ মনে করছেন, এমএইচ৩৭০ উড়ালের বিমানটি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের বেশ কাছাকাছি থেকে কিছুক্ষণ উড়েছিল, যাতে করে সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের রাডার সিস্টেমের ছায়াতলে অবস্থান করে নিজেদের পরিচয় কিছু সময়ের জন্য লুকিয়ে রাখা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
উল্কার আঘাতে বাষ্পীভূত
মালয়েশিয়ার এই বিমানটিতে থাকা ২৩৯ জন আরোহীর দুই তৃতীয়াংশই চীনা নাগরিক৷ চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিমান দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে যে, উল্কার আঘাতে বিমানটি ধ্বংস এবং বাষ্পীভূত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
মালদ্বীপ থেকে দেখা গেছে বিমানটি
দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের একটি ছোট্ট দ্বীপের বাসিন্দারা ৮ই মার্চ সকালে খুব নীচু থেকে উড়ে যাওয়া একটি বিমান দেখেছেন বলে দাবি করেছেন৷ বিমানটি সাদা রংয়ের এবং এতে লাল রংয়ের লাইন আঁকা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা, যা মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের সঙ্গে মিলে যায়৷ বিষয়টি এখন খতিয়ে দেখছেন মালদ্বীপ পুলিশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিমান খুঁজছেন কয়েক লাখ মানুষ
এমএইচ৩৭০ উড়ালের এই বিমানটি ইন্টারনেটে খুঁজছেন কমপক্ষে ৩০ লাখ মানুষ৷ স্যাটেলাইট সংস্থা ‘ডিজিটালগ্লোব’ জানিয়েছে, বিমানের ধ্বংসাবশেষের খোঁজে তাদের অনলাইন ম্যাপ দেখা হয়েছে ২৫৭ মিলিয়ন বার৷
ছবি: NASA/dpa
আসলে কি কেউ কিছু জানে?
বিমানটি খোঁজার অগ্রগতি সম্পর্কে এক মালয়েশীয় কর্মকর্তা জার্মান বার্তাসংস্থা ডিপিএকে বলেছেন, ‘‘আমাদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই৷’’ বুধবার (১৯.০৩.১৪) পর্যন্ত এটাই বাস্তবতা৷ ফলে বিমান নিখোঁজ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ক্রমশই বাড়ছে, যার কোনটি সত্য কেউ জানে না! (ফাইল ফটো)
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
অস্ট্রেলিয়ান ‘সার্চ কোঅর্ডিনেটর'-রা এখন বলছেন যে, স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞরা শেষমেষ ভারত মহাসাগরের দক্ষিণাঞ্চলে ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার একটি সার্চ জোনের উপর নজর ফেলেছেন৷ দৃশ্যত স্যাটেলাইট ডাটা থেকে দেখা গেছে যে, বিমানটি আগে যা ভাবা গেছিল, তার অনেক আগেই দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে থাকতে পারে৷ এবার একটি ওলন্দাজ আন্ডারওয়াটার সার্ভে কোম্পানি এবং চীনা নৌবাহিনীর একটি জাহাজকে ‘সোনার' ও ভিডিও ইকুইপমেন্ট দিয়ে গোটা সার্চ জোনটিকে চষে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ এই ‘জরিপে' এক বছর অবধি সময় লেগে যেতে পারে, বলে প্রকাশ৷
মোট কথা, বিমানটির ব্ল্যাক বক্স খুঁজে না পাওয়া অবধি এমএইচ৩৭০-এর ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা বলা প্রায় অসম্ভব৷ বিমানটিকে অপহরণ করা হয়েছে; বিমানটি অন্তর্ঘাত কিংবা সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে, সেটা এক তত্ত্ব; পাইলট ও কো-পাইলট একত্রে কিংবা এককভাবে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন, সেটা আরেক থিওরি৷ কিন্তু এই সব গুজব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো প্রবৃত্তি কিংবা শক্তি যাঁদের নেই, সেই হতভাগ্য মানুষগুলির কথাও স্মরণ করা দরকার: এঁরা হলেন নিখোঁজ যাত্রীদের আত্মীয়স্বজনেরা৷ শুধু তাঁদের শোকের সমাপ্তি, ও তাঁদের মানসিক শান্তির জন্যই এমএইচ৩৭০-এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হদিশ পাওয়া প্রয়োজন৷