1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এমপির কথার জোর : সংসদে, বাইরে, দলে এবং দলের বাইরে

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩১ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা সংসদে বা বাইরে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বলতে পারেন না। বাইরে কিছুটা সুযোগ থাকলেও, ‘দলের নীতির' বাইরে গিয়ে কিছু বললে চড়া মূল্যও দিতে হয়।

বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা সংসদে বা বাইরে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বলতে পারেন না। বাইরে কিছুটা সুযোগ থাকলেও, ‘দলের নীতির' বাইরে গিয়ে কিছু বললে চড়া মূল্যও দিতে হয়।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা সংসদে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বলতে বা ভোট দিতে পারেন নাছবি: picture-alliance/dpa/Dinodia Photo Library

তখন ক্ষমা তো চাইতে হয়-ই, এমন ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য পদ, এমনকি মন্ত্রিত্ব হারানোরও নজিরও আছে। আছে মামলার শিকার হয়ে কারাগারে যাওয়ার নজিরও।

‘বেফাঁস’ কথা বলার খেসারত

২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর  যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে ‘আপত্তিকর' মন্তব্যের কারণে কারাগারে যেতে হয় সেই সময়ে আওয়ামী লীগের এমপি এবং মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে। সংসদ থেকে পদত্যাগেও বাধ্য হন তিনি । আওয়ামী লীগ থেকে তখন তার প্রাথমিক সদস্যপদও চলে যায়। তখন তার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশে হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামপন্থি দলগুলো ব্যাপক বিক্ষোভ, এমনকি হরতালও করে। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। তিনি ওই বছরের নভেম্বরে ভারত হয়ে দেশে ফেরেন। দেশে ফেরার দুই দিনের মাথায় ধানমন্ডি থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সেখান থেকে আদালতে পাঠানো হলে তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।  ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি সংসদ সদস্যের পদ ত্যাগে বাধ্য হন। মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন তার আগেই।

ক্ষমা চেয়ে রক্ষা

২০১৬ সালে সংসদের বাইরে এক মন্তব্যের কারণে সংসদে ক্ষমা চাইতে হয় জাসদ নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে। ওই বছরের জুলাই মাসে পিকেএসএফের এক অনুষ্ঠানে টিআর, কাবিখা প্রকল্পে দুর্নীতির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘আমি তো এমপি, আমি জানি, টিআর কীভাবে চুরি হয়। সরকার ৩০০ টন দেয়, এর মধ্যে এমপি সাহেব আগে দেড়শ টন চুরি করে নেয়। তারপর অন্যরা ভাগ করে। সব এমপি করে না। তবে এমপিরা করেন।’’

তার এই বক্তব্যের জন্য তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুঃখ প্রকাশ করেও পার পাননি। সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে সংসদেও ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।

ইনু প্রথমে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা বলেও রেহাই পাননি। শেষ পর্যন্ত তাতে ক্ষমা চেয়ে পরিস্থিতি সামলাতে হয়।

আমাকে তো হুইপিং মানতে হবে: হাসানুল হক ইনু

This browser does not support the audio element.

আরো কয়েকটি ঘটনা

২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. একরামুল কবির চৌধুরী ক্ষমা চান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে। তিনি তার এলাকায় ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন ‘‘আমি কথা বললে তো আর মির্জা কাদেরের (ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই) বিরুদ্ধে কথা বলবো না। আমি কথা বলবো ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে। একটা রাজাকার পরিবারের লোক এই পর্যায়ে এসেছে, তার ভাইকে শাসন করতে পারে না। এগুলো নিয়ে আমি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে কথা বলবো। আমার যদি জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি না আসে, তাহলে আমি এটা নিয়ে শুরু করবো।’’

এদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াকার্স পার্টির প্রধান রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে ‘হিজাব ও টুপির’ কটূক্তি করার অভিযোগ তুলে তাকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলে কয়েকটি ইসলামি দল। তারা মেননকে ১৪ দল থেকে বহিস্কারেরও দাবি তোলে।

আর জানুয়ারি মাসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপির বিরুদ্ধে বেফাঁস মন্তব্য করে পরে আবার ক্ষমা চান একই দলের এমপি মশিউর রহমান রাঙ্গা।

২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে ক্ষমা চেয়েছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি সংসদে বলেছিলেন, ‘‘সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না।” পরদিন সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে তিনি তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চান।

বাধা কোথায়?

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ মদস্যরা সংসদে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বলতে বা ভোট দিতে পারেন না। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-

কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী রূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি-(ক) উক্ত দল হতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হবেন না।

সংসদের এবং দলের শৃঙ্খলা মানতে হবে: খালিদ মাহমুদ চৌধুরী

This browser does not support the audio element.

আওয়ামী  লীগের সংসদ সদস্য এবং নৌ প্রতিন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘সংসদে আমাদের কার্যপ্রণালী বিধি আছে। সেটা আমাদের মেনে চলতে হয়। আমাদের সংসদীয় দল আছে, তার সিদ্ধান্ত আমাদের মানতে হয়।  তবে দলের ভিতরে এবং সংসদীয় দলের ভিতরে আমরা মন খুলে কথা বলতে পারি। কিন্তু  সংসদের এবং দলের শৃঙ্খলা মানতে হবে।”

তার দাবি, "সংদের বাইরেও আমরা কথা বলি।স্বাধীনভাবেই কথা বলি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছু মাথায় রাখতে হবে। স্থান-কাল-পাত্র বুঝতে হবে। কাণ্ডজ্ঞাণ থাকতে হবে। সেটা না থাকলে তার পরিণতি তো ভোগ করতে হবে।”

‘‘আমি যেহেতু একটি দল করি, সেই দলের নীতি ও শৃঙ্খলা তো আমাকে মানতে হবে,” বলেন আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য।

অন্যদিকে জাসদ প্রধান হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, ‘‘সংসদে তো আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করি। কিন্তু আমাকে তো হুইপিং মানতে হবে। আমরা দলের যে কয়জন এমপি আছি, তারা তো দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারি না।আর সংসদের বাইরেও স্বাধীনভাবে কথা বলি।”

ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমি সংসদের বাইরে টিআর, কাবিখা নিয়ে কোনো কোনো সংসদ সদস্যের দুর্নীতি নিয়ে বলেছি। সেখানে স্বাধীনভাবেই বলেছি। কিন্তু সংসদ সদস্যরা মনে করেছেন এতে তাদের অবমাননা হয়েছে, তাই ক্ষমা চেয়েছি। বাইরে তো আমি আমার বক্তব্য প্রত্যাহার করিনি, ক্ষমাও চাইনি।”

তবে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা দাবি করেন, ‘‘আমি চাইলেও সংসদে মন খুলে সব কিছু বলতে পারিনি। আমার দলের প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কটূক্তি করা হয়েছে, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কটূক্তি করা হয়েছে জবাব দিতে পারিনি। কারণ, আমার ভয় ছিল আমি ঠিকমতো বাসায় ফিরতে পারব কিনা।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘সংবিধানের ৭০ ধারা যতদিন আছে ততদিন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ায় সমস্যা আছে। তবে আমরা তো বিরোধী দল তাই আমার দলের বিরুদ্ধে কী বলবো?”

তার কথা, ‘‘বাইরে আমরা দলের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলি। বলতে পারি। কিন্তু আওয়ামী লীগের এমপিদের তো তা বলতে দেখি না।

সংসদে বিতর্ক

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে জাতীয় সংসদেও কথা হয়েছে। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল এটা নিয়ে সংসদে বিতর্ক হয়।

ওই দিন ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিল' পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে ৭০ অনুচ্ছেদের সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘‘সংসদের কি খুব একটা ক্ষমতা আছে? যিনি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা তার হাতেই সব ক্ষমতা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কারো কিছু বলার ক্ষমতা আছে? সদস্য পদ কি থাকবে?”

তিনি বলেন, ‘‘যতক্ষণ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ থাকবে ততক্ষণ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা নেই। বাজেটে সংসদ সদস্যদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ নেই।”

বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা তখন বলেন, ‘‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা কতটুকু আছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।” জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ‘‘৭০ অনুচ্ছেদ কেন এসেছে তা ড. কামাল হোসেনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সংসদ সদস্যদের কেনা-বেচা হত। এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। কিন্তু এখনকার বাস্তবতা হলো দলের বিরুদ্ধে ভোট না, দলের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলা যাবে না। এর ফলে সংসদে জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন হচ্ছে না।”

''৭০ অনুচ্ছেদের কারণে এমপিদের ক্ষমতা কতটুকু!''

This browser does not support the audio element.

৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘অতীতে যে কারণেই সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হোক না কেন এখন এটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এই অনুচ্ছেদের কারণেই সংসদের ভেতরে যেমন, সংসদের বাইরেও সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন না।”

তার কথা, ‘‘তবে আমাদের মনে রাখতে হবে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলা হলেও এটা শর্তযুক্ত। আমাদের মনে রাখতে হবে ইউরোপ-অ্যামেরিকায় ধর্মের সমালোচনা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপট মাথায় রাখতে হবে। দায়িত্বশীল হতে হবে।”

তিনি বলেন, "তবে অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে দিতে হবে। এজন্য হয়রানি করা গ্রহণযোগ্য নয়। দলীয় সংসদ সদস্যরা বাইরে কতটা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবেন, তা নির্ভর করে দলের মধ্যে কতটা গণতন্ত্র আছে তার ওপর।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ