জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রোববার সকালে মারা গেছেন৷ ফেসবুকে-টুইটারে তার প্রতিক্রিয়া পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম কর্মে এমনকি মৃত্যুতেও কবিযশোপ্রার্থী এই সৈনিক রাষ্ট্র ও সমাজকে কতোভাবে বিভক্ত করতে পেরেছেন৷
বিজ্ঞাপন
আর হা অবশ্যই গণতন্ত্র,এরশাদ প্রসঙ্গ এলে অতি অবশ্যই গণতন্ত্রের কথা আসে৷ কথা আসে কীভাবে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে তিনি গণতন্ত্রকে তালা দিয়ে রেখেছিলেন, কীভাবে গণতন্ত্রকে নিয়ে খেলেছেন গলফ৷ তাকে স্বৈরাচার বলা সহজ, প্রশ্ন উঠেছে যাদের বলা সহজ নয় তারা আরও কত বড় স্বৈরাচার?
ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছিলেন এরশাদ, এর জন্য তাকে সমালোচনা করেছেন বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ৷ কিন্তু এরপর যে আরো তিন দশক পার হলো, সেইসব বুদ্ধিমানেরা যাদের গলা ডুবিয়ে সমর্থন করছেন তারাও কিন্তু রাষ্ট্রের ধর্মপ্রাপ্তি বাদ দেন নাই৷ বলা হচ্ছে এখন আর মানুষ মেনে নেবে না৷ যদি তাই হয় তবে এরশাদ ধর্মের রাষ্ট্রীয়করণ করে খুব গণতান্ত্রিক কাজ করেছেন৷
এরশাদের দল নিয়ে বলতে হয়৷ পুরোপুরি তার বুকপকেটে থাকা একটি স্তাবক সংগঠন৷ সাবেক রাষ্ট্রপতি যা বলবেন, যা করবেন, তা মেনে না নিতে পারলে বা তার নির্দেশ মানতে ব্যর্থ হলে আপনি কখনো মঞ্জু, কখনো মঞ্জুর, কখনো কাজী জাফর, আপনার আলাদা জাতীয় পার্টি৷ এরশাদের গুডবুকে থাকলে আপনার জীবন রওশন, না থাকলে আপনি বেদিশা৷
কিন্তু এরকম একটি দলের প্রধানের সঙ্গে রাজনীতি করতে সবাই পছন্দ করেছেন৷ মঞ্জু বা মঞ্জুরেরা রাজনীতিবিদ হিসেবে এই দেশে গুরুত্বপূর্ণ৷ লোকে তাদের ভোট দেন, শেখ হাসিনা দেন পতাকা৷ তাদের সন্তানেরা মাঠ কাঁপিয়ে নৈতিকতা শেখান৷
অবশ্য যোদ্ধা বা রাজনীতিবিদ হিসেবে এইচ এম খুব শক্ত মনের ছিলেন বলে মনে হয় না৷ মোটা দাগে দুটো উদাহরণ দেওয়া যায়, বিএনপির জন্য তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ করেছিলেন এরশাদ আর আওয়ামী লীগ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে নির্বাচনে নিয়ে এসেছিল৷ এরশাদের প্রতিটি রাজনৈতিক অন্যায়ের দায় আমাদের সব রাজনীতিবিদদের৷
সাবেক রাষ্ট্রপতির নারীপ্রীতির কথা এসেছে অনেক আলোচনায়৷ কিন্তু একনিষ্ঠ না থেকে যার প্রতি সবচেয়ে অন্যায় করেছেন সেই রওশনকে আমৃত্যু তার পাশে থাকতে আর অনুসরণ করতে দেখা যায়, আরেক সাবেক স্ত্রী বিদিশা পরিণত বয়সে তার মৃত্যু ঘিরে আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন৷ যত সমস্যা তা যেন আমাদেরই৷ একই অপরাধ তিনি করে বিশ্ববেহায়া অন্য কেউ করলে আমাদের চোখ বন্ধ৷ আমার কিন্তু মনে হয় তার এই প্লেবয় আচরণ আমরা পছন্দই করেছি৷ এমনকি আমার মনে হয় তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের কারো কারো গোপন ইচ্ছাপূরণের প্রতীক৷
এরশাদকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি মজা করেছেন সাংবাদিকেরা, আবার তার কাছ থেকে ন্যায়-অন্যায় বহু সুবিধা তারাই নিয়েছেন৷ রাজধানীতে জমি বা প্লট পাওয়া থেকে শুরু করে তার কাছ থেকে ছোট বড় আর্থিক সুবিধা নেওয়া সাংবাদিকের তালিকাও বেশ বড়৷ সারাজীবন সরকারি চাকরি করা এরশাদ কী করে এত বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন সেই প্রশ্ন করার নৈতিক জায়গা আমাদের অনেকেরই ছিল না৷ তাই ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া কিংবা দিনে রাতে বিচিত্র আর বিপরীত সব কথা বলার পরও আমরাই তাকে আলোচনায় রেখেছি, রেখেছি গুরুত্বপূর্ণ৷
এরশাদ অধ্যায়
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ৷ ৯০ বছর বয়সে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই তিনি মারা গিয়েছেন৷ এর মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত এই রাজনীতিবিদের বর্ণময় অধ্যায়৷
ছবি: Reuters/R. Rahman
শেষ ক’টা দিন
‘‘প্রতিদিন ডাকলে চোখে মেলে তাকানোর চেষ্টা করেন৷ কিন্তু আজ তা করেননি,’’ মৃত্যুর আগের দিন ভাই জিএম কাদের বলেন৷ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় এরশাদের মৃত্যুর ঘোষণা দেন হাসপাতালের ডাক্তাররা৷ গত ২৭ জুন সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে শেষবারের মতো তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়৷ তাঁর রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা ছিল৷ ফুসফুস সংক্রমিত ছিল ও ভুগছিলেন কিডনির জটিলতায়৷ তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল৷
ছবি: Reuters/R. Rahman
অন্যতম আলোচিত চরিত্র
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত চরিত্র হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ৷ সেনা কর্মকর্তা থেকে স্বৈরশাসক, সেখান থেকে গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিক - বারবারই উলটে পালটে দেখেছেন নিজেকে, সবাইকে দেখিয়েছেন৷ আর জন্ম দিয়েছেন একের পর এক আলোচনা-সমালোচনার৷
ছবি: bdnews24.com
কোচবিহারে জন্ম
অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় জন্ম এরশাদের৷ পরিবার রংপুরে চলে এলে সেখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন তিনি৷ ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫২-তে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Samad
সেনাবাহিনীতে এরশাদ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান এরশাদ৷ ১৯৭১-৭২ সালে ছিলেন সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক৷ মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে ফেরেন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৫ সালে মেজর জেনারেল হয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৭৮ সালে হন সেনাপ্রধান৷ পরের বছর পদোন্নতি পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে৷
ছবি: imago/Xinhua
অবৈধ ক্ষমতা দখল ও স্বৈরশাসন
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৯৮১ সালের ৩০ মে৷ প্রথমে ভারপ্রাপ্ত ও পরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার৷ তাঁর সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ৷ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন ১৯৮৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত৷ এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে রাষ্ট্রপতি হন৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Phanvut
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও এরশাদের পতন
১৯৮৬ সালে এরশাদ জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচন দেন৷ আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে৷ তবে বিএনপি তা বয়কট করে৷ নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এরশাদ৷ তবে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়৷ ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সব বিরোধী দল বয়কট করে৷ সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন এরশাদ৷
ছবি: bdnews24.com
নব্বই পরবর্তী এরশাদের রাজনীতি
১৯৯১ সালে কারাবন্দি হন এরশাদ৷ কিন্তু সেখান থেকেই অংশ নেন নির্বাচনে৷ অন্তরীণ অবস্থাতেই ১৯৯১ ও ১৯৯৬ নির্বাচনে পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন৷ ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন৷ তবে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়ার কারণে সংসদে তাঁর আসন বাতিল হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Rahman
এরশাদের জাতীয় পার্টির ভাঙ্গা-গড়া
দলীয় কোন্দলে এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি পরবর্তীতে অন্তত তিন ভাগে ভাগ হয়৷ মূল ধারার চেয়ারম্যান থাকেন এরশাদ৷ স্ত্রী রওশন এরশাদ, ভাই জিএম কাদের এ ধারায় তাঁর সঙ্গে থাকেন৷ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশ হয়েও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তাঁর দল প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন৷ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন এরশাদ৷
ছবি: AFP/Getty Images
রাজনীতির আকর্ষণীয় চরিত্র
এরশাদকে নিয়ে পরবর্তীতে নানা সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মাঝে টানা হ্যাঁচড়া চলেছে৷ তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল, তিনি দলীয় ও রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করতেন৷ তাঁর বক্তব্য প্রায়ই সমালোচনার জন্ম দিত৷ তারপরও নিজ এলাকা রংপুরে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন তিনি৷ সবমিলিয়ে রাজনীতির বর্ণময় এক চরিত্র ছিলেন এরশাদ৷
ছবি: bdnews24.com
ব্যক্তিগত জীবন
এরশাদের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল বৈচিত্র্যময়৷ তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ৷ আরেক স্ত্রী বিদিশার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় ২০০৫ সালে৷ দুই স্ত্রীর ঘরে তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে৷ তারা হলেন- রাহগির আল মাহি এরশাদ, এরিক, আরমান এরশাদ ও জেবিন৷