এরশাদ ও বাঙালির স্টকহোম সিনড্রোম
১৫ জুলাই ২০১৯১৯৭৩ সালে ২৩ আগস্ট সুইডেনের একটি বড় ব্যাংক ক্রেডিটবাংকেনে ডাকাতি করতে যান প্যারোলে মুক্তি পাওয়া জ্যঁ এরিক-ওলসন৷ ব্যাংকের চার কর্মচারীকে জিম্মি করে একটি ভল্টে আটকে রাখা হয়৷ জিম্মিদের না মারার শর্তস্বরূপ ওলসন কারাগার থেকে তার আরেক বন্ধু ক্লার্ক ওলফসনকেও মুক্ত করে আনেন৷
শেষ পর্যন্ত ডাকাতি সফল হয়নি৷ ছয়দিনের জিম্মিদশা কাটিয়ে ২৮ আগস্ট পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন দুই ডাকাত৷ তবে এই ছয় দিনে জিম্মিদের হত্যার হুমকি, পুলিশের ওপর গুলিসহ নানা ধরনের অপকর্মই করেছেন তারা৷
মজার ব্যাপার হলো, মুক্তি পাওয়ার পর চার জিম্মির কেউই ডাকাতদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি৷ তাদের দাবি, ডাকাতদের সঙ্গে তারা খুব ভালো ছিলেন, বরং পুলিশের আচরণে তাদের ভয় লাগছিল৷ এমনকি ডাকাতদের শাস্তি থেকে বাঁচাতে অর্থ সংগ্রহও শুরু করেন জিম্মিরা৷
জিম্মিদের এমন আচরণে বিপদে পড়ে যায় পুলিশ এবং মামলার আইনজীবীরা৷ জিম্মিদের এমন আচরণ বিশ্লেষণে তারা দ্বারস্থ হয় নিলস বেয়েরোট নামের এক মনোবিদের৷ তিনিই এই পরিস্থিতির নাম দেন- ‘স্টকহোম সিনড্রোম'৷ ডাকাত ওলসন পরে বলেছিলেন, জিম্মিরা কথা না শুনলে তিনি ঠিকই তাদের গুলি করে বসতেন, কিন্তু কেনো জানি তিনি যাই বলছিলেন, জিম্মিরা তাতেই সায় দিচ্ছিলো, এমনকি নিজে থেকে সহায়তাও করছিল৷
যারা ‘স্টকহোম সিনড্রোম' নিয়ে এর বেশি জানতে চান, দেখে নিতে পারেন এই ঘটনা অবলম্বনে ২০১৮ সালে নির্মিত ‘স্টকহোম' চলচ্চিত্রটি৷
এরশাদ মারা যাওয়ার পর তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে, বলা উচিত শুরু হয়েছে তাকে মহান বানানোর প্রক্রিয়া৷
মজার ব্যাপার, যে রাষ্ট্রধর্ম করার কারণে তিনি নিন্দিত, সে একই কাজের জন্য অনেকের কাছে তিনি নন্দিতও হচ্ছেন৷ কয়েক দশক পর তার ক্ষমতায় থাকা এবং সিদ্ধান্তগুলো আদালতে অবৈধ ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু এই ‘রাষ্ট্রধর্মে' হাত দেয়ার সাহস পাননি কেউ, না আদালত, না ক্ষমতায় থাকা ‘সেক্যুলার' ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটিও৷
অথচ এই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার মধ্য দিয়ে সংবিধানের মূল চেতনায় আঘাত হানেন এরশাদ। অন্য ধর্মের লোকজনকে সাংবিধানিকভাবে ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকেই' শুধু পরিণত করা হয়নি, রাষ্ট্রকে দেয়া হয়েছিল সাম্প্রদায়িক রূপ৷
আমরা ভুলে গেছি, অন্যান্য সামরিক শাসকদের মতো তার হাতও ছিলো মানুষের রক্তে রঞ্জিত। ১৯৮৩ সালে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে গুলি চালানো হলে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহাসহ বেশ কয়েকজন। তারপরের বছরই ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করা হয় সেলিম-দেলোয়ারকে।
নূর হোসেন তো পরিণত হয়েছেন এক গ্ল্যামারাস শহীদে৷ ফলে তার ভাগ্য ভালো, এখনও তাকে মানুষজন চেনেন৷
এক স্বৈরাচার খাল কেটেছিলেন, সেই খালে এসেছিলেন এক কুমির৷ এরপর থেকে বাংলাদেশ যেনো পরিণত হয়েছে কুমিরের খামারে৷ ধর্মকে যেমন ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য এদেশের বিভিন্ন দল নানাভাবে ব্যবহার করে চলেছে, এরশাদকেও ব্যবহার করা হয়েছে ইচ্ছেমতো৷গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যূত হয়েও আমৃত্যু ক্ষমতার আশেপাশে থাকার সুযোগ এরশাদও ভালোই কাজে লাগিয়ে গিয়েছেন৷
প্রবাদে আছে, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ'৷ অনেকে এখন মনে করেন, ‘পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল'৷ আহারে! বেশিদিন না, হয়তো ১০-১৫ বছর পর আজকের দিনটিও সবার কাছে সোনালী অতীত মনে হবে৷ শাসকেরাও হয়তো আমাদের এই স্টকহোম সিনড্রোমের মনস্তত্ত্ব ভালোই জানেন৷
লেখাটি যখন লিখছিলাম, এ নিয়ে কথা হচ্ছিলো ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিদ্দীনের সঙ্গে৷ তিনি মনে করিয়ে দিলেন এ বিষয়ে একটা মজার কৌতুক৷
এক লোক মারা যাওয়ার সময় তার ছেলেকে বলে গেলো, ‘‘বাবা, এমন কিছু করিস যাতে আমাকে সবাই ভালো বলে৷'' যথারীতি, কয়েক বছর পর সবাই ছেলের বাবাকে ভালো বলতে শুরু করলো৷ গ্রামের সবাই বলতে লাগলো, ‘‘ওর বাপই ভালো ছিলো, শুধু ভয় দেখিয়ে ডাকাতি করতো, পোলায় তো ঘরে আগুন লাগায়া দেয়৷''
পটুয়া কামরুল হাসানের ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে' নামের স্কেচটির কথা মনে আছে? এখন আমার মনেও প্রশ্ন জাগে, তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের নাম কী দিতেন?