সামরিক শাসক থেকে রাজনীতিক, জীবনের পুরোটা সময়ই হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ছিলেন আলোচনা-সমালোচনা, নানা বিতর্কের কেন্দ্রে৷ কখনও রাজনৈতিক মেধা-প্রজ্ঞায়, কখনও একেক সময় একেক কথা বলে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশের পর কখনও আড়ালে যাননি এরশাদ৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এরশাদের সময়ে যেমন উন্নয়ন হয়েছে, তেমনি তাঁর একটা জনভিত্তি গড়ে উঠেছিল৷ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নির্দিষ্ট আসন ছিল তার৷ ফলে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে এরশাদের একটা আকর্ষণ ছিল৷ নিজেদের ভোটের সঙ্গে এরশাদের ভোট যোগ করে জয়ের বন্দর দেখতেন তারা৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি এরশাদের কোনো সমর্থক নই৷ তারপরও বলছি, এরশাদ এমন কিছু করেননি, যা নতুন৷ তাঁর পূর্বসুরীরা যা করে গেছেন এরশাদ তাই করেছেন৷ আমাদের অনেক বিশ্লেষক এমনভাবে বলেন যে, ১৯৮২ সাল থেকেই সামরিক শাসন শুরু৷ অথচ বিষয়টি তা নয়৷ ১৯৭৫ সাল থেকেই সামরিক শাসন শুরু হয়েছে৷ এর আগে তার বড় ভাইরা যা করেছেন, তিনিও তাই করেছেন৷''
এরশাদের একটা জনভিত্তি ছিল: শান্তনু
কেন তিনি ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রে? জবাবে জনাব মজুমদার বলেন, ‘‘এরশাদের একটা জনভিত্তি ছিল৷ এরশাদ কিন্তু অনেক অবিচারের সম্মুখীন হয়েছেন৷ ভুলভাবে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়েছে৷ আপনি দেখেন যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে জাতীয় সংসদে এরশাদ কিন্তু ১০ থেকে ২০ আসন পাবেন৷ এটা কিন্তু এমনিতেই তৈরি হয়নি৷ বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলে তাঁর একটা ভালো অবস্থান রয়েছে৷ এখন ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে আমাদের বড় রাজনৈতিক দল দু'টি তাঁকে কাছে পেতে চেয়েছে৷''
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এরশাদ আজকে যে অবস্থানে পৌঁছেছেন এটা কিন্তু তাঁর যোগ্যতা দিয়েই৷ তিনি যে সবসময় রাজনীতির কেন্দ্রে ছিলেন, তা শুধু চমক দিয়ে নয়৷ তাঁর রাজনৈতিক মেধা ছিল৷ অল্প হলেও ছিল জনভিত্তি৷ আপনি দেখেন এরশাদের শাসনামলে ওই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে৷ এরশাদকে স্বৈরশাসকসহ আরো অনেক কিছু বলা হয়৷ এটা কিন্তু সাধারণ মানুষ বলেন না৷ এখন আমাদের প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সব সময় চেয়েছে তাঁকে কাছে পেতে৷ কারণ প্রতিটি আসনেই এরশাদের ভোট আছে৷ সেটা হয়ত সব আসনে জেতার মতো না, কিন্তু বড় কোন দলের ভোটের সঙ্গে যুক্ত হলে জয়লাভ করার মতো ভোট৷ ফলে এই ভোটগুলো কে না চাইবেন সঙ্গে নিতে৷ ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন হলেও ভোটের রাজনীতির কারণে পরবর্তী সময়ে অনেকেই সেটা ভুলে গেছেন৷ ফলে তাদের কাছে এরশাদ হয়ে উঠেছেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি৷''
তাঁর রাজনৈতিক মেধা ছিল: মহিউদ্দিন
অধ্যাপক মজুমদার বলেন, ‘‘আমাদের মিডিয়া ও অনেক জ্ঞানী গুনি মানুষ রাজনীতিক বিশ্লেষনের সময় সামরিক শাসনের জন্য এরশাদকেই দায়ী করেন৷ অথচ একটি কাজও তিনি করেননি তারা তার পূর্বসুরিরা করেননি৷ আমি তো মনে করি অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়েছে৷ আর তিনি এখন সবকিছুর উর্ধ্বে৷ তারপরও বলছি, এরশাদের একটা জনভিত্তি আছে৷ সেটা ঠিক বা ভুল তা ভিন্ন আলোচনা৷ সেই জনভিত্তিই তাকে আকর্ষণের কেন্দ্রে নিয়ে গেছে৷''
এরশাদ অধ্যায়
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ৷ ৯০ বছর বয়সে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই তিনি মারা গিয়েছেন৷ এর মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত এই রাজনীতিবিদের বর্ণময় অধ্যায়৷
ছবি: Reuters/R. Rahman
শেষ ক’টা দিন
‘‘প্রতিদিন ডাকলে চোখে মেলে তাকানোর চেষ্টা করেন৷ কিন্তু আজ তা করেননি,’’ মৃত্যুর আগের দিন ভাই জিএম কাদের বলেন৷ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় এরশাদের মৃত্যুর ঘোষণা দেন হাসপাতালের ডাক্তাররা৷ গত ২৭ জুন সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে শেষবারের মতো তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়৷ তাঁর রক্তে হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা ছিল৷ ফুসফুস সংক্রমিত ছিল ও ভুগছিলেন কিডনির জটিলতায়৷ তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল৷
ছবি: Reuters/R. Rahman
অন্যতম আলোচিত চরিত্র
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত চরিত্র হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ৷ সেনা কর্মকর্তা থেকে স্বৈরশাসক, সেখান থেকে গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিক - বারবারই উলটে পালটে দেখেছেন নিজেকে, সবাইকে দেখিয়েছেন৷ আর জন্ম দিয়েছেন একের পর এক আলোচনা-সমালোচনার৷
ছবি: bdnews24.com
কোচবিহারে জন্ম
অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় জন্ম এরশাদের৷ পরিবার রংপুরে চলে এলে সেখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন তিনি৷ ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫২-তে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Samad
সেনাবাহিনীতে এরশাদ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান এরশাদ৷ ১৯৭১-৭২ সালে ছিলেন সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক৷ মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে ফেরেন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৫ সালে মেজর জেনারেল হয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে যোগ দেন৷ ১৯৭৮ সালে হন সেনাপ্রধান৷ পরের বছর পদোন্নতি পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে৷
ছবি: imago/Xinhua
অবৈধ ক্ষমতা দখল ও স্বৈরশাসন
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয় ১৯৮১ সালের ৩০ মে৷ প্রথমে ভারপ্রাপ্ত ও পরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার৷ তাঁর সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ৷ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন ১৯৮৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত৷ এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে রাষ্ট্রপতি হন৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Phanvut
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও এরশাদের পতন
১৯৮৬ সালে এরশাদ জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচন দেন৷ আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে৷ তবে বিএনপি তা বয়কট করে৷ নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এরশাদ৷ তবে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়৷ ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সব বিরোধী দল বয়কট করে৷ সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন এরশাদ৷
ছবি: bdnews24.com
নব্বই পরবর্তী এরশাদের রাজনীতি
১৯৯১ সালে কারাবন্দি হন এরশাদ৷ কিন্তু সেখান থেকেই অংশ নেন নির্বাচনে৷ অন্তরীণ অবস্থাতেই ১৯৯১ ও ১৯৯৬ নির্বাচনে পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন৷ ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন৷ তবে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়ার কারণে সংসদে তাঁর আসন বাতিল হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Rahman
এরশাদের জাতীয় পার্টির ভাঙ্গা-গড়া
দলীয় কোন্দলে এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি পরবর্তীতে অন্তত তিন ভাগে ভাগ হয়৷ মূল ধারার চেয়ারম্যান থাকেন এরশাদ৷ স্ত্রী রওশন এরশাদ, ভাই জিএম কাদের এ ধারায় তাঁর সঙ্গে থাকেন৷ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশ হয়েও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তাঁর দল প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন৷ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন এরশাদ৷
ছবি: AFP/Getty Images
রাজনীতির আকর্ষণীয় চরিত্র
এরশাদকে নিয়ে পরবর্তীতে নানা সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মাঝে টানা হ্যাঁচড়া চলেছে৷ তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচনা ছিল, তিনি দলীয় ও রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করতেন৷ তাঁর বক্তব্য প্রায়ই সমালোচনার জন্ম দিত৷ তারপরও নিজ এলাকা রংপুরে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন তিনি৷ সবমিলিয়ে রাজনীতির বর্ণময় এক চরিত্র ছিলেন এরশাদ৷
ছবি: bdnews24.com
ব্যক্তিগত জীবন
এরশাদের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল বৈচিত্র্যময়৷ তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ৷ আরেক স্ত্রী বিদিশার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় ২০০৫ সালে৷ দুই স্ত্রীর ঘরে তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে৷ তারা হলেন- রাহগির আল মাহি এরশাদ, এরিক, আরমান এরশাদ ও জেবিন৷