জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে বৈঠকে নিজের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়লেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানি সফররত এর্দোয়ানের সঙ্গে শুক্রবার রাজধানী বার্লিনে বৈঠকে বসেন ম্যার্কেল৷ পরে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘‘আমি এই সফরকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি, কারণ, মতভিন্নতা থাকলে তা নিরসনে সরাসরি বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷''
নির্বাসিত এক তুর্কি সাংবাদিকের বৈঠকে উপস্থিত থাকার গুঞ্জনে তা বর্জনের হুমকি দিয়েছিলেনএর্দোয়ান৷ ওই সাংবাদিককে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে আঙ্কারা৷
এই প্রেক্ষাপটে বৈঠক হওয়ার পর দুই নেতার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তুরস্কে ‘সাংবাদিকদের স্বাধীনতা' লেখা টি-শার্ট পরে একজন সেখানে ঢুকে পড়েন৷ হামবুর্গভিত্তিক একটি অনলাইন পত্রিকার এই সাংবাদিককে নিরাপত্তাকর্মীরা সরিয়ে নেওয়ার সময় সেখানে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দেয়৷
এর্দোয়ান দেশকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করছে রাজৈনিতক প্রতিপক্ষ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো৷ এর মধ্যে তাঁর এই সফরে তুরস্কে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি তুলে আনতে ম্যার্কেলের ওপর চাপ ছিল৷ বক্তব্যের শুরুতেই তুরস্কে জার্মান নাগরিকদের কারাবন্দিত্বের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি৷
‘‘যত দ্রুত সম্ভব এই মামলার সুরাহার আহ্বান জানিয়েছি আমি,'' বলেন জার্মান চ্যান্সেলর৷
তবে বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন এর্দোয়ান৷
তুরস্কের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন জার্মান চ্যান্সেলর৷ ‘অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল তুরস্কের' প্রতি জার্মানির আগ্রহের কথাও তুলে ধরেন৷
দু্ই বছর আগে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর এর্দোয়ান ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু করলে আঙ্কারার সঙ্গে বার্লিনের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়৷ সে সময় শিক্ষক, সাংবাদিক, সৈন্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বহু মানুষকে জেলে ভরা হয়, নির্যাতিত এসব মানুষের মধ্যে বেশ কয়েকজন জার্মান নাগরিক ছিলেন৷
অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয়
জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট মিনিস্টার (ইউরোপ বিষয়ক) মিশায়েল রথ এর্দোয়ানের প্রতি তুরস্ককে একটি কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার বর্তমান রাজনৈতিক প্রবণতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন৷
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
8 ছবি1 | 8
‘‘আমাদের প্রত্যাশা স্পষ্ট: রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার জার্মান নাগরিকদের মুক্তি, গণতন্ত্রের দিকে অন্তত কিছুটা এগোনো এবং আইনের শাসন৷''
ধুঁকতে থাকা তুরস্কের অর্থনীতির উত্তরণে অর্থনৈতিক সহায়তার সম্ভাবনা নাকচ করে তিনি বলেছেন, তুরস্ক যদি গণতন্ত্র ও সংবিধানের মূল নীতিগুলো প্রতিপালনের দিকে ফিরে আসে তাহলে জার্মান কোম্পানিগুলো আবার দেশটিতে বিনিয়োগ করবে৷
অর্থনৈতিক সহায়তার বিষয়ে জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের দিক থেকেও কোনো সাড়া মেলেনি৷