সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ব্যাপক নির্বাহী ক্ষমতা পাবেন ও প্রধানমন্ত্রীর পদটি বাতিল করা হবে৷ এমনকি তিনি তাঁর রাজনৈতিক দলের সদস্যও থাকতে পারবেন৷ সংসদীয় বিতর্ক চলবে দু'সপ্তাহ ধরে৷
বিজ্ঞাপন
গতবছরের শেষে একটি সংসদীয় পরিষদ নতুন ১৮ ধারার সংবিধানটির খসড়া সম্পর্কে একমত হয়৷ সংসদীয় আলাপ-আলোচনার পর প্রস্তাবটিকে সংসদে দু' পর্যায়ের ভোটে অনুমোদিত হতে হবে৷ অতঃপর একটি গণভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত অথবা প্রত্যাখ্যাত হবে৷
বর্তমান প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ানের প্রতিষ্ঠিত ন্যায় ও উন্নয়ন দল (একেপি বা এ কে পার্টি) বহু বছর ধরে, এমনকি এর্দোয়ান যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই সংবিধান পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করে আসছে, কেননা, শক্তিশালী নেতৃত্ব অধিকতর সমৃদ্ধি এনে দেবে বলে একেপি মনে করে৷
একটি বিরোধী দলের সমর্থন
একে পার্টি তুর্কি সংসদে বৃহত্তম দল হলেও, সংবিধান সংসদের জন্য যে তিন-পঞ্চমাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন, তার জন্য তাদের আরো ১৪টি ভোট আবশ্যক৷ ৫৫০ আসনের তুর্কি সংসদে ৩৩০টি ভোট সংগ্রহের জন্য একেপি দল সংসদের ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী, এমএইচপি দলের উপর নির্ভরশীল৷ এই উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘জাতীয় আন্দোলন দল'-এর সংসদে ৪০টি আসন আছে৷
নতুন তুরস্ক গড়ার অঙ্গীকার দিলেন এর্দোয়ান
ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর টানা তিন সপ্তাহ ধরে এর্দোয়ানের পক্ষে ব়্যালির পর, তুরস্কের ৮০টি শহরে গত রবিবার চূড়ান্ত বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়৷ আঙ্কারা থেকে জানাচ্ছেন ডিয়াগো কুপোলো৷
ছবি: DW/D. Cupolo
রাজপথে নামার আহ্বান
গতমাসে সেনা অভ্যুত্থানের সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান তাঁর সমর্থকদের রাজপথে নেমে ক্ষমতাসীনদের রক্ষায় সেনাবাহিনীকে হটাতে সহায়তার আহ্বান জানান৷ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সত্যিই রাস্তায় নামেন অসংখ্য মানুষ এবং সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়৷ এরপর এর্দোয়ান প্রতিরাতে তাঁর সমর্থকদের রাস্তায় থাকতে আহ্বান জানিয়েছিলেন৷
ছবি: DW/D. Cupolo
লাখো মানুষের উপস্থিতি
রবিবার চূড়ান্ত ব়্যালিতে ইস্তানবুলে হাজির ছিলেন ২০ লাখের মতো মানুষ৷ আঙ্কারায় ছিলেন দশ হাজার৷ তুরস্কের মোট ৮০টি শহরে এ সময় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়৷ এর্দোয়ানের একেপি হচ্ছে প্রথম দল, যেটি ইসলামিক মনোভাব প্রদর্শন সত্ত্বেও একটি সেনা অভ্যুত্থান ঠেকাতে পেরেছে৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা একে দেশটির ইতিহাসরচনাকারী সেনাবাহিনী এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বিপরীতে বড় জয় মনে করছে৷
ছবি: DW/D. Cupolo
এক নতুন তুরস্ক নিয়ে আশাবাদ
ইস্তানবুল থেকে দেয়া বক্তব্যে এর্দোয়ান নতুন এক তুরস্ক গড়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং তাঁর সমর্থকরাও এ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন৷ আঙ্কারার রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী লালে আলিচি সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে আয়োজিত প্রতিটি ব়্যালিতে অংশ নিয়েছেন৷ তিনি জানান, অভ্যুত্থানে জড়িতদের শাস্তি দেয়ার পর তুরস্ক দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে, কেননা তখন সরকারকে বাধা দেয়ার আর কেউ থাকবে না৷
ছবি: DW/D. Cupolo
‘‘আমরা বড় শক্তি হবো’’
ইন্টেরিয়র ডিজাইনার আতালে জানান, তিনি এর্দোয়ানকে সমর্থন দিয়েছেন কেননা তিনি তুরস্ককে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এর্দোয়ান বিশ্বকে জানিয়েছেন, আমরাও আছি এবং শীঘ্রই বড় শক্তিতে পরিণত হবো৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
এইচডিপিকে নেয়া হয়নি
যদিও রবিবারের ব়্যালিতে অংশ নেয়া অনেকে দাবি করেছেন, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে রাস্তায় নেমেছেন তারা, তাসত্ত্বেও বিরোধীরা জানিয়েছেন, সেদেশের তৃতীয়-বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কুর্দিপন্থি ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি)-কে ব়্যালিতে যোগ দিতে দেয়া হয়নি৷ এক কুর্দ এই বিষয়ে বলেন, ‘‘কুর্দ হিসেবে আমি সেখানে যেতে পারি না, কেননা আমি নিরাপদ বোধ করছি না৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের উত্থান
জাতীয় জরুরি অবস্থায় সাধারণত ব্লক করা থাকলেও ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে৷ এর্দোয়ানের ‘ফেসটাইম’ বক্তব্য থেকে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দেখানো ‘পেরিসকোপ’ ভিডিও অবধি সবকিছুই অনেক গুরুত্ব পেয়েছে৷ বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, সরকার নিজেদের জন্য লাভজনক মনে করায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাধা সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷
ছবি: DW/D. Cupolo
6 ছবি1 | 6
সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত শলাপরামর্শ শুরু হওয়ার সময় থেকেই এমএইচপি দল একেপিকে সমর্থন করে আসছে৷ খাতাপত্রে বিরোধীদল হলেও, উভয় দলই তুরস্ককে ‘মহান' করে তোলার স্বপ্ন দেখে৷ তবে এমএইচপি দলের কিছু সাংসদ প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমের বিরোধিতা করেন৷ অবশ্য দলীয় প্রধান দেভলেৎ বাহচেলি ইতিমধ্যেই তাঁর সমর্থন ঘোষণা করেছেন৷ অপরদিকে একেপি দলের একক সাংসদরাও প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন৷ কাজেই সংসদে ভোটের ফলাফল যে শেষমেষ কী হবে তা নিয়ে আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা শক্ত৷
আতাতুর্কের স্বপ্ন
অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর নতুন তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তাফা কেমাল আতাতুর্ক সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে একজনের হাতে বড় বেশি ক্ষমতা না থাকে৷ ১৯৮০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর জেনারেল কেনান এভ্রেন দেশের বুনিয়াদী আইনের পুনর্বিন্যাস করেন৷ কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের ৯৪ বছরের ইতিহাসে রাষ্ট্রপ্রধান ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রচলনের প্রচেষ্টা এই প্রথম৷
তুরস্কের বৃহত্তম বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) নতুন সংবিধানের বিরোধী৷ সিএইচপি'র উপ-সভাপতি বুলেন্ত তেজকান বলেছেন যে, এর ফলে ১০০ বছর আগে সুলতানের হাত থেকে যে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তা আবার ‘রাজপ্রাসাদের' হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ ‘‘আমাদের প্রজাতন্ত্রের যা কিছু অর্জন, তা বিনষ্ট করবে এই সংবিধান সংশোধন'', বলেছেন তেজকান৷ এমনকি তিনি ‘‘একজন মানুষের একনায়কতন্ত্রের'' কথাও বলেন৷ সিএইচপি নেতা কেমাল কিলিচদারোগলু সরাসরি অভিযোগ করেছেন, ‘‘ওরা গণতান্ত্রিক সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে একটি সমগ্রতাবাদী শাসনব্যবস্থায় পরিণত করতে চাইছে''৷
যেভাবে এর্দোয়ানের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে তুরস্কের মানুষ
ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের রাতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান তাঁর সমর্থকদের রাস্তায় নামতে অনুরোধ করেছিলেন৷ আর তখন থেকেই রাস্তা দখলে রেখেছে তাঁর সমর্থকরা৷ আংকারা থেকে জানাচ্ছেন ডিয়েগো কুপোলো৷
ছবি: DW/D. Cupolo
‘এর্দোয়ান আমাদের কমান্ডার’
তারা প্রতিরাতে গাড়ি চালিয়ে আংকারার ‘ডেমোক্রেসি ওয়াচ’ ব়্যালিতে হাজির হন৷ ব়্যালিতে অনেকের মতো হাজির ছিলেন ২১ বছর বয়সি জয়নিপ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এর্দোয়ান যতদিন চাইবেন ততদিন আমি তাঁর প্রতি সমর্থন জানানো অব্যাহত রাখবো৷ তিনি আমাদের ‘কমান্ডার ইন চিফ’৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
অটল, তবে সহজ সমর্থন নয়
‘‘যদি দরকার হয় তাহলে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে হলেও ব়্যালিতে থাকবো’’, বলেন ৩১ বছর বয়সি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদিত৷ তুরস্কের মতো একটি উদ্বায়ী রাষ্ট্র শুধু এর্দোয়ানের পক্ষেই চালানো সম্ভব, মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW/D. Cupolo
স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ঘটানোয় এর্দোয়ানের প্রশংসা
যখন জানতে চাওয়া হয় কেন তিনি এর্দোয়ানের সমর্থক, তখন ২১ বছর বয়সি পাবলিক ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থী কামেল কায়া জানান, এর্দোয়ানের একেপি পার্টি তুরস্কের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিষেবার উন্নয়ন ঘটিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘(এর্দোয়ান) ক্ষমতায় আসার আগে হাসপাতালগুলোর খুব করুণ দশা ছিল৷ তিনি সেগুলোর সংস্কার এবং সামগ্রিক অবস্থা ভালো করেছেন৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
‘রাজনৈতিক ইসলামের’ জন্য চাপ
২২ বছর বয়সি ইসমাইল জানান, তিনি এর্দোয়ানকে সমর্থন দিচ্ছেন কেননা তিনি তুরস্কের সরকারকে দেশটির সমাজের ইসলামিক শেকড়ের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে কোনো সংবিধান চাই না, তবে আমরা এমন একটি চাই যেখানে ইসলামের জন্য আরো জায়গা থাকবে৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
এর্দোয়ানের সমর্থকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা
ব়্যালিতে আগতদের বিনামূল্যে খাবার, পানি এবং পরিবহন সেবা দেয়া হয়, জানান তুরস্কের কুর্দিপন্থি এইচডিপি পার্টির চেয়ার সেলাহাতিন দিমিত্রাস৷ তিনি বলেন, ‘‘অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এর্দোয়ানের সমর্থকদের পানি এবং খাবর দিয়ে স্বাগত জানানো হয়৷ আর দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আমার লোকেরা প্রতিবাদ করে তখন তাদের দিকে জলকামান ছোড়া হয়৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
এর্দোয়ানের চোখে রাষ্ট্রের শত্রু গুলেন
ফেতুল্লাহ গুলেনের একটি প্রতিকৃতি এভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ব়্যালিতে৷ সেটির বুকের উপরে লেখা: ‘‘ফেতু: তোমার অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতা৷’’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে থাকা তুরস্কের ধর্মীয় নেতা গুলেনের বিরুদ্ধে এর্দোয়ানকে হঠাতে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে৷ প্রতিক্রিয়ায় গুলেনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে এর্দোয়ান৷
ছবি: DW/D. Cupolo
গ্রেপ্তার চলছেই
তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এখনও পর্যন্ত ৬০ হাজার মানুষকে আটক, গ্রেপ্তার অথবা চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে৷ এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে যে, তারা ন্যয়বিচার পাবে৷ এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে ৩৪ বছর বয়সি শাহিন বলেন, ‘‘ইউরোপ আমাদের সমাজ নিয়ে শঙ্কিত৷ কেননা তারা জানে, আমরা শীঘ্রই বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হবে৷ আর এ জন্যই তারা আমাদের সমালোচনা করে৷’’
ছবি: DW/D. Cupolo
7 ছবি1 | 7
এর্দোয়ান থাকতে পারবেন ২০২৯ সাল অবধি
খসড়া অনুযায়ী, এই সংবিধান সংশোধন অনুমোদিত হলে এর্দোয়ান আরো দু'টি পাঁচ বছরের কর্মকালের জন্য প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন৷ তাঁর বর্তমান কর্মকালকে না ধরা হলে, এর অর্থ এই যে, এর্দোয়ান ২০২৯ সালে অবধি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন৷