নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন তুরস্কের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
তুরস্কে নতুন যুগ শুরু হয়েছে৷ পুনরায় প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন৷ সংশোধিত নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান সরাসরি নিজেই মন্ত্রী নিয়োগ, সমন জারি এবং বিচারক নিয়োগ করতে পারবেন৷
গত নির্বাচনেও এর্দোয়ানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)-র ভোট ছিল সাড়ে ৪৯ শতাংশ৷ এবারের নির্বাচনে দলীয় ভোট কমে সাড়ে ৪২ শতাংশ হয়ে গেলেও, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি নিজে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন৷
হ্যাঁ এর্দোয়ান বড় ব্যবধানেই জিতেছেন৷ তবে এই জয় তুরস্ককে করেছে দ্বিখণ্ডিত৷ এর্দোয়ানের সমর্থকদের উল্লাসের বিপরীতে, সেখানে অর্ধেক ভোটার বিষণ্ণতায় নিস্তব্ধ, কেননা, তাঁরা জানে এর্দোয়ানের এই জয় গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করে দিয়েছে৷
বিরোধীদল খুব শক্তভাবে লড়াই করলেও এর্দোয়ানকে হারানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না৷ ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠলেও ক্ষমতাসীন একেপি নির্বাচনে দ্রুত তাদের জয়ের ব্যাপারটি ঘোষণা করে এবং তাতেই স্থির রয়েছে৷
এই নির্বাচন যেন অতীতের পুনরাবৃত্তি৷ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ২০১৭ সালে সংবিধান পরিবর্তনে ভোটের ব্যাপারটি৷ সংবিধান পরিবর্তনে তখন ‘হ্যাঁ' ভোট সামান্য ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল৷ জুনের ২৪ তারিখের নির্বাচন ছিল সেই সিদ্ধান্ত পাল্টানোর মোক্ষম সময়৷
তুরস্কের শিল্পীদের আঁকা ব্যঙ্গচিত্র
যে দেশে সংবাদপত্রের স্বধীনতার মুখ চেপে ধরা হয়েছে, সে দেশে কার্টুনিস্টরা কতদূর যেতে সাহস করেন? জার্মানির কাসেল শহরের কারিকাটুরা গ্যালারিতে তুর্কি ব্যঙ্গচিত্রের কিছু নমুনা প্রদর্শিত হচ্ছে৷
ছবি: Caricatura/Ramize Erer
‘আমি কোথায়?’ ভাবছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল
২০১৫ সালে তুরস্কের ‘লেমান’ ব্যঙ্গপত্রিকার প্রচ্ছদে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে দেখানো হয় ‘সুলতান’ এর্দোয়ানের পাশে বসা অবস্থায়৷ ‘এ আমি কোথায় এসে পড়লাম?’ ভাবছেন ম্যার্কেল; তাঁর পরনেও মধ্যযুগীয় অভিজাত জার্মান মহিলাদের বাস৷ ইস্তানবুলের তিনটি নেতৃস্থানীয় ব্যঙ্গপত্রিকার মধ্যে ‘লেমান’ অন্যতম৷ তুর্কি প্রধানমন্ত্রী দাভুতোগলু একবার পত্রিকাটিকে ‘‘নীতিবিগর্হিত’’ বলে অভিহিত করেছিলেন৷
ছবি: LeMan/Caricatura
বুদ্ধিমানেরা সবাই জেলে
২০১৬ সালের জুলাই মাসের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে দেড় লাখ মানুষকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে ও ৪০ হাজার মানুষকে জেলে পোরা হয়েছে – তাদের মধ্যে বহু সাংবাদিক, লেখক ও আন্দোলনকারী৷ ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে আঁকা এই কার্টুনটিতে ৬৬ বছর বয়সি কার্টুনিস্ট ইজেল রোজেনটাল দেখাচ্ছেন, বন্দিরা কীভাবে একটি অশোভন মুদ্রা প্রদর্শন করছে আর প্রহরীরা বলছে, তারা এই ‘বেজন্মা’ বুদ্ধিজীবীদের কি পরিমাণ ঘৃণা করে৷
ছবি: Rozental/Caricatura
গুলেন সর্বত্র
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনরত ফেতুল্লাহ গুলেন ও তাঁর সমর্থকরা জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী, বলে এর্দোয়ানের অভিযোগ এবং বহু তুর্কি নাগরিক সত্যিই তা বিশ্বাস করেন৷ কার্টুনিস্ট ইগিট ওয়েজগুর-র ব্যঙ্গচিত্রে এক তুর্কি বলছেন: ‘‘৯০ শতাংশ তরমুজ নাকি গুলেনের শিষ্য৷’’ সঙ্গের তুর্কিটি বলছেন: ‘‘হতেই পারে৷’’
ছবি: Özgür/Caricatura
এর্দোয়ানের বিপক্ষে গেলেই বিপদ
গত এপ্রিল মাসের গণভোটে ৫১ দশমিক তিন শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোটে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ও প্রেসিডেন্টের প্রভূত ক্ষমতা বাড়ে৷ ভোটের আগে মিডিয়াকে বিরোধীদের হয়ে ‘হায়ির’ বা ‘না’ ভোটের সপক্ষে আন্দোলনের খবর খোলাখুলিভাবে প্রচার করতে দেওয়া হয়নি৷ তাই মার্চ মাসে ইপেক ওয়েজসুসলু এই কার্টুনটি আঁকেন: জলের মিস্ত্রির পশ্চাদ্দেশে ‘হায়ির’ উল্কিটা বেরিয়ে পড়েছে৷
ছবি: Özsüslu/Caricatura
ট্রাম্পও বাদ যাননি
এর্দোয়ানই তুর্কি ব্যঙ্গচিত্রশিল্পীদের একমাত্র লক্ষ্য নন৷ বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্র যাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে কার্টুনিস্টদের বিরাগভাজন হয়েছেন৷ ছবির কার্টুনটিতে বন্দুকধারী মার্কিন সৈন্যের পিছনে একটি ছেলে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘ওদের আমরা শেষমেষ কবে তাড়াব, বাবা?’ বাবা বলছেন, ‘আমাদের তেল ফুরোলে৷’
ছবি: Karabulat/Caricatura
সেক্স যেখানে টাবু
তুরস্কে যৌনতা নিয়ে প্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনা চলে না – বিশেষ করে মহিলাদের যৌনতা নিয়ে তো নয়ই৷ মহিলা কার্টুনিস্ট রামিজে এরার-এর মোটাসোটা ‘ব্যাড গার্ল’ রক্ষণশীল সমাজের ধার ধারে না৷ ছবিতে সেই ব্যাড গার্ল পরপুরুষের সঙ্গে রাত কাটানোর পর সেল্ফি তুলছে; প্রেমিক বেচারা ভয়ে জড়োসড়ো: তার গিন্নি যদি ঐ ছবি ফেসবুকে দেখে ফেলেন?
ছবি: Caricatura/Ramize Erer
দুনিয়াদারি
কার্টুনিস্ট মেহমেত চাগচাগ-এর দৃষ্টিতে দুনিয়ার অবস্থা আজ একটি ছবি দিয়েই বোঝানো যায়: বাগদাদ থেকে এথেন্স, বার্লিন থেকে প্যারিস অবধি এক পর্যায় ঘড়ি, আবহাওয়া অফিসে, পত্রিকার নিউজরুমে, হোটেল অথবা এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে যেরকম থাকে – প্রতিটি ঘড়ি আসলে একটি টাইম বোমা, প্রত্যেকটির পিছনে ডায়নামাইট বাঁধা রয়েছে৷ শুধু কোনটা যে কখন ফাটবে, সেটা জানা নেই৷
ছবি: Cagcag/Caricatura
7 ছবি1 | 7
তুরস্কের গণতন্ত্রের প্রতি এটা ছিল শেষ পেরেক৷ যাঁরা বিরোধীপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, এখন নতুন ব্যবস্থায় তাঁদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে৷
সারা পৃথিবীর দৃষ্টি অনেকদিন ধরেই তুরস্কের দিকে রয়েছে৷ আর সামনে দেশটিকে পর্যবেক্ষণের তালিকায় রাখবে৷ যদিও তুরস্ক এখন আর মিত্র নয়, ফলে তাঁকে খুব সহজেই উপেক্ষা করা যায়৷
এর মধ্যে পশ্চিমের দেশগুলো বিশেষত ইউরোপের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পরবে৷ কেননা, এর্দোয়ানের এখন বিচারিক ক্ষমতা রয়েছে, যা তাঁর ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে৷ ২০১৬ সালে অভ্যুত্থান সফলভাবে মোকাবেলার পর থেকেই এর্দোয়ান ‘জরুরি অবস্থা' জারি করে রেখেছেন৷
আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি সে পথে না হাঁটে, তুরস্কের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য তাহলে কোনো-না-কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হবে৷ কেননা, দেশটি ক্রমাগত ইইউ যে মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত তা ভঙ্গ করে চলেছে৷
তুরস্কের শেষ নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব নেতাদের নিশ্চুপতা বলে দিচ্ছে, তাঁরা তুরস্ককে সাবধানতা ও সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন৷ পরাজয়ের পর প্রধান বিরোধী দল মুহাররেম ইনজের নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (চিএইচপি)-র ভোটরারা হতাশায় আশ্চর্যজনকভাবে নিশ্চুপ রয়েছেন৷ নির্বাচনের পর ভোটের সময় এবং পরে কারচুপির খবর তাঁদেরকে আরও হতাশায় ফেলেছে৷