সমকামীদের গুরুত্ব দিতে না চেয়ে ইস্তাম্বুল কনভেনশন থেকে সরে এসেছেন এর্দোয়ান। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তুরস্কে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ।
বিজ্ঞাপন
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পথে নামলেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের দাবি, ইস্তাম্বুল কনভেনশন থেকে সরে আসার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এর্দোয়ান, তা প্রত্যাহার করতে হবে। বৃহস্পতিবার থেকেই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে রূপায়ণ করা হয়েছে। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রুখতেই ইস্তাম্বুল কনভেশনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল দেশগুলি।
এর্দোয়ান জানিয়ে দিয়েছেন, সিদ্ধান্ত বদলাবে না। তিনি পিছু হটার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেননি। কিন্তু বিক্ষোভকারীরাও প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা, 'ইস্তাম্বুল কনভেনশন নিয়ে আমরা লড়াই ছাড়ছি না। আমাদের কাছে সব শেষ হয়ে যায়নি।' কিছু বিক্ষোভকারী চিৎকার করে বলছিলেন, ''আমরা চুপ করে থাকব না, আমরা ভীত নই, আমরা নির্দেশ মানব না।''
পুলিশ রাতে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে।
এর্দোয়ানের বক্তব্য
বৃহস্পতিবার এর্দোয়ান চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেয়ার পরই বিক্ষোভ শুরু হয়। এর্দোয়ান বলেছেন, ''কিছু মানুষ ভুল করে এই সিদ্ধান্তকে তুরস্কের পিছনের দিকে হাঁটা বলে দেখাতে চাইছেন। কিন্তু মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে আমাদের লড়াই ইস্তাম্বুল কনভেনশন থেকে শুরু ও শেষ হয় না।''
এর্দোয়ান জানিয়েছেন, ''মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে ইতিমধ্যেই আইন করেছে তুরস্ক। সেখানে ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গবৈষম্য করা হয়নি।''
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷
ছবি: picture-alliance/abaca
8 ছবি1 | 8
অন্যরা কী বলছেন
অনেকগুলি অধিকাররক্ষা সংগঠন তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছেন, তুরস্ক একটি বেপরোয়া ও ভয়ংকর বার্তা দিতে চাইছে। তারা মেয়েদের অধিকারের বিষয়টি দশ বছর পিছনে নিয়ে যেতে চাইছে।
তুরস্কের নারী সংগঠনগুলির ফেডারেশনের সভাপতি ক্যানান গুল্লু বলেছেন, ''এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে তুরস্ক নিজের পায়েই গুলি করেছে।''
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস জানিয়েছেন, ''এটা খুবই হতাশাজনক সিদ্ধান্ত।''
ইস্তাম্বুল কনভেনশন
২০১১ সালে ইস্তাম্বুলে কাউন্সিল অফ ইউরোপ একটি চুক্তির খসড়া করে। এই চুক্তিতে লিঙ্গসাম্যকে উৎসাহ দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। আইন, শিক্ষা ও প্রচারের মাধ্যমে তা সুনিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু তুরস্কের কিছু রক্ষণশীলদের দাবি, এই চুক্তিতে লিঙ্গের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য না করার নীতি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এভাবেই সমকামীদের সমর্থন করেছে এই চুক্তি।
কিন্তু সমালোচকদের মতে, তুরস্কে মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রবল। চুক্তি থেকে সরে আসার অর্থ, মেয়েদের আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া। একটি নারী অধিকাররক্ষা সংগঠনের দাবি, গত বছর তুরস্কে ৩০০-রও বেশি নারীকে হত্যা করা হয়েছে।