তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ানের তেহরান সফর আরব এবং ইরানি, দু'পক্ষেরই মন রাখার প্রচেষ্টার অঙ্গ৷ তবে আঞ্চলিক রাজনীতিতে এর বিশেষ কোনো মূল্য নেই, বলে টোমাস সাইবার্টের ধারণা৷
বিজ্ঞাপন
এর্দোয়ান প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাববৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন – এর পরেই তাঁকে তেহরানে গিয়ে ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানির সঙ্গে মোলায়েম আলাপচারী করতে শোনা গেল৷ এটা নিছক এর্দোয়ান: একদিকে বাগাড়ম্বর, অন্যদিকে ঠান্ডা মাথার রাজনীতি৷
তুরস্ক যে এলাকার অন্যান্য শক্তির থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় এর্দোয়ানের নীতিই সে জন্য দায়ী, বিশেষ করে তাঁর একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষামূলক প্রকল্প৷ এর্দোয়ানের ইসলামপন্থি-রক্ষণশীল সরকার তথাকথিত আরব বসন্তকে দেখেন গোটা এলাকায় তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি এবং সুন্নি মুসলমান দেশগুলির সঙ্গে সখ্যতা সৃষ্টির সুযোগ হিসেবে৷
সে গুড়ে বালি
এর্দোয়ানের সে পরিকল্পনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে৷ মিশরে এর্দোয়ানের মিত্র মোহাম্মদ মুর্সিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী – সে যাবৎ দু'টি দেশের সম্পর্ক তিক্ত৷ যেহেতু অপরাপর আরব দেশের নেতৃবর্গ নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মুর্সির মুসলিম ব্রাদারহুডকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন, সেহেতু সৌদি আরব ও অপরাপর প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে তুরস্কের মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়৷
জার্মানিতে সফল কয়েকজন তুর্কি
১৯৮২ সালে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোল বলেছিলেন, তিনি জার্মানিতে বসবাসরত তুর্কিদের সংখ্যা কমিয়ে অর্ধেকে নিয়ে আসতে চান৷ ছবিঘরে থাকছে জার্মানির কয়েকজন সফল মানুষের কথা, যাদের শেকড় তুরস্কে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
চিত্র পরিচালক ফাতিহ আকিন
ফাতিহ আকিন জার্মানির চিত্রজগতের সুপারস্টারদের মধ্যে একজন, যার আন্তর্জাতিক পরিচিতি রয়েছে৷ তাঁর অভিনীত ছবি ‘গেগেন ডি ভান্ড’ (দেয়ালের বিপরীতে) ছবির জন্য তিনি বেশ কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছেন৷ সেগুলোর মধ্যে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব বার্লিনালের ‘গ্লোডেন বেয়ার’ও রয়েছে৷ তাঁর বাবা, মা দুজনই তুরস্ক থেকে এসেছেন৷ ফাতিহ আকিনের জন্ম ১৯৭৩ সালে জার্মানির হামবুর্গ শহরে৷
ছবি: dapd
রাঁধুনি আলি গ্যুনগোরমুস
গ্যুনগোরমুস ২০০৬ সালে একটি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সেরা রাঁধুনির পুরস্কার লাভ করেন৷ তাঁর ‘ল্য কানার নুভো’ নামের রেস্তোরাঁটি নামকরা রেস্তোরাঁর মধ্যে একটি৷ আলি ১০ বছর বয়সে তুরস্ক থেকে এসেছেন৷ ৩৭ বছর বয়সি আলি বলেন, তিনি যে একটি দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছেন সেটাই তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছে৷
ব্যবসায়ী ভুরাল ওয়গার
ব্যবসায়ী ভুরাল ওয়গার ১৯৬০ সালে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে এসেছেন৷ তিনি পড়াশোনা শেষ করার পর একটি আন্তর্জাতিক ট্রাভেল এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেন৷ যেটা জার্মানির বৃহত্তম ট্রাভেল এজেন্সি হিসেবে গড়ে উঠে৷ তিনি ২০০৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এসপিডি দলের হয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে সংসদ সদস্য ছিলেন৷ তাঁর আন্ত:সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের জন্য তাঁকে জার্মানির সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা ‘জার্মান সেবা পদক’ দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রাজনীতিক: সেম ওসডেমিয়ার
তুর্কি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে সেমি ওসডেমিয়ারই প্রথম যিনি ১৯৯৪ সালে সবুজ দলের সদস্য হিসেবে জার্মানির সংসদ সদস্য হন৷ শুধু তাই নয়, পরে তিনি সবুজ দলের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন৷ তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তির একজন সমর্থক৷ ওসডেমিয়ার জার্মান স্কুলে তুর্কি ভাষা শিক্ষা দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উপস্থাপিকা নাজান একেস
হাসি মুখে যিনি বসার ঘরের টিভিতে উপস্থিত হন তিনি হচ্ছেন নাজান একেস৷ তিনি জার্মানির একজন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপিকা৷ অভিবাসী তুর্কি বাবা-ময়ের সন্তান নাজান ছোট বড় অনেক টিভি অনুষ্ঠানেই উপস্থাপনা করেন৷ ২০১০ সালে নাজানের পরিবারের গল্প নিয়ে তাঁর লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে৷ তিনি সামাজিক কর্মকান্ডের সাথেও জড়িত৷ ২০১১ সাল থেকে তিনি জার্মান সরকারের ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিল-এ আছেন৷
ছবি: Getty Images
জার্মান ফুটবল দলের খেলোয়াড় মেসুত ওজিল
মেসুত ওজিল জার্মান ফুটবল তারকাদের একজন৷ তুর্কি বাবা মায়ের সন্তান ওজিল জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৯ সালে জার্মান জাতীয় ফুটবল দলে খেলার সুযোগ লাভ করেন৷ ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় ফুটবল প্রেমীদের হৃদয় জয় করায় তাঁকে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের তালিকায় মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল৷ মেসুত ওজিল জার্মানির সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হেলমুট কোলের বিতর্কিত বিবৃতি
জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোল ১৯৮২ সালে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে বলেছিলেন, তিনি জার্মানিতে বসবাসরত তুর্কিদের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে ফেলতে চান৷ কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, তুর্কিরা জার্মান সমাজের সঙ্গে নিজেদের ভালভাবে খাপ খাওয়াতে পারছেন না৷ ছবিঘরে থাকছে জার্মানির কয়েকজন সফল তুর্কি বংশোদ্ভূত নাগরিকের কথা৷
ছবি: Keystone/Getty Images
7 ছবি1 | 7
যুগপৎ ইসরায়েল, ইরাক এবং সিরিয়ার সঙ্গেও তুরস্কের সম্পর্কের নাটকীয় অবনতি ঘটে৷ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভোতলু এককালে ঘোষণা করেছিলেন যে, তুরস্কের লক্ষ্য হলো, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ‘‘সমস্যাবিহীন'' সম্পর্ক; আজ সেটা প্রতিবেশীদের সঙ্গে ‘‘কোনো সম্পর্ক নেই'', এই পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, বলে নিন্দুকেরা ব্যঙ্গ করে থাকেন৷ এর্দোয়ান ভক্তরা অবশ্য এই পরিস্থিতির নাম দিয়েছেন: ‘‘সম্মানজনক বিচ্ছিন্নতা''৷
অগত্যা?
ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো বড় সংকট দেখা দেয়নি৷ তা সত্ত্বেও সুন্নি ন্যাটো সদস্য তুরস্ক এবং মার্কিন-বৈরি শিয়া দেশ ইরানের মধ্যে প্রথাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায়ই বিরোধের অবতারণা ঘটায় বৈকি৷
ইয়েমেন সংঘাতে সম্প্রতি এর্দোয়ান সুন্নি মহলের আস্থা পুনরার্জন করার সুযোগ পেয়েছিলেন৷ আংকারা ইয়েমেনে সৌদি সামরিক অভিযান সমর্থন করে, এমন আভাস দেয়; অপরদিকে এর্দোয়ান ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের অভিলাষের সমালোচনা করেন৷ এর ফলে উপসাগরীয় দেশগুলি তুষ্ট হলেও, তেহরানে এমন উষ্মার সৃষ্টি হয় যে, এর্দোয়ানের ইরান যাত্রা বানচাল করা হবে কিনা, তা নিয়েও কথা ওঠে৷
তেহরানে মরসুম কেমন?
এর্দোয়ান তাঁর যাত্রার নির্ঘণ্ট অপরিবর্তিত রাখেন, এমনকি ইয়েমেন সংঘাতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেন৷ তিনি শিয়া-সুন্নির পার্থক্য করেন না, সকলেই তাঁর কাছে মুসলমান, বলেন এর্দোয়ান৷ সাম্প্রতিক পরমাণু চুক্তির পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হলে, তুরস্ক ইরানে আরো বেশি পণ্য রপ্তানি করতে আগ্রহী – জানান এর্দোয়ান – যার ফলে তাঁকে আবার সুন্নি আরব দেশগুলির রোষের মুখে পড়তে হতে পারে৷
আজ নয়তো কাল, স্বল্প কিংবা দীর্ঘ মেয়াদে তুরস্ককে আরব তথা ইরানিদের মধ্যে এ কুল ও কুল করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হবে৷ তেহরানের মন রাখলেই শুধু কাজ চলবে না৷ অথচ এ অঞ্চলের রাজনীতি সম্পর্কে যে তুরস্কের কোনো বিশেষ পরিকল্পনা আছে, এমনও তো মনে হচ্ছে না৷