জাতিসংঘের সংস্থা আঙ্কটাড বলছে, করোনার কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হয়েছে৷ এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ ৪৬টি দেশ আছে৷
বিজ্ঞাপন
আঙ্কটাডের ‘লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিস রিপোর্ট ২০২১' বলছে, করোনা মহামারির কারণে দারিদ্র্য, শিক্ষা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল তা থেমে গেছে৷
গরিব দেশগুলোকে সহায়তা দিতে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজারে প্রবেশের সুযোগ দিতে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ ‘লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিস' বা এলডিসি গ্রুপ তৈরি করেছিল৷ বর্তমানে বাংলাদেশসহ ৪৬টি দেশ এই গ্রুপের অন্তর্গত৷ বাকি দেশগুলোর মধ্যে ৩৩টি আফ্রিকার, নয়টি এশিয়ার, তিনটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় রাষ্ট্র ও অন্যটি হাইতি৷
স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে বিশ্বের ১৫ শতাংশ মানুষ (১১০ কোটি) বাস করে৷ তাদের মাত্র দুই শতাংশ লোক করোনার টিকা পেয়েছেন বলে জানিয়েছে আঙ্কটাড৷
এখন পর্যন্ত ছয়টি দেশ ‘স্বল্পোন্নত' থেকে ‘উন্নয়নশীল' দেশে পরিণত হয়েছে৷ এগুলো হচ্ছে বতসোয়ানা, কাবু ভ্যার্দি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও ভানুয়াতু৷
বাংলাদেশনিয়েআলোচনা
গত ফেব্রুয়ারিতে এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পায় বাংলাদেশ৷ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি এই সুপারিশ করে৷ তবে এজন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷
‘টিকা সহজলভ্য না হওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির’
অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো ধীরে ধীরে উন্নতি করছে৷ কিন্তু অন্য দেশগুলোর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- আইএমএফ বলছে এর পেছনে মূল কারণ করোনার টিকার সহজলভ্য না হওয়া৷
ছবি: Reuters/Y. Gripas
টিকার বৈষম্য
আইএমএফের সবশেষ তথ্য বলছে, অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলো এরই মধ্যে গড়ে ৩৯ দশমিক সাত শতাংশ মানুষকে টিকা দিয়েছে৷ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো টিকা দিয়েছে ১১ শতাংশ মানুষকে৷ অন্যদিকে নিম্ন আয়ের দেশগুলো মাত্র এক দশমিক দুই শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে৷
অর্থনৈতিক সহায়তা
অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোতে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে ব্যাপক হারে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়া হয়েছে৷ কোনো কোনো দেশে ২০২২ সাল পর্যন্ত এ সহায়তা বলবৎ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে৷ বেশিরভাগ উদীয়মান দেশে ২০২০ সালেই সহায়তা শেষ হয়ে গেছে৷ অন্যদিকে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জনগণের কাছে তেমন একটা সহায়তাই পৌঁছায়নি৷
ছবি: Getty Images
প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব
এপ্রিলের পর অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ৷ কিন্তু উদীয়মান ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি একই মাত্রায় নিম্নগামী হওয়ায় ২০২১ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ছয় শতাংশই থাকছে৷ বিশ্বজুড়ে মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয় বলেও মনে করেন আইএমএফের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গিতা গোপীনাথ৷
ছবি: picture-alliance/empics/The Canadian Press/J. Hayward
মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা
বিভিন্ন দেশে মহামারির প্রথম ধাক্কার পর ধীরে ধীরে ব্য়বসা-বাণিজ্য খুলে দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু তারপরও অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে তার প্রভাবে বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারক এবং রাজনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করছেন৷ তবে আইএমএফের বিশেষজ্ঞ অবশ্য মনে করছেন, মহামারি থেমে গেলে অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোতে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে৷
ছবি: Reuters/N. Hall
দ্বিমুখী সমস্যা
নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে অবশ্য কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে দীর্ঘদিন৷ একদিকে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়বে৷ অনিয়মিত পণ্য সরবরাহ এবং বাড়িভাড়া বৃদ্ধিও দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/Chromorange
টিকার সাম্যের আহ্বান
টিকার বৈষম্য দ্রুত কমিয়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছে আইএমএফ৷ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ধাক্কা সামলানোর অবস্থায় আনতে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের সব দেশে অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার আহ্বান সংস্থাটির৷ এজন্য যেসব দেশে বাড়তি টিকা রয়েছে, তাদের অন্তত একশো কোটি ডোজ নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দিতে হবে৷ টিকা উৎপাদন ও প্রস্তুতকারীদেরও এসব দেশে আগে টিকা সরবরাহ করতে হবে৷
ছবি: Raisan Al Farisi/ANTARA/REUTERS
6 ছবি1 | 6
আঙ্কটাডের প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে সোমবার এক ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করা হয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷ আঙ্কটাড কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে এলডিসি হিসেবে পাওয়া আন্তর্জাতিক সুবিধাগুলো বন্ধ হওয়ার আগেই কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে৷
আঙ্কটাডের অর্থনীতি বিষয়ক কর্মকর্তা জিওভানি ভ্যালেন্সিসি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের উপর বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল৷ সরকার এসব পদক্ষেপকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে৷ ‘‘এ কারণে তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানি খাতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, যা দ্বিমুখী ধারালো তলোয়ারে পরিণত হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক পদক্ষেপগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হলেও যাতে অগ্রগতি থেমে না যায়, সেজন্য শিল্পের নীতি কাঠামো তৈরি করা দরকার৷''
বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির তুলনায় আরও বাড়াতে এই অর্থনীতিবিদ এ খাতের বিনিয়োগকে আরও গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন৷
জিওভানি ভ্যালেন্সিসি বলেন, বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি করলেও এখনও মাথাপিছু জিডিপি বৈশ্বিক গড়ের মাত্র ১৫ শতাংশ৷ এক্ষেত্রেও বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ রয়েছে৷
করোনায় জার্মানির জিডিপির রেকর্ড পতন
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে (এপ্রিল থেকে জুন) জার্মানির অর্থনীতির ১০.১% ভাগ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ তবে সরকারের নীতির কারণে এখনো দেশটিতে সে অর্থে কর্মী ছাটাই বাড়েনি৷
ছবি: picture-alliance/imageBroker
অর্থনীতিতে বিরাট ধাক্কা
বৃহস্পতিবার এ বছর এপ্রিল থেকে জুনের কিছু অর্থনৈতিক উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে৷ সেখানে দেখা গেছে, জার্মানির অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে রেকর্ড পতন হয়েছে (১০.১%)৷ এমন একটি সময়ে জার্মানির কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর এই তথ্য প্রকাশ করল, যখন পুরো ইউরোপ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance /J. Tack
১৯৭০-এর পর প্রথম
১৯৭০ সালে সবশেষ অর্থনীতির এমন পতন দেখেছিল জার্মানি৷ পরিসংখ্যান দপ্তর বলছে, করোনার কারণে এমনকি বাসাবাড়িতে ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি ব্যবসায় বিনিয়োগ কিংবা রপ্তানি সবকিছুতেই ধস নেমেছে কোভিড-১৯ এর কারণে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
পরামর্শকদের ধারণা ভুল
মার্চে জার্মানির অর্থনৈতিক পরামর্শকদের প্যানেল বলেছিল যে, পুরো বছরে হয়ত জিডিপির পতন ২.৮% ভাগ হতে পারে৷ তাদের ধারণা ছিল, পাঁচ সপ্তাহের লকডাউন শেষে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি৷
ছবি: Imago Images/F. Sorge
বেকারত্বের হার এখনো স্বাভাবিক
পরিসংখ্যান বলছে, এত কিছু হয়ে গেলেও এ বছর জুলাইতে বেকারত্বের হার ৬.৪%৷ অর্থাৎ বড় আকারে কর্মী ছাটাই হয়নি (মার্চে ছিল ৫%)৷ এতে সরকারের দেয়া প্রণোদনা অর্থ ভূমিকা রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/McPHOTOs
বাড়ছে প্রণোদনার চাপ
দিন দিন সরকারের প্রণোদনার সুবিধা পাওয়াদের সংখ্যা বাড়াতে হচ্ছে৷ যেমন, মে মাসে ৬৭ লাখ মানুষকে সরকারের ‘ফারলো স্কিমের’ আওতায় অর্থ পেয়েছেন, যেখানে এপ্রিলে এ সংখ্যা ছিল ৬১ লাখ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gerten
5 ছবি1 | 5
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানও মধ্যম আয়ের দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদের কার্যকর ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ডমেস্টিক রিসোর্চ মবিলাইজেশন জিডিপির ১০ ভাগ মাত্র৷ এটা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ, এটা দক্ষিণ এশিয়ার কয়েক দেশের তুলনায়ও কম৷ আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে, পাশাপাশি যেসব খাত ভালো করবে সেখানে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার৷''
অধ্যাপক মোস্তাফিজ বলেন, জিডিপিতে যদি উৎপাদন খাতের অবদান দ্বিগুণ করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ দরকার হবে৷ ‘‘বাংলাদেশের মত দেশে বৈষম্য দূর করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কৌশলগত জায়গায় কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে হবে৷ আর আমাদেরকে হোমওয়ার্ক করতে হবে৷''
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক সুবিধা আরও ১২ বছর চালু রাখার কথা বলছে বালাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো৷ হয়ত এত সময় পাওয়া যাবে না, তবুও আমরা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করব৷''
ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো বলেন, বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ যাতে সাবলীলভাবে হয়, সেই সহযোগিতা দিয়ে যাবে জাতিসংঘ৷
ঢাকায় জাতিসংঘ কার্যালয়ের অর্থনীতিবিদ মাজেদুল ইসলামের সঞ্চালনায় আলোচনায় অন্যদের মধ্যে আঙ্কটাডের এলডিসি বিভাগের প্রধান রলফ ট্রেগার বক্তব্য দেন৷