এশিয়ার কয়েক লাখ মানুষের কোনো দেশের নাগরিকত্ব নেই৷ ফলে কোনো ধরনের সুরক্ষা বা আইনি অধিকার ছাড়াই মানবেতরভাবে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের৷
বিজ্ঞাপন
ভারতেরর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে বর্তমানে ১৯ লাখ মানুষ নাগরিকত্বের স্বীকৃতির জন্য লড়াই করছেন৷আসামের নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)-র তালিকায় তিন কোটি ১১ লাখ মানুষের নাম থাকলেও এই ১৯ লাখ বাদ পড়েছেন৷ ওই তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে৷
গত ৮ সেপ্টেম্বর আসাম সফর করে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার অনুপ্রবেশকারীদের একে একে বেছে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেবে৷''
ভারতের সমাজবিজ্ঞানী এবং জাতিসংঘের সাবেক কর্মী অনুরাধা সেন মুখোপাধ্যায় এক ব্লগে লিখেছেন, ‘‘এনআরসি প্রক্রিয়া রাষ্ট্রহীনতার সঙ্গে জড়িতদের দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগের কারণ হতে পারে৷''
আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে
02:02
মন্ত্রীর বক্তব্য এবং মুখোপাধ্যায়ের সতর্কতা এটা ভাবনার খোরাক যোগায় যে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে আসলে কী আছে৷ কারণ, মিয়ানমার সরকার এদের ‘বাঙালি' নামে অভিহিত করে আর বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়ে ‘অবৈধ অভিবাসী' হিসেবে বিবেচিত করছে৷
বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত সংখ্যালঘুগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিবেচনা করা হচ্ছে, বাস্তবেও এরা রাষ্ট্রহীন৷ জাতিসংঘের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরাও একমত হয়েছেন, এই রাষ্ট্রহীনতা রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত পরিস্থিতিকে আরো বাড়িয়ে তুলছে৷
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ২০১৩ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে৷
‘পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে’
02:40
This browser does not support the video element.
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হওয়ার পর এশিয়াতে অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ সুনীল এস অমৃত বলেন, সাম্রাজ্যের পতন এবং নতুন সীমানা নির্ধারণের পর অসংখ্য শরণার্থীর জন্ম হয়৷ সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর ১০ থেকে ১২ মিলিয়ন মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায়৷
এশিয়াজুড়ে সাংস্কৃতিক এবং ভাষাতত্ত্বের ভিত্তিতে জাতিগত ও ধর্মীয় রাষ্ট্রের জন্ম হয়৷ নতুন রাষ্ট্রগুলোকে অল্প সময়ের মধ্যে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করতে হয়েছিল, সে সময় তারা উপনিবেশিক আইনগুলো গ্রহণ করায় এই সমস্যার উদ্ভব হয়৷
স্বাধীনতার পর এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ আইন অনুযায়ী তাদের নাগরিকদের সন্তানদেরকেই কেবলমাত্র নাগরিকত্ব দিয়েছিল৷ ফলে ওইসব দেশে থাকা ওই সময়কার শরণার্থীদের ভাগ্য আর বদল হয়নি৷
আইন বিশেষজ্ঞ অলিভিয়ার ভনক সম্প্রতি এশিয়ার নাগরিকত্ব নিয়ে তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ ‘সিটিজেনশিপ ইন এশিয়া'-তে লিখেছেন, ‘‘এশিয়া সম্ভবত একমাত্র মহাদেশ যেখানে নাগরিকত্বকে সবচেয়ে ঈর্ষান্বিতভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে৷''
রডিয়ন এবিবিহাউসেন/এসআই/এসিবি
নাগরিকত্ব এবং রাষ্ট্রহীন মানুষের ঠিকানা
বিশ্বে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ দেশহীন৷ বঞ্চিত মৌলিক অধিকার থেকে৷ টিকে আছে কোনোরকম৷ চলুন দেখি, কোথায় আছে ঠিকানহীন মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
বাংলাদেশ/মিয়ানমার
১৯৮২ সালে বৌদ্ধ প্রধান মিয়ানমারে নাগরিকত্ব নিয়ে একটি আইন পাশ হয়৷ আর তাতেই নাগরিকত্ব হারায় মুসলিম প্রধান রোহিঙ্গারা৷ জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হন৷ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় মানবিক বাংলাদেশ৷ জনসংখ্যার চাপে থাকা ছোট্ট দেশটিতে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Jones
আইভরি কোস্ট
ছয় লাখ ৯২ হাজার ঠিকানা বিহীন মানুষকে ঠাঁই দিয়েছে আইভরি কোস্ট৷ বুরকিনা ফাসো, মালি, ঘানা থেকে এই লোকগুলো এসছে আইভরি কোস্টে৷ দেশটির কফি এবং তুলা চাষের সঙ্গে জড়িয়ে কোনোরকম দিন যাপন করছে নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এসব মানুষ৷ দেশটির মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ বিদেশি নাগরিক৷ যারা এখন বাস্তুচ্যুত৷
ছবি: Benoit Matsha-Carpentier/AFP/Getty Image
থাইল্যান্ড
চার লাখ ৭৯ হাজার রাষ্ট্রহীন মানুষের বসতি থাইল্যান্ডে৷ পাহাড়ি নৃগোষ্ঠী ইয়াও, হ্যামং এবং কারেন সম্প্রদায়ের মানুষ এরা৷ মিয়ানমার এবং লাওস সীমান্তবর্তী পর্বত এলাকায় তাদের অস্থায়ী আবাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Asfouri
ইস্তোনিয়া/লাটভিয়া
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বাল্টিক রাষ্ট্র গঠন হলে, কপাল পোড়ে অন্তত দুই লাখেরও বেশি মানুষের৷ কারণ তাদের আর কোনো ঠিকানা নেই, কোনো বসতি নেই৷ তাদের দুই লাখ ২৫ হাজার আছেন লাটভিয়াতে আর ৭৮ হাজার আছেন ইস্তোনিয়ায়৷
ছবি: Reuters/I. Kalnins
সিরিয়া
১৯৬২ সালের কথা৷ আরবকরণের প্রক্রিয়ায় বলি হয়ে, নাগরিকত্ব হারান কুর্দরা৷ গৃহযুদ্ধের আগে অন্তত তিন লাখ কুর্দ হয়ে পড়ে দেশহীন৷ জাতিসংঘের হিসেব মতে, এখনও সিরিয়ায় নাগরিকসুবিধা বঞ্চিত হয়ে বাস করছে ১ লাখ ৬০ হাজার কুর্দ৷ অনেকে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Xinhua/M. Abu Ghosh
কুয়েত
১৯৬১ সালে স্বাধীনতা এলেও নাগরিক স্বীকৃতি জোটেনি যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত বেদুঈনদের৷ জাতিসংঘের তথ্য মতে, ৯২ হাজার বেদুঈন আছে কুয়েতে৷ যারা বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং চাকরির মতো নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত৷
ছবি: AP
ডমিনিকান রিপাবলিক
অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে, ২০১৩ সালে জাতীয়তা বিষয়ক আইনে পরিবর্তন আনার পর, আদালত থেকে রুল জারি করা হয়৷ আর তাতেই অনেকেই হয়ে যান দেশহীন৷ এমনকি, হাইতি থেকে আসা অনেক মানুষ ডমিনিকে জন্ম নিলেও মেলেনি নাগরিকত্ব৷ জাতিসংঘের ২০১৫ সালের হিসেব বলছে, এখানে রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার৷
ছবি: picture alliance/dpa
ইরাক
নাগরিক সুযোগ বঞ্চিত সাড়ে ৪৭ হাজার মানুষের আবাস ইরাক৷ এদের মধ্যে আছেন, ঐতিহাসিকভাবে ইরাক-ইরান সীমান্তে বসবাসকারী কুর্দ, ফিলিস্তিনের শরণার্থী আর বেদুঈনরা৷
ছবি: picture-alliance/AP/K. Mohammed
ইউরোপ
ভারতীয় বংশোদ্ভুত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রোমা৷ এই সম্প্রদায়ের হাজার দশেক মানুষের বাস, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে৷ তারাও আছেন নাগরিকত্ব সংকটে৷ চেকোশ্লাভাকিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে গেলে, তাদের পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায় নতুন রাষ্ট্র৷ কসভো আর বসনিয়ায় ঠাঁই নেয়া রোমারাও যুদ্ধের কারণে পরিচয় সংকটে পড়ে যান৷
ছবি: picture-alliance/ZB
কলম্বিয়া
ভেনেজুয়েলায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে অনেক মানুষ পাড়ি জমান কলম্বিয়ায়৷ যাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছে অন্তত ২৫ হাজার শিশু৷ তারাও আছে পরিচয় সংকটে৷ কারণ, কলম্বিয়া নাগরিকত্ব পেতে বাবা-মায়ের মধ্যে একজনের সে দেশের নাগরিকত্ব থাকতে হয়৷