1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এসআইআর আতঙ্কে কেন পশ্চিমবঙ্গে পরপর আত্মহত্যা?

৩১ অক্টোবর ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর ঘোষণার পর ৭২ ঘণ্টায় দুইজন আত্মহত্যা করেছেন, একজন আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেন এই ঘটনা ঘটছে?

দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সদরদপ্তর।
নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর-এর কাজ শুরু করার পরেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ছবি: Adnan Abidi/REUTERS

পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের কাজ শুরু হয়েছে গত সোমবার। সেই রাতেই আত্মহত্যা করেন পানিহাটির প্রদীপ কর। পুলিশের দাবি, তার সুউসাইড নোটে লেখা ছিল, 'আমার মৃত্যুর জন্য এনআরসি দায়ী।' মঙ্গলবার দিনহাটার খইরুল শেখ বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তিনিও এসআইআর আতঙ্কে এই কাজ করেছেন বলে পরিবারের দাবি। বৃহস্পতিবার বীরভূমের ইলমবাজারে এক বৃদ্ধ আত্মহত্যা করেন। তিনি ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নিজের নাম খুঁজে না পেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন বলে পরিবারের দাবি। 

এসআইআর শুরু হওয়ার পর এই ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, ভোটার তালিকার সংশোধন নিয়ে সাধারণ মানুষ কতটা আতঙ্কে আছেন। প্রত্যাশিতভাবেই আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে প্রবলভাবে রাজনীতি শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেন এত তাড়াহুড়ো করে এসআইআর করা হচ্ছে?

প্রশ্নের মুখে এসআইআর

এ মাসেই বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে মাস তিনেকের মধ্যে সে রাজ্যে এসআইআর প্রক্রিয়া শেষ করে ফেলা হয়েছে। ৬৯ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ গিয়েছে। ২১ লক্ষের নাম যুক্ত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। সুপ্রিম কোর্টে এই সংক্রান্ত মামলা বিবেচনাধীন। তারই মধ্যে ১২টি রাজ্যে নিবিড় সমীক্ষার ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।

২০০২ সালের তালিকার সঙ্গে এ বছর প্রকাশিত তালিকা মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের ভোটার ছিল সাড়ে চার কোটির বেশি। এখন সাড়ে সাত কোটির বেশি নাম রয়েছে তালিকায়। ৭ জানুয়ারি খসড়া ও ৭ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করার কথা বলেছে কমিশন। মাত্র তিন মাসের মতো সময়ে এই বিপুল সংখ্যক ভোটারের সমীক্ষা কি সম্ভব?

বিহারের প্রক্রিয়া এই সময়ের মধ্যে শেষ হলেও তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠেছে। মহিলা ও দলিত ভোটারদের নাম বাদ গিয়েছে বেশি। সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় একই ছবি। এই সংক্রান্ত মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও কেন পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১২ রাজ্যে এসআইআর ঘোষিত হল, এই প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা।

কংগ্রেস-সহ বিজেপি বিরোধী দলগুলির প্রশ্ন, কেন অনেকটা সময় হাতে নিয়ে এসআইআর-এর কাজ শুরু করা হল না? পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন আগামী এপ্রিল মাস নাগাদ হবে, এটা বহু আগেই ঠিক ছিল। তাহলে কেন নভেম্বর থেকে নিবিড় সমীক্ষা শুরু করা হচ্ছে? এত অল্প সময়ের মধ্যে বিএলওরা কীভাবে তিনবার ভোটারদের দরজায় পৌঁছবেন?

পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি

বিহারে মোটের উপরে নির্বিঘ্নেই মিটেছে সমীক্ষার পর্ব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাত চরমে উঠেছে এসআইআর ঘিরে। দুইটি আত্মহত্যা ও একটি আত্মহত্যার চেষ্টার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘বিজেপির ভয়, ঘৃণা এবং বিভাজনের রাজনীতির করুণ পরিণতির সাক্ষী থাকছি আমরা। বাংলায় এসআইআর ঘোষণার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে একের পর এক ট্র্যাজেডি ঘটছে, যা অনায়াসে এড়ানো যেত। এর জন্য দায়ী কে? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি এর দায় নেবেন? বিজেপি আর তাদের জোটসঙ্গীরা, যাদের তত্ত্বাবধানে এই ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাদের কি কিছু বলার সাহস আছে?’’

মমতা বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক নাগরিককে বলছি, বিশ্বাস হারাবেন না। কোনও চূড়ান্ত পদক্ষেপ করবেন না। আমাদের সরকার আপনার পাশে আছে। আমরা বাংলায় এনআরসি হতে দেব না। সামনের দরজা দিয়েও নয়, পিছনের দরজা দিয়েও নয়।'' 

বিজেপি এসব কথা খারিজ করে এটাকে তৃণমূলের পরিকল্পনা বলে পাল্টা দাবি জানাচ্ছে।

এরই মধ্যে বিএলওদের একটা ছোট অংশ সমীক্ষার কাজে ডাক পাওয়ার পরে বেঁকে বসেছেন। এমন ৬০০ জনকে শোকজ করে নির্বাচন কমিশন। তা সত্ত্বেও কাজে যোগ দিতে অনিচ্ছুক ১৪৩ জনকে বৃহস্পতিবার বেলা বারোটার মধ্যে কাজ শুরু করতে বলা হয়। কতজন এই হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও কাজে যোগ দেননি, সেই সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য কমিশনের কাছে এদিন রাতেও আসেনি।

রাজ্যের ৮১ হাজারের বেশি বুথের অনুপাতে এই সংখ্যা নগণ্য হলেও সমীক্ষার মূল কর্মীরা যে রাজনৈতিক শিবিরের সাঁড়াশি চাপের মুখে রয়েছেন, সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সূত্রের খবর, এই চাপের মুখে বিএলওদের একাংশ কাজে যোগ দেবেন না, বরং তারা শাস্তির মুখে পড়তেও রাজি।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

যে রাজ্যে নির্বাচন কমিশন হিংসা এড়াতে অনেক দফায় নির্বাচন করে, সেখানে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কেন তিন মাসের মধ্যে নিবিড় সমীক্ষার জটিল প্রক্রিয়া সারতে চাইছে, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "এখন বৈদ্যুতিন ব্যবস্থার বিকাশের ফলে যে কোনো কাজ দ্রুততার সঙ্গে সেরে ফেলা সম্ভব। ২০০২ সালের শেষ নিবিড় সমীক্ষা শেষ হয়েছিল ২০০৪-এ। এখন এই কাজটা দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা গেলেও একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ধরা যাক, সাত জানুয়ারির খসড়া ভোটার তালিকায় কারো নাম নেই। তিনি আবেদন করার পরে সাত ফেব্রুয়ারির চূড়ান্ত তালিকাতেও তার নাম রইল না। সেক্ষেত্রে তিনি আদালতে গিয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি চাইতে পারেন। তার মীমাংসা হতে তিন মাস সময় লাগবে। এর মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবে। তিনি ভোট দিতে পারবেন না, ভোটে লড়তেও পারবেন না। এক্ষেত্রে কিন্তু তাড়াহুড়ো হচ্ছে। বৈধ ভোটারদের কোনোভাবেই বাদ দেয়া হবে না, এই সদিচ্ছা যদি নির্বাচন কমিশনের না থাকে, তাহলে বিষয়টা খারাপ দিকে যেতে পারে।" 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিজেপি নেতা বিমলশঙ্কর নন্দ ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটাকে তাড়াহুড়ো বলব কেন? বিহারে কোনো অসুবিধে হয়েছে কি? নির্বাচন কমিশন যদি দ্রুত কাজটা করতে পারে, তাহলে আপত্তির কী আছে? বিহারে তিন চার মাসের মধ্যে ব্যাপারটা সেরে ফেলা গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে যখন মামলা হয়েছে, তখন আদালত বলেছিল এমন নমুনা নিয়ে আসতে যেখানে অন্যায়ভাবে নাম বাদ গিয়েছে। এখনকার কমিউনিকেশনের যুগে তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব নয়। বিএলওরা সেটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে করতে পারবেন। এখানে বড় বাধা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। তারা এই প্রক্রিয়াকে সফলভাবে করতে দিতে চায় না।"

তার মতে, "যারা বাইরে আছেন, তাদের হুড়োহুড়ি করে আসার দরকার নেই। এ জন্য অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী যখন অনলাইন পেমেন্টের ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তখন বলা হয়েছিল, ফুটপাতের মানুষ কি এসব ব্যবহার করতে পারবেন। এখন ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা আমাদের থেকে বেশি অনলাইন পেমেন্টের আশ্রয় নিচ্ছেন।"

সমীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "২০০২ সালকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরার পিছনে কোনো যুক্তি নেই। এ বছর জানুয়ারিতে যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেটা থেকে মৃত বা স্থানান্তরিত ভোটারদের বাদ দিয়ে দিলে সহজে কাজটা হয়ে যেত। কত অনুপ্রবেশকারী তালিকায় যুক্ত হয়েছেন, সেটা খোঁজার জন্য দুই দশক আগের তালিকাকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরা হচ্ছে। এটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কোনো সার্ভে বা শুমারি হয়নি যা থেকে বলা যায়, কত মানুষ অনুপ্রবেশ করেছেন। এই সংক্রান্ত যে আরটিআই হয়েছিল, তার সদুত্তর সরকার দিতে পারেনি। এত মানুষ কী করে অন্য দেশ থেকে ভারতে ঢুকে গেল, তার জবাবদিহি কে করবে? বিএসএফ, র, গোয়েন্দা বিভাগ কী দায়িত্ব পালন করল? তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায় না। ২০২১-এ জনশুমারি হলে বলা যেত, কোথায় কত জনসংখ্যা বেড়েছে।"

তার বক্তব্য, "এই বছর করো নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেলে, তিনি এবার ভোট দিতে পারবেন না। কিন্তু পরের বার তার নাম তোলার একটা ব্যবস্থা থাকবে। তখন নাম তোলা যাবে যদি নথিপত্র ঠিকঠাক দেয়া যায়। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এই এসআইআর করা হচ্ছে সামনের নির্বাচনকে মাথায় রেখে। আপনি যদি পরে ভোটদাতা হিসেবে যোগ্য হন, তাহলে এখন অযোগ্য কেন? তাহলে কি এর পিছনে এমন কোনো পরিকল্পনা রয়েছে যে, এই ভোটারদের নাম আগামী নির্বাচনের জন্য বাদ দেয়া হোক, পরের ভোটের বিষয়টা পরবর্তীকালে বিবেচনা করা যাবে।"

এর পরে এনআরসি?

এসআইআর-এর প্রক্রিয়া নিয়ে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তার জন্য অনেকটা দায়ী নাগরিকত্ব হারানোর দুর্ভাবনা। ভোটার হিসেবে স্বীকৃতি হারালে কি দেশছাড়া হতে হবে বা ঠাঁই হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে, এমন গুজব নিবিড় সমীক্ষা নিয়ে ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের মত।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, "এসআইআর ও এনআরসি দুটি আলাদা বিষয়। দ্বিতীয়টি নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ব্যাপার। ভোটার তালিকা সংশোধনের ক্ষেত্রে যদি কোনো ভোটারের নথি ভুয়ো হয়, তাকে তালিকা থেকে কমিশন বাদ দিতে পারে। এনআরসির ক্ষেত্রে যার কাছে প্রকৃত নথি থাকবে, তারও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এটা এখন হওয়ার কথা নয়, অথচ বিজেপি ও তৃণমূল উভয়ই এটা নিয়ে ভুল বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। তাই এসআইআর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু না থাকলেও এই দুটি দলের প্রচারে সেটাই হচ্ছে। এদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে এসআইআর হচ্ছে। মৃত, স্থানান্তরিত বা একাধিক তালিকায় থাকা ভোটারদের নাম বিয়োজনের জন্য এই প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। এর সঙ্গে এনআরসির সম্পর্ক নেই।"

যদিও ভিন্নমত জানিয়ে মইদুল বলেন, "অনেকের কাছে এই ধারণা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে, ভোটার তালিকার নিবিড় সমীক্ষার সঙ্গে নাগরিকত্বের যোগ আছে। দেশজুড়ে এনআরসি হবে, এ কথা কয়েক বছর আগেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন। আগে সিএএ কার্যকর হবে, তারপর হবে এনআরসি। প্রথমটি কার্যকর হয়ে গিয়েছে, এবার এসআইআর-এর মাধ্যমে এনআরসি হতেই পারে। অসমে ডি-ভোটার বা ডাউটফুল ভোটারের যে ভাবনাটা আনা হয়েছিল, সেটা এনআরসি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফলে আমাদের এখানেও সেটা হতে পারে, এই আশঙ্কা খারিজ করা যায় না।"

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ