সৌরশক্তি, সোলার পাওয়ার – এ সব যদি সিলিকন দেওয়া সোলার সেল থেকে না এসে অরগ্যানিক সোলার ফোলিও থেকে আসে? এই ধরুন বাড়ির দেয়াল থেকে শুরু করে জামাকাপড় – সব কিছুতেই যদি সোলার ফোলিও লাগিয়ে ব্যাটারির মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যায়?
বিজ্ঞাপন
টিবো: গুগল যেভাবে সফটওয়্যারের দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে, আমরা সেভাবে জ্বালানি শক্তির দুনিয়াকে বদলে দিতে পারি৷
মার্টিন: আমরা সত্যি সত্যিই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন; গত ছ'বছর ধরে ঐ খেতাব আমাদের হাতে৷
এই দু'জনের কল্পনা ছিল: একটি বাড়ির দেয়াল, জানলা কিংবা বাইরেটা, সব কিছু থেকে জ্বালানি অর্জন করা৷ হ্যাঁ, সোলার ফোলিও বসিয়ে৷ টিবো লে সিগিয়ঁ যখন বিনিয়োগকারীদের খোঁজে যান, তখন এই সোলার ফোলিও তাঁর সঙ্গেই থাকে৷
জাতে ফরাসি টিবো ড্রেসডেনের হেলিয়াটেক কোম্পানির পরিচালক৷ তাঁর কোম্পানি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম-এর কাছ থেকে ‘টেক-পাইওনিয়ার' বা প্রযুক্তি-পথিকৃৎ আখ্যা পেয়েছে৷ তাঁকে ডাভোসে আসার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে৷
টিবো লে সিগিয়ঁ-র সোলার ফোলিও আগামীতে জ্বালানি ক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে পারে৷ ডাভোসে তাঁর সকাল থেকে বিকেল অবধি একটির পর একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট৷ টিবোর কথায়, ‘‘অন্যান্য অনেক কোম্পানির সিইও-দের সঙ্গে একক বৈঠক হয় – তাঁরা হয়ত আমাদের অংশীদার, গ্রাহক কিংবা বিনিয়োগকারী হতে পারেন৷ ডাভোসে আমি সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগের সুযোগ পাই, বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাই৷''
যদি সোলার ফোলিও লাগিয়ে ব্যাটারির মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, তবে?
04:23
টিবোর ফোলিও-গুলো হচ্ছে অরগ্যানিক সোলার সেল, তাঁর প্রযুক্তি বিভাগের প্রধানের আবিষ্কার৷ কার্বন আর হাউড্রোজেনের মতো পরিচিত পদার্থ দিয়েই তৈরি৷ সিলিকন দিয়ে তৈরি প্রথাগত ফোটোভোলটেইক সেলের চেয়ে অনেক বেশি হালকা; কাজেই টিবোর সোলার ফোলিও ওয়ালপেপারের মতো দেওয়ালে সেঁটে দেওয়া যায়৷
সবে তারা উদ্বাস্তুদের এই তাঁবুটি সোলার ফোলিও দিয়ে মুড়ে দিয়েছেন৷ ভবিষ্যতে যেমন গোটা শহর মুড়ে দেওয়া যাবে৷ মার্টিন ফাইফারের কথায়, ‘‘লক্ষ লক্ষ বর্গমিটার এলাকা, যা থেকে জ্বালানি শক্তি অর্জন সম্ভব হবে৷ তবে যতো গিগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব, তা করতে করতে বহু দশক সময় চলে যাবে৷''
জীবাণুমুক্ত ঘরটিতে প্লাস্টিক ফোলিও-র উপর জৈবিক পদার্থের একটি আস্তরণ স্প্রে করা হয়৷ পরে সেই স্তরই সূর্যালোক থেকে বিদ্যুৎ সৃষ্টি করে৷ এই অরগ্যানিক সেলগুলি সিলিকন সেলের মতো অতটা কার্যকরি নয়, তবে তা নিয়ে কাজ চলেছে৷
কোম্পানিকে আরো বিনিয়োগ করতে হবে৷ শীঘ্রই এখানে কাচের মতো স্বচ্ছ ফোলিও তৈরি হবে, যা জানলায় বসানো চলবে৷ তবে ফোলিও-গুলোকে প্রস্থে ৩০ সেন্টিমিটারের বেশি চওড়া করা দরকার৷ সেজন্য নতুন মেশিন বসানোর প্রয়োজন পড়বে, যার খরচা পড়বে প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ ইউরো৷
বাংলাদেশে সৌরশক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে
বাংলাদেশে গ্রামীণ শক্তি কার্যত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিপ্লব এনেছে৷ ইতোমধ্যে দশ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের রেকর্ড গড়েছে প্রতিষ্ঠানটি৷ ৬৪ জেলাতেই চলছে তাদের কার্যক্রম৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
সৌরবিপ্লব
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কার্যত বিপ্লব এনেছে গ্রামীণ শক্তি৷ গত বছরের শুরুতে দশ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের রেকর্ড গড়ে তারা৷ ২০১৫ সাল নাগাদ আরো দশ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের রেকর্ড গড়তে চায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শুরুর কথা
বাংলাদেশে গ্রামীণ শক্তির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে৷ নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুবিধা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি৷ শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
৬৪ জেলায় কার্যক্রম
বাংলাদেশে ৬৪ জেলাতেই কাজ করছে গ্রামীণ শক্তি৷ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হিসেব অনুযায়ী, ইতোমধ্যে ৫০ হাজার গ্রামে সেবা পৌঁছে দিয়েছে সংস্থাটি৷ গ্রামীণ শক্তির মাধ্যমে পাওয়া সৌর প্যানেল ব্যবহার করে লাভবানের সংখ্যা আট মিলিয়নের বেশি৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
শুধু গ্রামীণ শক্তি নয়
গ্রামীণ শক্তি ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সৌরশক্তি সেবা প্রদান করছে৷ রয়েছে সরকারি উদ্যোগও৷ সরকারি বিভিন্ন ভবনে সৌরশক্তি ব্যবহারের উদ্যোগও শুরু হয়েছে৷ ঢাকায় পরিসংখ্যান ব্যুরো ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে গত বছর৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
জাতীয় গ্রিডের জন্য সৌরশক্তি
সৌরশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ‘রহিমআফরোজ রিনিউবেল এনার্জি’৷ প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে ঢাকার সচিবালয়ের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়েছে৷ তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ মেগাওয়াট প্রতি নির্দিষ্ট দামে কিনে নেবে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: ROBYN BECK/AFP/Getty Images
সহায়তায় জার্মানি
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে সহায়তা করছে জার্মান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা জিআইজেড৷ সোলার প্যানেলে মূল্য বেশি হওয়ায় শুরুতে ভর্তুকিও দিয়েছে জিআইজেড৷ তবে কিস্তিতে সোলার প্যানেল কেনার সুবিধা থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সহজেই সেগুলো ব্যবহার করতে পারছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Centro de Energía Chile
লক্ষ্য অর্ধেক জনশক্তি
২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কাছে সৌরশক্তির সুবিধা পৌঁছে দিতে চান এই খাতের সংশ্লিষ্টরা৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা জানান বাংলাদেশে সৌরশক্তি জনপ্রিয় করার অন্যতম কারিগর দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
মার্টিন ফাইফার জানান, ‘‘সদ্য আবিষ্কৃত প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে ইউরোপে অনেকে দ্বিধা করেন৷ যে কারণে আমরা সারা পৃথিবীতে বিনিয়োগকারীর খোঁজ করছি – একদিকে এশিয়ায়, যেমন চীন, কোরিয়া ও জাপানে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে ঝুঁকি নেওয়ার ও বড় কিছু একটা করার মানসিকতা আছে৷''
ডাভোসের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে হেলিয়াটেক প্রধান টিবো লে সিগিয়ঁ-ও সম্ভব্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, এই সোলার ফোলিও শুধু বাড়ির দেয়ালেই নয়, গাড়ির ওপর বা জামাকাপড়েও সাঁটা যায়৷
প্রশ্ন হলো, চূড়ান্ত সাফল্য পেতে হলে হেলিয়াটেক কোম্পানির এখন কী দরকার? মার্টিনের কথায়, ‘‘টাকা, প্রচুর টাকা৷ আর সম্ভাব্য গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ৷''
আর বললেন, ‘‘আমাদের এখনও কয়েক মাসের মতো টাকা হাতে আছে৷ কিন্তু এই গ্রীষ্মের মধ্যে কিছু একটা ঘটা দরকার৷'' কিন্তু যদি তা হয় তাহলে? ‘‘তখন দেখব, কী করা যায়৷ কিছু একটা তো করতেই হবে৷ সৃজনীশীল হতে হবে৷'' জানান টিবো লে সিগিয়ঁ৷
নিজের ওপর আস্থা থাকা চাই – যেমন গুগল বা টুইটারের ছিল৷ তারাও তো একদিন ছোটখাটো প্রযুক্তি-পথিকৃৎ হয়ে তাদের ধারণা ও প্রেরণা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল৷
দেশেই তৈরি হচ্ছে সোলার প্যানেল
বাংলাদেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান এখন সোলার প্যানেল উৎপাদন করছে৷ এছাড়া সৌরশক্তি বিষয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে৷ ফলে সৌরবিদ্যুতের দাম দিন দিন কমছে বলে জানান বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি জনপ্রিয় করার অন্যতম ব্যক্তি দীপাল বড়ুয়া৷
ছবি: Fotolia/Marco2811
দাম কমছে
বাংলাদেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান এখন সোলার প্যানেল উৎপাদন করছে৷ এছাড়া সৌরশক্তি বিষয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে৷ ফলে সৌরবিদ্যুতের দাম দিন দিন কমছে বলে জানান ‘বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি এসোসিয়েশন’ বা বিএসআরইএ-র সভাপতি দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
দেশেই তৈরি হচ্ছে
বড়ুয়া বলেন, সোলার প্যানেল সাধারণত চীন থেকে আমদানি করা হয়৷ তবে এখন দেশেও এটা তৈরি হচ্ছে৷ এছাড়া এলইডি অ্যাসেম্বলিং, চার্জ কন্ট্রোলার তৈরির মতো কাজ করতে সমর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ এখন কম খরচে সৌরশক্তি ব্যবহার করতে পারছে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
মাসে ৮০ হাজার
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিমাসে ৮০ হাজার সোলার হোম সিস্টেম বিক্রি হচ্ছে বলে জানান বড়ুয়া৷ ২০১২ সালে এই সংখ্যাটা ছিল অর্ধেক অর্থাৎ ৪০ হাজার৷
ছবি: BGEF
সবার জন্য বিদ্যুৎ
বড়ুয়ার আশা আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি বাড়িতে সৌরশক্তি পৌঁছে যাবে৷ যারা এখনো বিদ্যুৎ বঞ্চিত তাদের ঘরেও বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে৷ কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডকলের আর্থিক সহায়তায় ছোট-বড় প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান এ খাতে কাজ করছে৷
ছবি: BGEF
সোলার হোম সিস্টেম
পাঁচজনের একটা পরিবারের জন্য ৪০-৫০ ওয়াটের সোলার হোম সিস্টেম হলেই চলে বলে জানান বড়ুয়া৷ এই সিস্টেম দিয়ে ঘরে লাইটের ব্যবস্থা করা, টিভি দেখা ও মোবাইল চার্জ করা যায়৷ তবে ফ্যান চালাতে হলে ৮৫ বা ১০০ ওয়াটে যেতে হবে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
খরচ কেমন?
দীপাল বড়ুয়া বলেন, বিশ বছরের জন্য ২০ ওয়াটের একটি প্যানেল নিলে, সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদী ব্যাটারি, তিন বছরের জন্য চার্জ কন্ট্রোলার আর এলইডি লাইট ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য, এমন হলে ১২ হাজার টাকা খরচ হবে৷ তবে ক্রেতাকে টাকাটা একসঙ্গে দিতে হয় না৷ ১০ বা ১৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাকি টাকাটা কিস্তিতে দেয়ার সুযোগ রয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে তিন বছর পর আর কোনো টাকা লাগবে না৷
ছবি: BGEF
বুদ্ধি করে ব্যবহারে লাভ
ব্যাটারির ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের গ্যারান্টি থাকলেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করলে ৬-৭ বছরও চলে যায় বলে জানান বড়ুয়া৷ এরপর ব্যাটারিটা বদলে নতুন ব্যাটারি নেয়ার ক্ষেত্রে ক্রেতাকে আগের ব্যাটারির খরচের এক-তৃতীয়াংশ টাকা ফেরত দেয়া হয়৷ ছবিতে নারীদের সৌরশক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে৷
ছবি: BGEF
গ্রিডে সরবরাহের সুযোগ
জার্মানিতে নিজের ছাদে বসানো সৌর প্যানেল থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের সুযোগ রয়েছে৷ এর ফলে বাড়ির মালিক নিজে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পাশাপাশি বাড়িত বিদ্যুৎ সরকারের কাছে বেচে অর্থ উপার্জন করতে পারে৷ বাংলাদেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা চালুর জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে বিএসআরইএ, জানান দীপাল বড়ুয়া৷