ফ্লাইট কিউজেড৮৫০১-এর ধ্বংসাবশেষ, এমনকি যাত্রীদের লাশ পাওয়া যেতে শুরু করেছে ইন্দোনেশিয়ার কালিমান্তান উপকূলে৷ বিমানবাহিনীর একটি সার্চ প্লেন সাগরের তলায় দুর্ঘটনায় পতিত বিমানটির ‘‘ছায়া’’ দেখেছে৷
বিজ্ঞাপন
কিন্তু কে এই ‘‘এয়ারএশিয়া বেরহাদ''? বিমান পরিবহণ সংস্থাটির মুখ্য কার্যালয় মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে৷ এটা একটা কম খরচের এয়ারলাইন এবং এশিয়ার সবচেয়ে সফল এয়ারলাইনগুলোর মধ্যে পড়ে৷ এয়ারএশিয়া গ্রুপের আটটি অ্যাফিলিয়েট আছে, তাদের মধ্যে থাই, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্স এয়ারএশিয়া, সেই সঙ্গে এয়ারএশিয়া জাপান, ‘জেস্ট' ও এক্স, এই তিনটি৷ এয়ারএশিয়ার উড়াল যায় এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রায় ৮০টি দেশে৷
ফ্লাইট কিউজেড ৮৫০১ চালাচ্ছিল ইন্দোনেশিয়া এয়ারএশিয়া, যার ৪৯ শতাংশ মালিকানা মূল কোম্পানির৷ এটি হবে চলতি বছরে তৃতীয় বিমান দুর্ঘটনা, যা-তে কোনো মালয়েশীয় বিমান পরিবহণ সংস্থা বা তার শাখা কোম্পানি সংশ্লিষ্ট৷ বিশেষ করে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের এমএইচ৩৭০ উড়ালটি গত মার্চ মাস যাবৎ নিখোঁজ৷ কালিমান্তানের কাছে এয়ারএশিয়ার যে বিমানটির খোঁজ চলেছে, সেটি একটি এয়ারবাস এ-৩২০-২০০৷ এমএইচ৩৭০ ছিল একটি বোয়িং ৭৭৭, যা কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাবার পথে উধাও হয়৷ তবে সবচেয়ে ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটে সম্ভবত গত জুলাই মাসে, যখন মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের এমএইচ১৭ উড়ালটি ইউক্রেনের উপর দিয়ে যাবার সময় ভূপাতিত হয়৷ এই বিমানটিতে ছিলেন ২৯৮ জন আরোহী; নিখোঁজ বোয়িংটিতে ২৩৯ জন আরোহী; এবং সদ্য দুর্ঘটনায় পতিত এয়ারবাসটিতে ১৬২ জন আরোহী৷
সূচনা
এয়ারএশিয়া কোম্পানির পত্তন হয় ১৯৯৪ সালে, মালয়েশিয়ার সরকারি মালিকানার কনগ্লোমারেট ডিআরবি-হাইকম এয়ারএশিয়া-র প্রতিষ্ঠাতা৷ ২০০১ সালে মিউজিক ইনডাস্ট্রির প্রাক্তন কর্মকর্তা টোনি ফের্নান্ডেজ কোম্পানিটিকে কেনেন মাত্র এক রিঙ্গিট বা ১৫ সেন্ট মূল্যে, কেননা বাজারে এয়ারএশিয়ার ঋণের পরিমাণ তখন প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ ডলার৷ মালয়েশীয়-ব্রিটিশ শিল্পপতি ফের্নান্ডেজ দশ বছরের মধ্যে কোম্পানিটিকে আবার জিইয়ে তোলেন এই স্লোগান দিয়ে: ‘‘নাও এভরিওয়ান ক্যান ফ্লাই'' – ‘এখন সবাই বিমানে চড়তে পারে'৷
ব্যবসার নীতি
এয়ারএশিয়া-র ব্যবসা করার ধরন অন্যান্য বাজেট এয়ারলাইন্সের মতোই৷ কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুযায়ী তাদের ‘লো-কস্ট ফিলজফি'-র ফোকাস হলো তিনটি মুখ্য স্ট্র্যাটেজির উপর: প্রথমত, ‘হাই এয়ারক্রাফ্ট ইউটিলাইজেশন' বা বিমানগুলিকে যতোদূর সম্ভব আকাশে রাখা, ঘন, ঘন উড়াল, গন্তব্যে পৌঁছানোর পরই আবার প্রত্যাবর্তন৷ দ্বিতীয়ত, ভাড়া কম কিন্তু কোনো বিশেষ সুযোগসুবিধা কিংবা পরিষেবা থাকবে না – যেমন ‘ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার'-দের জন্য এক্সট্রা মাইলেজ থাকবে না; উড়াল চলাকালীন খাবার-দাবার কিংবা পানীয় কিনতে হয়, ফ্রি-তে পাওয়া যায় না৷ তৃতীয়ত, নন-স্টপ ফ্লাইং – অর্থাৎ স্বল্প কিংবা মাঝারি পাল্লার উড়ালে বিমান মাঝপথে কোথাও নামে না৷
লাভের ব্যবসা?
২০১৪ সালের তৃতীয় কোয়ার্টারে এয়ারএশিয়া গ্রুপের প্রাক-কর মুনাফা ছিল ৭৬ লক্ষ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ তার আগের বছরের তুলনায় পাঁচ শতাংশ বেশি৷ মোট আয়ও বেড়েছে তিন শতাংশ৷ কোম্পানির কর্মীসংখ্যা আজ ১৫ হাজার৷ তারা বিশ্বের সবচেয়ে কম খরচের এয়ারলাইন্স বলে এয়ারএশিয়া-র দাবি, প্রত্যেক সিট ও কিলোমিটার প্রতি কোম্পানির খরচ নাকি তিন ডলার ৬৭ সেন্ট৷
ফিরে দেখা: ২০১৪ সালের কয়েকটি বিমান দুর্ঘটনা
রবিবার সকালে এয়ারএশিয়ার কিউজেড৮৫০১ বিমানটি সিঙ্গাপুরের পথে জাভা সাগরের উপরে রাডার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ ২০১৪ সালে এ রকম আরো কয়েকটি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ সেগুলো নিয়েই এ ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Pleul
রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
এয়ারএশিয়ার এয়ারবাসটি ইন্দোনিশেয়ার সুরাবায়া থেকে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল৷ উড্ডয়নের ৪০ মিনিট পর রবিবার ভোরে বিমানটির সঙ্গে এয়ার ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রকদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ আর সেই সময়ের পর থেকে বিমানটির আর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি৷ উদ্ধার অভিযান চলছে৷ বিমানটিতে ১৬২ জন আরোহী রয়েছেন৷
ছবি: Reuters/E. Nuraheni
জাভা সাগরের উপর থেকে হাওয়া
বিমানটি হারিয়ে যাওয়ার আগে বৈমানিক বিরূপ আবহাওয়া এড়াতে বিমানটির গতিপথ পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন বলে শোনা যাচ্ছে৷ বিমানটির দুর্ঘটনা সবাইকে মার্চের এক স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছে৷ সেসময় মালয়েশিয়ার এয়ারলাইন্সের এমএইচ৩৭০ বিমানটি হারিয়ে যায়৷
ছবি: Aditya/AFP/Getty Images
বিপদের ওপর বিপদ
২০১৪ সালে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স তাদের দু’টি বোয়িং ৭৭৭ বিমান হারিয়েছে৷ এর মধ্যে একটি এখনো ‘মিসিং’৷ ৮ মার্চ কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে হারিয়ে যায় সেই বিমানটি৷ রুটিন মাফিক একটি রেডিও ম্যাসেজ দেয়ার পরই বিমানটি রাডার থেকে গায়েব হয়ে যায়৷ এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, রাডার থেকে হারিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর বিমানটি ভারত মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয়৷
এমএইচ৩৭০ হারিয়ে যাওয়ার পর, স্যাটেলাইটে ওঠা বিভিন্ন বস্তুর ছবি বিশ্লেষণ করে বিমানটি খোঁজার চেষ্টা হয়েছে৷ কিন্তু জানা গেছে, ছবিগুলো আসলে সমুদ্র ভেসে থাকা আবর্জনার, বিমানের ধ্বংসাবশেষ নয়৷ জাহাজ এবং ডুবোজাহাজ ব্যবহার করে বিমানটির ফ্লাইট রেকর্ডারের সিগন্যালও খোঁজা হয়েছে৷ কিন্তু সাফল্য আসেনি৷ তাই বিমানের ২৩৯ জন আরোহীর ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা আজও অজানা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিরপরাধ ভুক্তভোগীরা
২০১৪ সালের ১৭ জুলাই মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের অপর একটি বিমান এমএইচ১৭ বিধ্বস্ত হয়৷ ইউক্রেনের উত্তরাংশে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় বিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয় বলে অভিযোগ৷ আমস্টারডাম থেকে কুয়ালালামপুর যাচ্ছিল বিমানটি৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার তৎপরতায় বাধা
বিমানটি দুর্ঘটনার পর মরদেহ উদ্ধার এবং দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কাজ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে৷ প্রথমদিকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে অবস্থানরত বিদ্রোহীরা আন্তর্জাতিক উদ্ধারকারী দল এবং দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞদের দুর্ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দেয়৷
ছবি: Reuters
দায়ী কে?
দুর্ঘটনার পর প্রথম পাঁচদিন বিমানটির ফ্লাইট রেকর্ডার নিজেদের কাছে রেখে দেয় বিদ্রোহীরা৷ এরপর সেটি মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়৷ প্রাথমিক ফলাফলে বিমানটি ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস হয়েছে বলে অনেক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে৷ তবে বিমানটি – বিদ্রোহী, রাশিয়া, না ইউক্রেন – কাদের সোনাদের গোলাতে ভূপাতিত হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি৷
ছবি: Reuters
গতিপথ বদলানোর অনুরোধ
২৪ জুলাই স্প্যানিশ কোম্পানি সুইফটএয়ারের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া এয়ার আলজেরিয়ার একটি বিমান মালিতে ১১৬ যাত্রীসহ বিধ্বস্ত হয়৷ বিমানটি বুর্কিনা ফাসো থেকে আলজিয়ার্স যাচ্ছিল৷ এয়ারএশিয়ার মতো সেই বিমানের পাইলটও গতিপথ বদলাতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: cc-by-sa/Dura-Ace/curimedia
ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়
বিমানটি দৃশ্যত প্রচণ্ড গতিতে ভুমিতে আছড়ে পড়ে৷ বুর্কিনা ফাসোর সীমান্তের কাছে সেটি ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়৷ সম্ভবত ঝড়ের কারণে সেটি বিধ্বস্ত হয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/Sia Kambou
মারাত্মক রণকৌশল
২০১৪ সালের ২৩ জুন জার্মানির সাওয়ারল্যান্ড অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ চলাকালে একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়৷ জার্মান এয়ার ফোর্সের একটি ইউরোফাইটারের সঙ্গে লেয়ারজেটের একটি বিমানের ধাক্কা লাগে বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Bernd Wüstneck
খুব কাছে
ধারণা করা হচ্ছে লেয়ারজেটটি এয়ারফোর্স প্লেনের খুব কাছ থেকে যাচ্ছিল৷ ফলে ধাক্কা লাগে৷ প্রশিক্ষণের জন্য ভাড়া নেয়া বেসামরিক বিমানটি কোলনের একটি গ্রামে ভূপাতিত হয়৷ সেটির পাইলট এবং কো-পাইলট প্রাণ হারান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/BS f. Flugunfalluntersuchung
ক্ষতি সত্ত্বে নিরাপদে অবতরণ
মধ্য আকাশে সংঘর্ষে ইউরোফাইটার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেটি নিরাপদে অবতরণে সক্ষম হয়৷ বিমানটি চালাচ্ছিলেন ৩৩ বছর বয়সি একজন বৈমানিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/BS f. Flugunfalluntersuchung
13 ছবি1 | 13
কী ধরনের প্লেন
কোম্পানির দূরপাল্লার উড়ালগুলি চলে এয়ারএশিয়া এক্স-এর তাঁবে৷ চার ঘণ্টার বেশি সময়ের উড়ালের জন্য এয়ারবাস এ-৩৩০ বিমানগুলি ব্যবহার করা হয়৷ নয়ত এয়ারএশিয়া-র বিমানবহরের অধিকাংশ বিমান হল এয়ারবাস এ-৩২০ জেটলাইনার, যা-তে ১৮০ জন অবধি যাত্রী ধরে৷ এয়ারএশিয়ার বহরে বর্তমানে ১৫০টি এয়ারবাস এ-৩২০ আছে এবং আরো ২০টি ফরমায়েশ করা হয়েছে৷ এয়ারএশিয়া-র বিমানবহর এ অঞ্চলের তরুণতম বহরগুলির মধ্যে গণ্য: বিমানগুলির গড় বয়স তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে৷
সেফটি রেকর্ড
ফ্লাইট কিউজেড ৮৫০১-এর আগে এয়ারএশিয়া ও তার আঞ্চলিক শাখা কোম্পানিগুলির সেফটি রেকর্ড বা নিরাপত্তার খতিয়ান ছিল ভালোই৷ এয়ারএশিয়ার কোনো বিমান এর আগে দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়নি অথবা যাত্রীদের প্রাণহানি ঘটেনি৷ ২০১৩ সালে এয়ারএশিয়া মোট এক কোটি ১৩ লক্ষ যাত্রী পরিবহণ করে৷
ফ্লাইট কিউজেড ৮৫০১-এর জন্য দুই ইঞ্জিনের এয়ারবাস এ-৩২০-২০০ নিয়োগ করা হয়৷ এয়ারএশিয়া বিমানটি এয়ারবাস সংস্থার কাছ থেকে ডেলিভারি পায় ২০০৮ সালে৷ সে'যাবৎ বিমানটি প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার উড়ালে মোট ২৩ হাজার ঘণ্টা আকাশে ছিল৷