এবারের বাজেট প্রস্তাবে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, শুধু প্রকল্প বরাদ্দ দিলেই হবে না, তা বাস্তবায়নের ক্ষমতাও থাকতে হবে৷ তো প্রশ্ন হল, ক্ষমতা কবে হবে?
বিজ্ঞাপন
করোনা মহামারি শুরু হবার পর থেকে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আলোচনার শেষ নেই৷ ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যখাত, কতটা বেহাল দশা তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে এই করোনা -এমন সব কথায় মূল ধারার ও সামাজিক গণমাধ্যম সয়লাব৷ হবেই বা না কেন? পরিচিত-অপরিচিত বহু মানুষকে দেখেছি, করোনায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে যাবেন না ঠিকই করে রেখেছেন৷ অনেকে সর্দি কাশি শ্বাসকষ্টের উপসর্গ থাকার পরও সত্যিই যাননি৷ আবার অনেকে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরেও চিকিৎসার সুযোগ পাননি৷ এমন ঘটনা একের পর এক দেখা যাচ্ছে৷
এখন প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের মানুষের এখানকার স্বাস্থ্যখাতের ওপর আস্থার অভাব কি আজ থেকে? অবশ্যই না৷ এ বিষয়ে তাদের অভাব অভিযোগের সীমা নেই, ছিল না কখনো৷ এই মানুষগুলোই ভারতের মাদ্রাজ বা পুনেতে চিকিৎসার জন্য যান৷ ভারতের ভিসা অফিসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷ অনেকে যান সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, লন্ডন৷ তো যারা সবসময় দেশের বাইরে যান চিকিৎসা নিতে, তারা এবার পড়েছেন বিপাকে৷ করোনার সময় তো আর বাইরে যেতে পারবেন না৷ তাই দেশেই নিতে হবে চিকিৎসা৷ সমাজের এলিট শ্রেণির দু'চারজন অবশ্য চার্টার্ড বিমানে বিদেশ পাড়ি দিয়ে বেঁচেছেন৷ কিন্তু বাকিরা? তাদের চাপ বেড়েছে৷ তো এই চাপ এমনই হয়েছে, তা সামলাতে গিয়ে এই ভঙ্গুর দশা৷ আমার ধারণা, আস্থা ফিরিয়ে আনার এতটা চাপ চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর সম্ভবত এবারই প্রথম পড়েছে৷
ভালোমন্দের স্বাস্থ্যছবি
করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার একটি করুন চিত্র সামনে এসেছে৷ তবে স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ কিছু বিষয়ে সাফল্যও দেখিয়েছে৷
ছবি: DW/H. Ur Radhid
জনবল ও অবকাঠামো সংকট
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, একটি দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে যতজন ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনলজিস্ট, অ্যানেস্থেটিস্ট থাকা আদর্শ সেটি বাংলাদেশে নেই৷ করোনার কারণে সেই সংকট প্রবলভাবে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলছেন, একজন ডাক্তারের বিপরীতে নার্স থাকতে হয় তিন জন৷ কিন্তু বাংলাদেশে আছে আধা জন৷ এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবতো আছেই৷
ছবি: bdnews24.com
দুর্নীতি
দুর্নীতি দমন কমিশনের তৈরি এক প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করা হয়৷ বলা হয়, দুর্নীতি করার জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা পরিচালনার লোক নেই৷ ওইসব যন্ত্রপাতি কখনোই ব্যবহার করা হয় না৷ প্রতিবেদনটি গতবছর জানুয়ারিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে তুলে দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: DW
বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে অক্ষমতা
করোনার কারণে সম্প্রতি পেশ করা বাজেটে গতবছরের চেয়ে এবার স্বাস্থ্যখাতে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এবার প্রস্তাবিত ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা জিডিপির ১.৩ ভাগ৷ গতবছর তা ছিল মাত্র ০.৮৯ ভাগ৷ তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বরাদ্দ যেমন প্রয়োজনের তুলনায় কম তেমনি অতীতে দেখা গেছে, বরাদ্দ বাস্তবায়নের হারও কম৷ ফলে স্বাস্থ্যসেবা পেতে মানুষের ভোগান্তি কমছে না৷
ছবি: bdnews24.com/ M. Zaman Ovi
টিকাদানে সাফল্য
ছয়টি রোগের বিরুদ্ধে লড়তে ১৯৭৯ সালে ‘সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি’ কার্যক্রম শুরু হয়৷ বর্তমানে এটি ১০টি রোগের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়েছে৷ সারা দেশে বিনামূল্যে এসব টিকা দেয়া হয়৷ ২০১৮ সালে সব টিকাপ্রাপ্তির হার ছিল ৯৭.৬ শতাংশ৷ টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতার জন্য গতবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন’৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
শিশুমৃত্যুর হার কমেছে
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক দেশের সবচেয়ে বড় জরিপ ‘বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ’ বা বিডিএইচএস৷ সবশেষ জরিপটি হয়েছে ২০১৭-১৮ সালে৷ এতে বলা হয়, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুহার সেই সময় ছিল প্রতি হাজারে ৪৫ জন৷ এই সংখ্যা ১৯৭৯ সালে ২০২ জন এবং ২০০৬ সালে ৬৫ জন ছিল বলে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’-এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে৷
ছবি: Imago Images/Zuma/M. Hasan
গড় আয়ু বেড়েছে
গতবছর জুনে প্রকাশিত এক জরিপে ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’ বা বিবিএস জানায়, বাংলাদেশের মানুষের মোট গড় আয়ু এখন ৭২ বছর ৩ মাস৷ ১৯৬০ সালে গড় আয়ু ৪৬ বছর ছিল বলে ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
জন্মনিয়ন্ত্রণে সাফল্য
বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে নারীদের সন্তান জন্মদানের হার ১৯৭১ সালে ছয় দশমিক নয় থেকে ২০১৭ সালে দুই দশমিক শূন্য ছয়ে নেমে এসেছে৷ এই হার প্রায় ইউরোপের সমান উল্লেখ করে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ আফ্রিকার জন্য রোল মডেল হতে পারে বলে গতবছর মন্তব্য করেছিলেন জার্মান উন্নয়নমন্ত্রী গ্যার্ড ম্যুলার৷
ছবি: picture-alliance/AP
খরচ বাড়ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ২৮ টাকা এবং বাকি ৭২ টাকা রোগীকে বহন করতে হয়৷ ২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১২-২০৩২ সাল মেয়াদি একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছিল৷ সেখানে ব্যক্তিগত খরচ ৩২ টাকায় (তখন ছিল ৬৪ টাকা) নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ৬৪ থেকে ৩২-এ নামার লক্ষ্য থাকলেও উলটো সেটি বেড়ে ৭২ টাকা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা এখনও নেই
সরকার স্বাস্থ্য বিমা চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে গতবছর ১৯ জুন সংসদকে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এর অংশ হিসেবে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর, ঘাটাইল ও কালিহাতি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্য বিমা কার্যক্রম চলছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: DW
বেশিরভাগ রোগী এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যান না
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০১৯ সালের জুনে৷ এতে দেখা গেছে, ৫৮ শতাংশ রোগী ওষুধের দোকানদার, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, হাকিম-কবিরাজ, ওঝা, পীর, বৈদ্যসহ অন্যদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেন৷ ১৬ শতাংশ যান সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে৷ বাকি ২৬ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নেন৷
ছবি: DW/H. Ur Radhid
10 ছবি1 | 10
তো চাপ দিলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? হবে না৷ কারণ এই পরিস্থিতি তো একদিনে তৈরি হয়নি৷ যুগ যুগ ধরে তৈরি হয়েছে৷ আমরা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারত বা সিঙ্গাপুরের মত নিতে না পেরে আমরাই চিকিৎসার জন্য ভারত-সিঙ্গাপুর গিয়েছি৷ কিন্তু নিজেরা খুব বেশি বদলাইনি৷
যাই হোক, এত সব দেখে ভাবলাম এবার হয়ত হবে৷ কারণ, এবার সমাজের উঁচু শ্রেণির লোকেরাও টের পাচ্ছেন৷ সাধারণ গরীব-মধ্যবিত্তরা সবই মেনে নেয়৷ কিন্তু ধনী বা প্রভাবশালীদের ওপর এলে পরিবর্তন হয়৷ যেমন ধরুন, এই করোনা যদি আফ্রিকা বা এশিয়ার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে এ নিয়ে এত কথা কেই বা বলত? আজ অ্যামেরিকা-ইউরোপকে ধসিয়ে দেয়ায় এত কথা৷ এর আগে এবোলা, নিপাহ, সোয়াইন ফ্লু, সার্স, মার্সসহ কত ভাইরাস এল গেল৷ কই একটু আধটু ‘উহু আহা' ছাড়া আর কেউ কোন কথা বলেছে?
যাই হোক বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে বলছিলাম৷ এত সব দেখে ভাবছিলাম, বাজেটে অন্তত স্বাস্থ্যখাত বদলের একটা রূপরেখা দেখা যাবে৷ কিন্তু কী শুনলাম? সামর্থ্য নেই, তাই বরাদ্দ কম৷ এ কেমন সামর্থ্য, যা কখনো হয় না?
বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয় প্রকল্প দেখে৷ প্রকল্প নেই, তাই বরাদ্দ নেই৷ প্রকল্প আসে মন্ত্রণালয় থেকে৷ মন্ত্রণালয় নিজেদের বাস্তবায়ন সক্ষমতা বিবেচনা করে প্রকল্প দেয়৷ কিন্তু সব প্রকল্প মন্ত্রণালয়কে বা সরকারি সংস্থাকে বাস্তবায়ন করতে হবে, এই দিব্যি কে দিয়েছে? কেন আমরা স্বাস্থ্যখাতের জন্য বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে এমন দেশি-বিদেশি সংস্থাকে জড়াচ্ছি না? শুধু অবকাঠামো তৈরি নয়, পরিচালনাতেও কেন বাংলাদেশে দক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না? আর স্বাস্থ্য মানে কি শুধু ঔষধপত্র, যন্ত্রপাতি? গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়কি? করোনার শুরু থেকেই তো সবচেয়ে দুর্বল মনে হয়েছে ব্যবস্থাপনাকে৷ করোনার মত দুর্যোগ পরিস্থিতি এলে কেমন করে মোকাবিলা করতে হবে? সেটা কে বা কারা ঠিক করবেন? কিংবা সাধারণভাবে হাসপাতালগুলোর সেবার মান নিয়ন্ত্রণ কে করছে? কেমন করে করছে?
বিশ্লেষকরা তো বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা লোকের অভাব৷ অর্থাৎ প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দু'জায়গাতেই লোকের বড় অভাব৷ তাহলে তো লোকের দক্ষতা বাড়ানোর প্রকল্প দরকার৷ সবচেয়ে বেশি দরকার মন্ত্রণালয়গুলোর দক্ষতা উন্নয়ন৷ এই যে বাজেট প্রস্তাবে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ ভাগ, এই ব্যয়ে কি মন্ত্রণালয়গুলো আগামী বছর আরো দক্ষ হয়ে উঠবে? পূর্বের অভিজ্ঞতা কি আমাদের আশাবাদী করে?
বাজেটের আগে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কথা বলেছিলেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷ সেখানে তিনি স্বাস্থ্যখাত প্রসঙ্গে একটি আশার কথা অবশ্য বলেছেন৷ তিনি বললেন, যদি কেউ পরেও প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসেন, এবং তা যদি বিবেচনাযোগ্য হয়, তাহলে তা দ্রুত পাশ ও বাস্তবায়ন করা হবে৷ আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তা কেমন করে সম্ভব? তিনি বললেন, নিয়ম মেনেই সম্ভব৷
সে যাই হোক, যত ক্লিশেই শোনাক কথাটা এটাই সত্য, স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ এটা একদিনে হবে না৷ কিন্তু আমরা সঠিক পথে হাঁটা শুরু করেছি, তা অন্তত দেখতে চাই৷