পশ্চিমবঙ্গে ভোট মানেই সহিংসতা, মৃত্যু, রক্তস্নান। এই কি গণতন্ত্রের চেহারা?
বিজ্ঞাপন
টিভির ক্যামেরায় লাইভ ছবি কি মিথ্যা বলতে পারে? সম্ভবত না। শনিবার সকাল থেকে টিভি-র ক্যামেরায় রাজ্যজুড়ে যে ছবি দেখাচ্ছে, তা হলো, গুলি, বোমা, মৃত্যু, বুথদখল, বুথে তাণ্ডব, ব্যালট পোড়ানো, ব্যালটে জল ঢেলে দেয়া, প্রার্থীর বাড়িতে তালা লাগিয়ে দেয়া! এরপর তৃণমূলের তরফ থেকে বলা হলো, ৬১ হাজার বুথের মধ্যে ৪৬টির মতো বুথে গণ্ডগোল হয়েছে। সেগুলিই বড় করে দেখানো হয়েছে। বাকি সব বুথে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে।
তর্কের খাতিরে না হয় মেনেই নিলাম, ৪৬টি বুথেই গোলমাল হয়েছে। কী গোলমাল হয়েছে? আমরা দেখেছি, পিস্তল হাতে এক কর্মী টিভি ক্যামেরার সামনে এক নির্দল প্রার্থীকে লক্ষ্য করে গুলি করছেন। ক্যামেরার সামনেই বুথে ঢুকে ভাঙচুর করা হচ্ছে। প্রিসাইডিং অফিসারকে মারা হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে প্রিসাইডিং অফিসার বাথরুমে লুকিয়ে থাকছেন, ভোট দিতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ যাচ্ছে। ব্যালট পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বোমার বৃষ্টি হচ্ছে। গুলি চলছে। সহকর্মী স্যমন্তক ঘোষ গুলি লেগেছে এমন একজনের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে কথা বলেছেন। এ কোন গণতন্ত্রের উৎসবের ছবি দেখলাম আমরা?
রাজ্যজুড়েই সহিংসতা হয়েছে। অভিযোগের আঙুল তৃণমূলের দিকে। ভাঙড়, চোপড়া, বাঁকুড়া-সহ রজ্যের বহু জায়গায় রক্ত ঝড়েছে মনোনয়নপর্বে। অভিযোগ, বিভিন্ন জায়গায় মনোননপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি বিরোধী প্রার্থীদের। বিজেপি-র এই প্রার্থী সহিংসতার শিকার। বাঁশ, রড দিয়ে মারা হয়েছে তাকে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আহত মানুষেরা
আরেকজন আহত মানুষ। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়ন ঘিরে এতটাই সংঘর্ষ হয়েছে যে, প্রচুর মানুষ আহত। ভাঙড়ে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা ও গুলি চলেছে। চোপড়ায় সিপিএমের মিছিলের উপর লাঠি, রড, বন্দুক নিয়ে আক্রমণ করা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দীনেশ মণ্ডলের দাবি
দীনেশ মণ্ডল জানিয়েছেন, তার স্ত্রী সোনামণি মণ্ডল মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেছিলেন। সেখানেই ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাদের আক্রমণ করে। তার বুকে একের পর এক ঘুষি মারা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
উত্তম বাগ মার খেয়েছেন
উত্তম বাগের স্ত্রী ঝুমা বাগ বিজেপি-র হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। মনোনয়নপত্র পেশ করতে যেতেই শুরু হয় ব্যাপক মার। রীতিমতো আহত উত্তম। রাজ্যের ৫০ শতাংশ পঞ্চায়েত আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। তাই প্রার্থীর সঙ্গে তার স্বামী বা পরিবারের সদস্যরাও মনোনয়ন পেশের সময় যান।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মার অতীন্দ্র হালদারকে
অতীন্দ্র হালদার ডায়মন্ড হারবার দুই নম্বর ব্লকের প্রার্থী ছিলেন। তাকে বিডিও অফিসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বেধড়ক মারা হয়েছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিমান বসুর নেতৃত্বে
চোপড়ায় সিপিএম ও কংগ্রেস প্রার্থীরা মিছিল করে মনোনয়নপত্র দিতে যাচ্ছিলেন। সেসময় তাদের মিছিলে হামলা হয়। একজন মাথায় গুলি লেগে মারা যান। গুরুতর আহত দুইজন। এরপর বিমান বসুর নেতৃত্বে সিপিএম ও কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অফিসে যান। নির্বাচন কমিশনারকে স্মারকলিপি দেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের সঙ্গে বিরোধ
নেতারা ভিতরে গিয়েছিলেন স্মারকলিপি জমা দিতে। বাইরে রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা। পুলিশ তাদের সরাতে যায়। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। কর্মীরা সেই ব্যারিকেড ফেলে দিয়ে এগোতে চায়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি
সিপিএমের এই নারী কর্মী পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি জুড়ে দেন। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, চোপড়ায় গুলিতে আমাদের সহকর্মীরা মারা যাচ্ছেন, ভাঙড়ে সহযোগী দলের কর্মীরা মারা যাচ্ছেন। আপনারা কোথায় ছিলেন?
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাস্তায় বসে প্রতিবাদ
সিপিএমের এই বয়স্ক মানুষটি রাস্তায় বসে পতাকা হাতে নিয়ে প্রতিবাদ দেখালেন। দলের সহকর্মীদের সুরক্ষার জন্য। সহিংসতা বন্ধের দাবিতে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আইএসএফ নেতার দাবি
ভাঙড়ে মনোনয়ন জমা দেয়া নিয়ে তৃণমূল ও আইএসএফের মধ্যে ব্যাপক গোলমাল হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশি নিরাপত্তায় শেষ পর্যন্ত আইএসএফ প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। আইএসএফ নেতা নওসাদ সিদ্দিকি এসেছিলেন নির্বাচন কমিশনে, গ্রামবাসী ও কর্মীদের নিরাপত্তার দাবি নিয়ে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজেপি নারী মোর্চার প্রতিবাদ
পঞ্চায়েত নির্বাচনে সহিংসতার প্রতিবাদে বিজেপি নারী মোর্চার সদস্যরা রাস্তায় বসে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদে কংগ্রেসও
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে কংগ্রেস কর্মীরাও প্রতিবাদ জানান। চোপড়া, ভাঙড়, মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস কর্মীরাও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, একজন মারা গেছেন বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দাঙ্গাবিরোধী পুলিশ
বিরোধীদের প্রতিবাদ সামলাতে নামানো হয়েছিল দাঙ্গাবিরোধী পুলিশও। অথচ, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যখন সহিংসতা হয়েছে, তখন উপযুক্ত সংখ্য়ায় পুলিশ ছিল না বা থাকলেও তারা নীরব দর্শক ছিল বলে অভিযোগ বিরোধী দলগুলির।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
13 ছবি1 | 13
এই ছবি ৪৬টা বুথ কেন, চারটে বুথে হলেও তা ভয়াবহ ঘটনা। দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা করার সূত্রে বলতে পারি, এখন তো অন্য কোনো রাজ্যে এই ছবি দেখতে পাওয়া যায় না। প্রথমে প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেয়া হলো, তারপর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য সহিংসতা হলো, আর ভোটের দিন রক্তগঙ্গা বইলো। প্রশাসন চুপ। নির্বচন কমিশনার বললেন, তিনি আশা করছেন, পুলিশ সব ঠিক করে দেবে। আর পুলিশ? থাক সে কথা।
এই ভয়ংকর সহিংসতার স্রোত দেখে ভয় লাগে। লজ্জা হয়। ভেটের নামে যা হলো, তাতে ভবিষ্যৎ ভেবে হতাশ লাগে।
সকাল থেকে বেলা তিনটে পর্যন্ত ১২ জনের প্রাণ গেছে। তারমধ্যে তৃণমূলের একাধিক কর্মী আছেন। বিরোধী দলগুলির আছে। কেন এই প্রাণহানি হবে? প্রতিটি মৃত্যু শোকের। প্রতিটি হত্যা সমান নিন্দনীয়। আর ততটাই নিন্দনীয় এই বেলাগাম সহিংসতা। সারাদিন ধরে এই কাণ্ডকারখানা দেখে প্রশ্ন জেগেছে, প্রশাসন কোথায়?
এই সন্ত্রাস, এই সহিংসতা কোথায় গিয়ে শেষ হবে? গ্রাম প়ঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদে জেতা কি এতটাই জরুরি যে এত প্রাণ চলে যেতে হবে? এ কোন যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলা?
তারপর এই পশ্চিমবঙ্গের নেতারা ভারতের অন্যত্র গণতন্ত্র বিপন্ন বলে আওয়াজ তুলবেন। মানুষের ভোটে জিততে না পারলে বন্দুক, বোমা, বুথদখল করে জিততে হবে? গণতন্ত্রের কোন পাঠে একথা বলা হয়েছে। জেতার পর তারা কী করবেন?
এবার ওই ৪৬টি বুথে সহিংসতার প্রসঙ্গে আসি। কতগুলি বুথে সহিংসতা হয়েছে, গোলমাল হয়েছে, তার সংখ্যা আমরা জানি না। কারণ, টিভি-র ক্যামেরা তো সীমাবদ্ধ। তা তো আর ৬১ হাজার বুথে থাকতে পারে না। সবমিলিয়ে কটা টিভি ক্যামেরা ছিল? দুইশ, তিনশ, চারশ--তার বেশি তো নয়। তাহলে অন্য জায়গায় কী হয়েছে, তার ছবি তো আমরা জানতেই পারব না। আর সাধারণ মানুষ যারা সেই গণ্ডগোলের ছবি মোবাইল-বন্দি করেছেন, তারা তা আপলোড করতে ভয় পাবেন। কারণ, এরপর তাদের উপর হামলা হলে কে তাদের বাঁচাবে?
আর যে ছবিগুলো ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, তার দায় কে নেবে? পুলিশ, প্রশাসন, কমিশন, রাজনৈতিক দল? না, আমাদের দেশে দায় নেয়ার কোনো দায় কারো নেই। ফলে যাই হোক না কেন, কারো কিছু যায়-আসে না। শুধু আসে যায় সেই পরিবারগুলির, যারা তাদের সদস্যকে হারালো। আর বাকিরা কিছুদিনের মধ্যেই সব ভুলে যাবেন। ব্যস্ত থাকবেন মেলায়, খেলায়।