এমন পুজো যেন আর কখনো দেখতে না হয়। এ বড় মন খারাপের পুজো।
বিজ্ঞাপন
দুর্গাপুজো শুরুর দিন তিনেক আগে আতহার ফোন করে যারপরনাই গালিগালাজ করলো। বছরের এই একটা সময় কলকাতায় না ফিরলে বন্ধুরা অসম্ভব রেগে যায়। কারণ, এটাই আড্ডা মারার সেরা সময়। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে বন্ধুরা এসে জড়ো হয় পাড়ার আড্ডায়। রাত নেই, দিন নেই-- অনর্গল আড্ডা। আতহার সেই আড্ডার অন্যতম আয়োজক। সেই স্কুল জীবন থেকে। ফলে গালিও ওর কাছেই পাওনা ছিল! নবমীর সকালে শেষ কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। মন খারাপের ফোন। ''শেষে দুর্গোৎসবেও হিন্দু-মুসলিম আলোচনা করতে হবে ভাই?'' ফেসবুকে কিছু আধা পরিচিত অর্বাচীন ওকে লিখেছে, 'বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা নিশ্চয় সমর্থন করেন? একটা লাইনও তো লিখতে দেখলাম না সমাজমাধ্যমে?'
কথাটা আতহারকেই শুনতে হয়েছে। ওর নামের কারণে। আমায় শুনতে হয়নি। অর্বাচীনের দল জানেই না, দুর্গাপুজোর সঙ্গে আতহারের যে সম্পর্ক, আমার সঙ্গে ঈদের তাই।
ভারত-বাংলা সীমান্তে 'ভাগের মা' থেকে জুতোর প্যান্ডেল, কলকাতার সেরা ও বিতর্কিত পুজো
কলকাতার অসংখ্য পুজোর মধ্যে থেকে সেরা কিছু পুজোর ছবি থাকছে এখানে। থাকছে কিছু বিতর্কিত পুজোর কথাও।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ভারত-বাংলা সীমান্তে 'ভাগের মা'
দক্ষিণ কলকাতার বড়িশা স্পোর্টিং ক্লাবের পুজোয় উঠে এসেছে এক অভিনব থিম। ক্লাবের কর্মকর্তারা থিমের নাম দিয়েছেন 'ভাগের মা'। ভারত ও বাংলাদেশের দুই সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার মাঝে নো ম্যানস ল্যান্ডে দুর্গা। এনআরসি, উদ্বাস্তু, ডিটেনশন সেন্টার সবকিছুই ঢুকে গিয়েছে এই থিমে। সেকারণেই এই পুজোর থিম সাম্প্রতিক ও অভিনব।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিতর্কের কেন্দ্রে জুতোর প্যান্ডেল
দমদম পার্কের ভারতচক্রের পুজো। থিম হলো কৃষক আন্দোলন। সেটা করতে গিয়ে মণ্ডপের একাংশে জুতো, চটি লাগানো হয়েছিল। তা নিয়েই প্রবল বিতর্ক। ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত লাগার কারণে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন এক আইনজীবী। উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, কৃষক আন্দোলনের বিষয়টি বোঝাতেই এটা করা হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ভিতরের ছবি
জুতোর মণ্ডপের ভিতরের ছবি। এই অংশ নিয়ে অবশ্য কোনো বিতর্ক নেই। খুবই শিল্পসম্মতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে মণ্ডপের এই অংশ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কলকাতার বুর্জ খলিফা
প্রায় ২৫০ জন কর্মী দুই মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে কলকাতার শ্রীভূমিতে তৈরি করেছেন বুর্জ খলিফা পুজোমণ্ডপ। ১৪৫ ফুট উঁচু। আয়নার ব্যবহার করা হয়েছে। দুবাইয়ের নজরকাড়া ভবনের অনুকরণে কলকাতায় এই পুজো প্যান্ডেল দেখতে ভিড় হয়েছে মারাত্মক। রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসুর শ্রীভূমির পুজো প্রতিবারই নতুন নতুন চমক দেয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিতর্কে বন্ধ লেজার শো, প্রবেশও বন্ধ
সন্ধ্যা নামতেই বুর্জ খলিফাতে শুরু হতো দৃষ্টিনন্দন লেজার শো। কিন্তু দমদম বিমানবন্দরের কাছে এই মণ্ডপের লেজার শো-র ফলে পাইলটদের বিমান রানওয়েতে নামাতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই লেজার শো বন্ধ করে দেয়া হয়। তা সত্ত্বেও প্রতিদিন প্রচণ্ড ভিড় হচ্ছিল। একে করোনা, তার উপর বিমানবন্দরের রাস্তা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়, তাই এখানে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রতিমা দর্শন। কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তির দেবী
নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজো। থিম দেশভাগ। দেবী এখানে শান্তির প্রতীক। তাই হাতে কোনো অস্ত্র নেই। সেরা পুজোর পুরস্কার পেয়েছে তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
চেতলা অগ্রণী
কলকাতার আরেকটি সেরা পুজো চেতলা অগ্রণী। অপূর্ব দুর্গাপ্রতিমা মানুষকে টেনে এনেছে অগ্রণীর মণ্ডপে।
একটি সংস্থার বিচারে কলকাতার সেরা প্রতিমা ঠাকুরপুকুর স্টেট ব্যাঙ্ক পার্কের এই প্রতিমা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কুমারটুলি পার্কের পুজো
কলকাতার সেরা পুজোর তালিকায় স্থান পেয়েছে কুমারটুলি পার্কের এই পুজোও।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শারদ সম্মান পাওয়া পুজো
জগৎ মুখার্জি পার্কের এই পুজোও শারদ সম্মান পেয়েছে। অন্যরকম মণ্ডপ ও দৃষ্টিনন্দন প্রতিমার জন্য।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অন্যরকম প্রতিমা
টালা প্রত্যয়ের এই পুজোও পুরস্কার পেয়েছে। একেবারে অন্যরকম প্রতিমা। এখানেও দেবীর হাতে কোনো অস্ত্র নেই। ধ্যানমগ্ন দুর্গা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
একডালিয়া এভারগ্রিন
রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত সুখোপাধ্যায়ের পুজো। একডালিয়া এভারগ্রিন এখনো থিম পুজোয় নাম লেখায়নি। কিন্তু এই পুজোর আকর্ষণও কম নয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঐতিহ্যের পুজো
বাগবাজার সর্বজনীনও থিমের পুজোয় নেই। তারা ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। কলকাতার অন্যতম পুরনো এই বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা দেখতে মানুষ বহু দূর থেকে আসেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
14 ছবি1 | 14
এবারে মহালয়ার দিনটা গুলিয়ে গেছিল। সুদূর দিল্লিতে কার-ই বা মনে থাকে মহালয়া? ভোরবেলা মহালয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল এশা ইউসুফ। আমার ঢাকার বন্ধু। ফেসবুকে ঢাকার দুর্গাপ্রতিমার ছবি দিয়ে লিখেছিল, 'মা'। ওইদিন সকালে দুর্গাপুজোর ফূর্তি নিয়ে লম্বা আড্ডা হয়েছিল ওর সঙ্গে। জানালো, পুজো উপলক্ষে কলকাতায় এসেছে। নবমী সকালে ওর ফেসবুক প্রোফাইল জানান দিল-- 'মন ভালো নেই'।
মন ভালো নেই আমারও। দিল্লি দাঙ্গার পর জ্বলে যাওয়া মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক যতটা কান্না পেয়েছিল, নবমী সকালে কুমিল্লার ছবি দেখে ঠিক ততটাই মন খারাপ হয়েছে। মন খারাপ হয়েছে, কেবল দুইটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য নয়। এই ঘটনা যে ইতিহাসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের, সে কথা ভেবে। ফেসবুকে আতহারের ট্রোলড হওয়া থেকে সেই ইতিহাসের শুরু। পুলিশি পাহারায় পুজো হওয়া সেই ইতিহাসের চারণভূমি। একসঙ্গে একই আবহাওয়ায় বড় হওয়া বন্ধুদের মধ্যে 'হিন্দু-মুসলিম' আলোচনা ও কূটতর্ক সেই ইতিহাসের ভবিতব্য।
ছোটবেলায় দুর্গাপুজো আমাদের কাছে কেবল একটি পুজো ছিল না। পুজোর আছিলায় গড়ে ওঠা এক সাংস্কৃতিক আবাদভূমি ছিল। পাড়ার স্টেজে নাটক হবে বলে ছেলে-মেয়েরা একমাস ধরে মহড়া দিত। মাঠে মাঠে ছেলে ছোকড়ার দল সদ্য কেনা গিটারে সুর ধরতো আয়ুব বাচ্চু কিংবা সুমনের। 'নাম নেব মহম্মদের' সুর তুলে পাড়ার সান্ধ্য অনুষ্ঠানে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল বন্ধু রাজা। দুর্গাপুজোয় কেন 'মহম্মদে'র নাম এলো, এ প্রশ্ন কেউ কখনো তোলেননি। ইদানীং তোলেন। মধ্য কলকাতায় পুজো প্যান্ডেলে তাজমহল দেখেছি আমরা। থিম-টিমের তখনো কোনো বালাই ছিল না। পুজো ছিল এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন।
কলকাতার বনেদিবাড়ির পুজো, ঐতিহ্য ও ইতিহাস যেখানে মেশে
কোনো পুজোর বয়স চারশ বছর, কোনোটা তিনশ বা আড়াইশ। কলকাতার বনেদিবাড়ির পুজোর আকর্ষণই অন্যরকম।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো
বনেদিবাড়ির পুজোর মধ্যে উত্তর কলকাতার রাজা নবকৃষ্ণ দেবের শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো খুবই বিখ্যাত। ফেলে আসা সময়ের অনেক ঘটনার সাক্ষী এই পুজো।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সকলের জন্য দরজা খোলা
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পরেই প্রথমবার দুর্গাপুজো হয় শোভাবাজার রাজবাড়িতে। রাজা নবকৃষ্ণ দেব সেবার পুজোয় লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়ারেন হেস্টিংসকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো এখন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এ শহরের অন্যান্য বিখ্যাত পুজোগুলোর মত লম্বা লাইন এবং ভিড় এই পুজো দেখতেও।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শোভাবাজারের ঐতিহ্যবাহী প্রতিমা
একচালা প্রতিমা। ডাকের সাজ। সিংহ ও অসুর অন্য পুজোর থেকে আলাদা। দেবীর টানা চোখ। এই মূর্তিই হয়ে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো
কলকাতার পারিবারিক পুজোর ইতিহাসে সব চেয়ে পুরনো পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো। এই পরিবারের কাছ থেকেই তিনটি গ্রাম কিনেছিলেন জোব চার্নক। দক্ষিণ কলকাতার বেহালায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। সবকটিতেই দুর্গাপূজা হয়। আটচালা দুর্গা সেগুলোর অন্যতম। সাবর্ণ পরিবারের আটচালা পুজো আজ থেকে চারশ এগারো বছর আগে শুরু করেন লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মেজবাড়ির পুজো
আটচালা পুজোর পাশেই মেজবাড়ির পুজো। কয়েক শতক পুরনো এই পুজোয় পরিবারের লোকজন ছাড়া বাকিদের প্রবেশ নিষেধ। করোনাকালে এমন নিষেধাজ্ঞা কলকাতার বহু বনেদিবাড়িতেই বহাল আছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পশুবলি বন্ধ, এখন প্রতীকী বলি
পশুবলি বন্ধ অনেকদিন। তবে বনেদিবাড়ির পুজোগুলোয় পশুবলির রেওয়াজ বহুকাল ধরেই চলে আসছে। নিয়ম মানতে তাই প্রতীকী বলি। সাবর্ণ পরিবারের বড়বাড়িতে পাঁঠার পরিবর্তে একটি চালকুমড়ো এবং মোষের পরিবর্তে পাঁচটি আঁখ একসঙ্গে বলি দেওয়া হয় এখন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
রানি রাসমণির বাড়িতেও
হাড়িকাঠ চোখে পড়বে রানি রাসমণির বাড়ির পুজোতেও। এখানেও একসময় নিয়মিত পশুবলি হতো। এখন বন্ধ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
রানি রাসমণির পুজো এখনো চলছে
এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা রানি রাসমণি স্বয়ং। ১৮৬১তে তার মৃত্যুর পরেও পরিবারের সদস্যরা মধ্য কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডের এই বাড়িতে পুজো চালিয়ে আসছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পটলডাঙার বসুমল্লিকদের পুজো
পটলডাঙাকে অমর করে দিয়েছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তার টেনিদা, প্যালারামরা পটলডাঙার ছেলে। পটলডাঙার আরেক আকর্ষণ বসুমল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজো। দুইশ বছরের পুরনো। শুরু করেছিলেন রাধানাথ মল্লিক।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বসুমল্লিকদের দুইটি পুজো
১৮ এবং ২২ রাধানাথ মল্লিক লেনের দুটি বাড়িই বসুমল্লিক পরিবারের। দুটিতেই শতাব্দীপ্রাচীন দুর্গাপুজো চলে আসছে। বসুমল্লিকদের প্রথম পুজো চালু হয় ১৮ নম্বর রাধানাথ মল্লিক লেনের বাড়িতেই। এটা দ্বিতীয় বাড়ি। এখানে পরবর্তীকালে পূজা চালু হয়। উপরের ছবিতে দ্বিতীয় বাড়ির পুজো।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হরিনাথ মুখোপাধ্যায়ের পুজো
পরিবারের সদস্যদের হিসেব অনুযায়ী প্রায় তিনশ বছরের পুরনো এই পুজো। উত্তর কলকাতার রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের পিছনে এই বাড়িটিতে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন হরিনাথ মুখোপাধ্যায়।
উত্তর কলকাতার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের এই বাড়ির দুর্গাপুজো দুইশ চল্লিশ বছরের পুরনো। চন্দননগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী বৈষ্ণবদাস মল্লিক এই পুজোর সূচনা করেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অন্যরকম প্রতিমা
বৈকুন্ঠনাথ মল্লিকের বাড়ির পুজোয় লক্ষ্মী এবং সরস্বতী আকারে কার্তিক-গণেশের থেকে বড়। এমনকী হর-গৌরীর থেকেও। এটাই এই পরিবারের পুজোর রীতি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নীলমণি সেনের পুজো
যশোরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী নীলমণি সেন কলকাতায় আসেন ১৯ শতকে। ১৯১৩ সালে ফুলের কারুকাজ করা ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজো শুরু করেন। তবে সে আড়ম্বর আজ আর নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ সবই বর্ণহীন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দুই হাতের দুর্গা
বিগত বছরগুলোর তুলনায় মূর্তির আকার আজ একটু ছোটো। রীতি মেনে সেনবাড়ির দুর্গার হাত দশটি নয়, দুটি। দুর্গামায়ের অভয়মূর্তি এ’বাড়িতে একশ বছর ধরে পূজিত হয়ে আসছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
16 ছবি1 | 16
আমি থিমের বিরোধী নই। কলকাতার পুজো এখন এক মস্ত বড় ইন্ডাস্ট্রি। শিল্পক্ষেত্রও বটে। কুমোরটুলির শিল্পী থেকে আর্ট কলেজের ছাত্র-- কলকাতার থিম পুজো এখন বহু মানুষের সারা বছরের রুটিরুজি। গত বছর ঢাক বাজানোর বায়না না পেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন যে ঢাকি, আমি তার প্রতি সহানুভূতিশীল। ঠাকুর বিক্রি না হওয়ায় কুমোরটুলির যে শিল্পী বিপুল দেনার দায়ে জর্জরিত, আমি তার প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু থিম নামক জৌলুস যখন গোটা সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নেয়, তখন মন খারাপ হয়। মন খারাপ হয়, যখন দেখি থিম বিক্রি করতে গিয়ে করোনাবিধি শিকেয় তুলে দিয়েছেন স্বয়ং রাজ্যের এক মন্ত্রী। মন খারাপ হয়, যখন দেখি কলকাতার বাঙালি থিমের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে সমাজ মাধ্যমে 'বিলো দ্য বেল্ট' আক্রমণ শানাতে থাকে। মুঘল স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরি প্যান্ডেলে কেন হিন্দু দেবীর বোধন হবে, এ প্রশ্নও উঠছে আজকাল। নাহ, এ পুজো আমি চাই না। পুজোর নামে সংকীর্ণ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা আমি চাই না। নেতাদের নামে পুজোর ব্যানার দেখতে চাই না মোটেই। চাই না, দুর্গাপ্রতিমার আদলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মূর্তি তৈরি হোক। কিংবা আলোকসজ্জা। এই সংস্কৃতি বাংলার সংস্কৃতি নয়। চাই না, পুজোয় সরকারি ডোলের এই অপসংস্কৃতি দেখতে। এও এক সংকীর্ণ রাজনীতির উদাহরণ।
আবার বলছি, আমি থিম বিরোধী নই। এ কথা অনস্বীকার্য, দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল কলকাতার শিল্পবোধকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। পুজোর কয়েকটা দিন সত্যি সত্যিই মনে হয়, গোটা কলকাতা জুড়ে হাজার হাজার লাইভ ইনস্টলেশন তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো কাজ বিশ্বমানের। জাদুঘরে রেখে দেওয়ার মতো। শিল্পীর চোখে সাধারণ পুজো এক অনন্য সাধারণ মাত্রায় পৌঁছে যায়। পুজো কেবল আর পুজো থাকে না, উৎকৃষ্ট উৎসবে পরিণত হয়। আবার একথাও ঠিক, ওই বিপুল রোশনাইয়ের পাশে যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের মুখগুলো ভেসে ওঠে, কষ্ট হয়। মনে হয়, সরকারি ডোলের টাকা তাদের পাওয়ার কথা ছিল, পুজোর নয়। মুখ্যমন্ত্রীর তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল, পুজোর নয়।
বছরের এই সময়টায় আরো অনেক বাঙালির মতো, আমারও মন ভালো থাকে। আনন্দ করতে ইচ্ছে হয় সর্বক্ষণ। সম্ভবত এই প্রথম পুজোর মরসুমে মন ভালো নেই। পুজো ঘিরে যে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলো তৈরি হলো, তা বড়ই বেদনাদায়ক। এই ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলো আতহার বা এশার জীবনে যে প্রতিঘাত নিয়ে পৌঁছালো, তা আরো বেশি মন খারাপের। এর দায় আমাদের সকলের।