উত্তর প্রদেশের পর এ বার হরিয়ানার গুড়গাঁওতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। অন্যদিকে হাথরাসের ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে, ধর্ষণই হয়নি।
বিজ্ঞাপন
উত্তর প্রদেশের পর এ বার হরিয়ানা। দিল্লি ঘেঁষা গুড়গাঁওতে ২৫ বছরের তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হলো। এখানেও চার অভিযুক্ত ধর্ষণের পর ওই নারী উপর প্রবল অত্যাচার চালায়। তাঁর মাথায় একাধিক আঘাত লেগেছে। রোববার ভোররাতের ঘটনায় চার অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। সকলেরই বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে।
এক অভিযুক্তের সঙ্গে ওই নারীর সিকান্দারপুর মেট্রো স্টেশনে দেখা হয়। সে তাঁকে কাছেই একটি অফিসঘরে নিয়ে যায়। সেখানে আরো তিনজন ছিল। তরুণী বাধা দিলে তাঁর মাথা দেওয়ালে জোরে ঠুকে দেয়া হয়। ধর্ষণ করে চারজন পালায়। মেয়েটির কান্না শুনে সিকিউরিটি গার্ড এসে তাঁকে উদ্ধার করে।
হাথরাসের ফরেনসিক রিপোর্ট
অন্যদিকে হাথরাসের ঘটনার ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, দলিত মেয়েটিকে ধর্ষণই করা হয়নি। ঘটনা হলো, ধর্ষিতার দেহ থেকে ১১ দিন পরে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ততদিনে স্পার্মের আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। ফলে এই রিপোর্টকে তাঁরা বিশেষ মূল্য দিচ্ছেন না।
ভারতে প্রতি ১৬ মিনিটে একটা ধর্ষণ
রিপোর্ট প্রকাশ করলো ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বা এনসিআরবি। এই সরকারি সংস্থা ভারতজুড়ে সব অপরাধের হিসেব রাখে। সেই রিপোর্ট থেকে উঠে এসেছে ভারতে ধর্ষণ ও অপরাধের ভয়াবহ ছবি।
ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৮৭টা ধর্ষণ হয়। ২০১৯ সালের হিসাব এটা। এনসিআরবি রিপোর্ট অনুসারে বছরভর মোট ৩২ হাজার ৩৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Hatvalne
নারী-নির্যাতন বেড়েছে
দেশজুড়ে মোট চার লাখ পাঁচ হাজার ৮৬১ জন নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতিতা হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যাটা ছিল তিন লাখ ৭৮ হাজার ২৩৬ জন। এই হিসাবই বলে দিচ্ছে, ভারতে নারী-নির্যাতন বেড়েছে।
ছবি: Reuters/A. Fadnavis
একে রাজস্থান, দুই নম্বরে উত্তর প্রদেশ
ধর্ষণের সংখ্যার নিরিখে ভারতে এক নম্বর রাজ্য হলো রাজস্থান। সেখানে ২০১৯-এ পাঁচ হাজার ৯৯৭ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশে ধর্ষিতা হয়েছেন তিন হাজার ৬৫ জন। তিন নম্বরে মধ্যপ্রদেশ। সেখানে দুই হাজার ৪৮৫ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তবে মেয়েদের শ্লীলতাহানির চেষ্টায় এক নম্বরে উত্তর প্রদেশ।
ছবি: Reuters/Sivaram V
দিল্লিতে প্রতিদিন তিন জনকে ধর্ষণ
রাজধানী দিল্লির অবস্থাও শোচনীয়। এখানে প্রতিদিন তিনজন মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। ২০১৯-এ দুই হাজার ৩৫৫ জন নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। যৌন নিগ্রহের শিকার ৪৫৬ জন নারী। পরিবারের সদস্যদের হাতে ধর্ষিতা হয়েছেন ১২৫ জন নারী। ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে আটজনকে। আর বিয়েতে পন সংক্রান্ত বিবাদের জেরে মারা হয়েছে ১১৬ জন নারীকে। সব মিলিয়ে দিল্লিতে ২০১৮-র তুলনায় অপরাধ বেড়েছে ২০ শতাংশ।
ছবি: Reuters/
ধর্ষণের পর হত্যা
ভারতে মোট ২৭৮ জন মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে ২০১৯-এ। মহারাষ্ট্রে সব চেয়ে বেশি এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মোট ৪৭ জন নারীকে হত্যার পর খুন করা হয়েছে মহারাষ্ট্রে। তার পরে আছে মধ্যপ্রদেশ, সেখানে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ৩৭টি এবং উত্তর প্রদেশে ৩৪টি।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
দলিত নারীদের নির্যাতনে একে উত্তর প্রদেশ
দলিত নারীদের ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ, শ্লীলতাহানি, অত্যাচারের ঘটনায় এক নম্বরে যোগী আদিত্যনাথের উত্তর প্রদেশ। সেখানে ২০১৯-এ ১১ হাজার ৮২৯ জন দলিত নারী নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হয়েছেন। আদিবাসী মেয়েদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ক্ষেত্রে অবশ্য এক নম্বরে মধ্য প্রদেশ। ২০১৮-র তুলনায় দলিত নারীদের উপর অত্যাচার বেড়েছে সাত শতাংশ ও আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ।
ছবি: Sam Panthaky/AFP/Getty Images
দলিত মেয়েদের ধর্ষণ করে খুন
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ও অক্টোবরের গোড়ায় তিনজন দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে উত্তর প্রদেশে। হাথরাসে পরিবারের সঙ্গে মাঠে ঘাস কাটতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার দলিত তরুণীর মৃত্যু হয় প্রায় দুই সপ্তাহ পর। বলরামপুরে কলেজে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন দলিত ছাত্রী। তাঁকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে অত্যাচার চালানো হয়। মেয়েটির মৃত্যু হয়। ভাদোইতে ১১ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে মাথায় পাথর দিয়ে মারা হয়।
ছবি: Francis Mascarenhas/Reuters
অধিকাংশ ধর্ষক চেনা লোক
এনসিআরবি তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে ৯৪ শতাংশ নারীকে চেনাজানা লোকের হাতে ধর্ষিতা হতে হয়েছিল। তারা কেউ পরিবারের সদস্য, বন্ধু, প্রতিবেশী, চাকরিক্ষেত্রে বস, মালিক, সহকর্মী বা সামাজিক মাধ্যম সূত্রে চেনা।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Maqbool
প্রতিবাদে বাধা
হাথরাসের ধর্ষণের প্রতিক্রিয়া সারা দেশে পড়েছে। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ, উত্তর প্রদেশে প্রতিবাদ করতে দেয়া হচ্ছে না। হাথরাসে কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। সমাজবাদী পার্টির কর্মীদের আটকে দেয়া হয়েছিল হাথরাসে। রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা গান্ধীকে যেতে দেয়া হয়নি। দিল্লি-ঘেঁষা নয়ডাতে তাঁদের আটকে দেয়া হয়।
ছবি: Anushree Fadnavis/Reuters
এনসিআরবি
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো তৈরি হয় ১৯৮৬ সালে। তবে ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জেলাস্তরে ক্রাইম অ্যান্ড ক্রিমিনাল ইনফরমেশন ব্যবস্থা তৈরি হয়। তারা বছরে তিনটি রিপোর্ট তৈরি করে। অপরাধ চিত্র, আত্মহত্যা ও দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং কারাগার নিয়ে। সব রাজ্য সরকরের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই রিপোর্ট বানানো হয়।
ছবি: Reuters
10 ছবি1 | 10
কিন্তু পুলিশ সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে বলছে, দলিত মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়নি। উত্তর প্রদেশের সিনিয়ার পুলিশ কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার বলেছেন, ''পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে, গলায় আঘাতের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্টে স্পার্মের চিহ্ন মেলেনি। কিছু মানুষ জাতকে টেনে এনে যে উত্তেজনা বাড়াতে চাইছে তা পরিষ্কার। এই ধরনের লোকেদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।''
হাথরাসের ঘটনার ১১ দিন পরে মেয়েটির দেহ থেকে নমুনা নেয়া হয়। সেটাও তিনদিন পরে আগ্রায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। ফরেনসিক রিপোর্টেই তার উল্লেখ আছে। ১১ তারিখ মেয়েটি তাঁর বিবৃতিও পুলিশের কাছে নথিভুক্ত করান। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেই বিবৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘটনার এতদিন পরে নমুনা সংগ্রহ এবং তা আরও পরে ফরেনসিকে পাঠানোর কারণেই স্পার্মের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অভিযোগ, পুলিশ প্রথম থেকেই ঘটনাটি ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিল। উঁচু জাতের চারজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। রাত দুটোর সময় পরিবারের লোককে আটকে রেখে তারা মেয়েটির মৃতদেহ জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রশাসন ও পুলিশ নিয়মিত পরিবারের লোককে ভয় দেখাচ্ছে বলেও অভিযোগ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ ফরেনসিকের কাছে নমুনা পাঠাতে এত দেরি করল কেন? এটাও কি ইচ্ছাকৃত? প্রথম থেকেই অভিযোগ উঠেছিল, পুলিশ কিছু ধামাচাপা দিতে চায়। তারা কী ধামাচাপা দিতে চাইছে সেই প্রশ্নও তোলেন বিশেষজ্ঞরা।
পুলিশের আচরণ নিয়ে প্রবল সমালোচনার ঝড়ের পর মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ হাথরস মামলার তদন্তের ভার সিবিআইকে দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করেছেন।