শিল্পোন্নত বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাতের কালো ছায়া জি-টোয়েন্টিকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে৷ গাজায় সংকটের বিষয়েও ঐকমত্যে পৌঁছানো যাচ্ছে না৷ ফলে বিশ্ব অর্থনীতির সমস্যা মেটাতে যৌথ উদ্যোগও দূর অস্ত৷
বিজ্ঞাপন
ইউক্রেন ও গাজার মতো সংকটের বিষয়ে বিশ্বের সেরা ২০টি অর্থনৈতিক শক্তির গোষ্ঠীর মধ্যে কতটা মতপার্থক্য ও বিভাজন রয়েছে, ব্রাজিলের সাও পাউলো শহরে অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানদের সম্মেলনে তা স্পষ্ট হয়ে গেল৷ বৃহস্পতিবার আলোচনার শেষে এমনকি যৌথ ঘোষণাপত্রও প্রকাশ করা সম্ভব হলো না৷ আয়োজক দেশ হিসেবে ব্রাজিল শুধু জি-টোয়েন্টি দেশগুলির আলোচনার সারাংশ তুলে ধরলো৷ ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাতের কালো ছায়া জি-টোয়েন্টি গোষ্ঠীকে নিষ্ক্রিয় করে তুলছে৷
ব্রাজিলের খসড়া অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ‘যুদ্ধ ও বেড়ে চলা সংকট' সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও জি-টোয়েন্টি অন্য মঞ্চে সে বিষয়ে তর্ক-বিতর্কের পক্ষে সওয়াল করছে৷ বড় মন্দা ছাড়াই মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশ্ব অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত সংকট সামলে নেবে বলেও মনে করছে এই গোষ্ঠী৷ ব্রাজিলের অর্থমন্ত্রী ফার্নান্দো আদাদের মতে, বিভিন্ন চলমান সংকট সম্পর্কে গত সপ্তাহে জি-টোয়েন্টি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে তীব্র মতপার্থক্যের জের ধরে অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনও ‘দূষিত' হয়ে গেছে৷ ফলে ব্রাজিলের উদ্যোগে অত্যন্ত ধনীদের সম্পদের উপর ন্যূনতম কর চাপানোর মতো প্রস্তাব নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা সম্ভব হয়নি৷ বিশ্বায়নের নতুন সংস্করণের প্রস্তাব দিয়েছে ব্রাজিল৷
জি-টোয়েন্টি গোষ্ঠীর মধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলির গোষ্ঠী জি-সেভেন ও জাপানের সঙ্গে অন্যান্য দেশগুলির মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলি ইউক্রেনের ‘উপর' চাপানো যুদ্ধের উল্লেখ করতে চাইলেও রাশিয়া সেই ঘটনাকে ইউক্রেনের ‘মধ্যে' যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করতে চেয়েছিল৷ জি-সেভেন ইসরায়েলের উল্লেখ না করেই গাজার যুদ্ধকে ‘মানবিক সংকট' হিসেবে বর্ণনা করতে চেয়েছিল৷ ফলে সে বিষয়েও ঐকমত্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি৷ এমনকি ব্রাজিল সম্মেলনের অ্যাজেন্ডায় জলবায়ু পরিবর্তন ও দারিদ্রের মতো সমস্যার মোকাবিলা করতে অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রতি মনোযোগ দিতে চাইলেও জার্মানিসহ শিল্পোন্নত দেশগুলি যৌথ বিবৃতিতে ইউক্রেন ও গাজার উল্লেখ করার উপর জোর দিয়েছে৷
জাপানের প্রতিনিধি মাসাতো কান্দা বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির উপর সংকটগুলির বিশাল প্রভাব রয়েছে৷ এর ফলে খাদ্যপণ্যের মূল্যসহ একাধিক প্রভাব দেখা যাচ্ছে৷ তাই জি-টোয়েন্টি মঞ্চে সে বিষয়ে আলোচনা করতেই হয়৷ জার্মানির অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির উপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য ভাষার বিষয়ে ঐকমত্যের অভাবে যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি৷ তাছাড়া ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলার সঙ্গে গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে সমানভাবে গণ্য করার চেষ্টাও হয়েছে৷ জার্মানি এমন মূল্যায়নে সায় দিতে পারেনি৷ রাশিয়ার সম্পত্তি জব্দ করার বিষয়েও সম্মেলনে কোনো ঐকমত্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, ডিপিএ)
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জোট
পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সামনে এগিয়ে যেতে দেশগুলো বিভিন্ন জোটে যুক্ত হয়৷ ছবিঘরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক জোটের কথা থাকছে৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/D. Solanki
আফ্রিকান ইউনিয়ন
আফ্রিকার ৫৫টি দেশের জোট এটি৷ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৭.৯৩ শতাংশ মানুষ এসব দেশে বাস করেন৷ বার্ষিক অর্থনৈতিক আউটপুট ২.৯৩৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব অর্থনীতির ২.৯ শতাংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
আরব লিগ
উত্তর আফ্রিকা ও আরব উপত্যকার ২২টি দেশ এর সদস্য৷ এই দেশগুলোতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫.৮ শতাংশ মানুষ বাস করে৷
ছবি: Tunisian Presidency/REUTERS
ব্রিকস
বর্তমান সদস্য ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও সাউথ আফ্রিকা৷ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪১.১৩ শতাংশ মানুষ এই পাঁচ দেশে বাস করেন৷ বৈশ্বিক জিডিপির ২৫.৭৭ শতাংশ উৎপাদন করে এই দেশগুলো৷ সম্প্রতি আরও ছয়টি দেশকে ব্রিকসে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়৷ এগুলো হচ্ছে আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত৷
ছবি: Sergei Bobylev/dpa/picture alliance
কমনওয়েলথ অফ নেশন্স
সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ৫২টি দেশ এর সদস্য৷ ১৯৩১ সালে এটি গঠন করা হয়েছিল৷ ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ এর সদস্য৷
ছবি: Aleksey Butenkov/Zoonar/picture alliance
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপের ২৭টি দেশের জোট৷ এসব দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫.৬ শতাংশ৷
ছবি: Kenzo Tribouillard/AFP/Getty Images
জি-টোয়েন্টি
বিশ্বের ১৯টি নেতৃস্থানীয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল দেশের এই জোট ১৯৯৯ সালে গঠিত হয়৷ ২০তম সদস্য হিসেবে এই জোটে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও৷ এই জোটের দেশগুলোর জনসংখ্যা ৪৬৯ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫৯.০৪ শতাংশ৷
ছবি: Aamir Ansari/DW
জি-সেভেন
১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এটি জি-এইট নামে পরিচিত ছিল৷ ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রাইমিয়া দখলের পর দেশটিকে এই জোট থেকে বহিষ্কার করা হয়৷ বর্তমানে জি-সেভেনের দেশগুলো হচ্ছে ক্যানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র৷ শিল্পোন্নত এই সাত দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৯২ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১১.৫৫ শতাংশ৷
ছবি: Frank Robichon via REUTERS
উপসাগর সহযোগী সংস্থা বা জিসিসি
পশ্চিম এশিয়ার ছয় দেশের জোট জিসিসি৷ এগুলো হলো বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত৷
ছবি: Bandar Aljaloud/Saudi Royal Palace/AP/picture alliance
ন্যাটো
৩১ দেশের সামরিক জোট ‘নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ন্যাটো৷ ১৯৪৯ সালে গঠিত ন্যাটোর সদরদপ্তর ব্রাসেলসে৷ কোনো এক সদস্য দেশের উপর হামলা হলে বাকি সব সদস্যদেশ তার সহায়তায় এগিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে ন্যাটো চুক্তির ৫ নম্বর ধারাতে৷
ছবি: Stefan Puchner/dpa/picture alliance
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, ন্যাম
১৯৬১ সালে ব্রেলগ্রেডে এটি গঠিত হয়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পুঁজিবাদী দেশসমূহের জোট ন্যাটো এবং সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের জোট ওয়ারশ থেকে নিরপেক্ষ থাকতে এটি গঠন করা হয়েছিল৷ সদস্য সংখ্যা ১২০৷ বেশিরভাগ সদস্য দেশ আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ল্যাটিন অ্যামেরিকার অংশ৷ বাংলাদেশও এর সদস্য৷
ছবি: Darko Vojinovic/AP/picture alliance
ওইসিডি
‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা’ বা ওইসিডির সদস্যসংখ্যা ৩৬৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা ও ২০টি ইউরোপীয় দেশ ওইইসি (ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা) নামে একটি জোট গঠন করেছিল৷ এটিই পরে ওইসিডিতে পরিণত হলে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সাউথ কোরিয়ার মতো দেশ এতে যোগ দেয়৷
ছবি: Francois Mori/AP Photo/picture alliance
ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা, ওআইসি
যেসব দেশে ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এমন ৫৬টি দেশের জোট এটি৷ ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশ এর সদস্য৷ ওআইসি দেশগুলোর জনসংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪.৯২ শতাংশ৷
ছবি: Getty Images/AFP/O. Kose
জাতিসংঘ
১৯৩ দেশের জোট এটি৷ ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশ এর সদস্য৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Roberts
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, ডাব্লিউটিও
এটি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যা বিশ্বের বাণিজ্য সংক্রান্ত নীতি প্রবর্তন এবং সদস্য রাষ্ট্র বা পক্ষসমূহের মধ্যকার মতপার্থক্য দূর করতে সাহায্য করে৷ ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার সদস্যসংখ্যা ১৬৩৷ বাংলাদেশ শুরু থেকেই এই সংস্থার সদস্য৷
ছবি: Xu Jinquan/Photoshot/picture-alliance
বিমসটেক
পুরো নাম ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্ট্রি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন’ অর্থাৎ বহুপক্ষীয় কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বঙ্গোপসাগরীয় উদ্যোগ৷ ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে এই জোট সৃষ্টি করা হয়৷ পরে নেপাল, মিয়ানমার ও ভুটান এতে যোগ দেয়৷ ২০২২ সালের মার্চে সবশেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে৷ সচিবালয় ঢাকায় অবস্থিত৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/D. Solanki
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা, সার্ক
১৯৮৫ সালে গঠিত সার্কের বর্তমান সদস্য সংখ্যা আট৷ এগুলো হলো আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা৷ এই জোটের সবশেষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে, নেপালে৷ ২০১৬ সালে ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের উরিতে হামলার পর ঐ বছর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া শীর্ষ সম্মেলনটি স্থগিত করা হয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/N. Shrestha
ডি-এইট
ডেভেলপিং এইট বা উন্নয়নশীল আট দেশ নিয়ে গঠিত এই জোট ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করে৷ তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেচমেতিন এরবাকান এটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ এটি একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন জোট৷ বাংলাদেশ, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান এবং তুরস্ক এই জোটের সদস্য৷